হাওর বার্তা ডেস্কঃ বন্দুকের জোরে মসনদ দখল করলেও ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য সামরিক শাসকদের রাজনৈতিক দল গঠন করা ছিলো অনিবার্য। কিন্তু এ প্রক্রিয়া ‘কুন’ বলার মতো বিষয় ছিলো না। কর্নেল আকবর হোসেন, অধ্যক্ষ ইউনুস খান ও মির্জা আব্বাসের সঙ্গে আলাপ করে মনে হয়েছে, এজন্য ডিগবাজি বিশারদ নেতাদের বগলদাবা করা যত সহজ, তৃণমূল বাগে আনা ছিলো ততই কঠিন। এদিকে এরা তিনজনই বিশ্বাস করতেন, জিয়াউর রহমান সময়ের বরপুত্র; ঘটনাপ্রবাহই তাকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় এনেছে, ষড়যন্ত্র নয়।
তাদের এ বিশ্বাসের সঙ্গে একমত না হয়েও বুঝেছি, নানান শক্তি কেন্দ্রকে বশ করার ক্ষেত্রে ক্ষমতা দখলকারীদের তৃণমূল নিয়ে অনেক বেশি বেগ পেতে হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভাত ছিটিয়ে কাক জড়ো করার মতো সহজ ছিলো রাজনীতির কথিত সিনিয়র নেতাদের পদলেহনকারী বানানো। যে কারণে ব্যারিস্টার মওদুদ, কাজী জাফর, ব্যারিস্টার হাসনাতসহ অনেক নেতা দুই সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদের দলে দাঁত কেলিয়ে হেসেছেন। আবার যারা প্রকাশ্যে আব্রু নষ্ট করেননি তাদের শান্ত রাখার জন্য একটি অতি পরিচিত প্রাণীর সামনে হাড় ছুঁড়ে দেবার মতো কিছু না কিছু দিতে হয়েছে; যাকে বলা হয় রাজনীতির হালুয়া-রুটি। এরা ঘরের শত্রু বিভিষণের মতো সরকারবিরোধী রাজনৈতিক তৎপরতার খবর এজেন্সির মাধ্যমে সামরিক যান্তাকে সরবরাহ করতেন। এ ক্ষেত্রে রাজনীতিতে যে যত কথিত সিনিয়র তাকে ম্যানেজ করা ছিলো তত সহজ। অনেকে আবার মধুর ডাক শোনার জন্য ‘ও আমি কান পেতে রই’ অবস্থার আবেশে থাকতেন। এদের মধ্যে একজনকে মুখের কথায় চিড়া ভিজিয়ে ম্যানেজ করার জন্য জিয়াউর রহমান বলতেন ‘ইউ হ্যাভ টু জিয়া, একজন আপনার ঘরে আর একজন বঙ্গভবনে।’ এ নেতা জেনারেল এরশাদের সময় সামরিক শাসকের ফাঁদে বগার মতো ধরা পড়েছিলেন এবং পরিত্যক্ত হয়েছেন নয় মাসের মধ্যে।
অতীতের এ সব দৃষ্টান্ত থেকে সিনিয়র রাজনীতিকরা শিক্ষা নেননি। ফলে ওয়ান ইলেভেনে মসনদ দখলকারী জেনারেল মঈন ইউ আহমেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার অপকর্মে অংশ নেবার জন্যও অনেকে সিনিয়র নেতা একেবারে মুখিয়ে ছিলেন। এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন আগের দুই সামরিক জান্তার পদলেহনকারীসহ ট্রেন মিস করা সিনিয়র কয়েক নেতাও। জেনারেল মঈন সফল হলে এরা হতেন সামরিক সরকারে নতুন ‘মফিজ’। এদের মধ্যে আওয়ামী লীগের এক হালি নেতা প্রকাশ্যে সক্রিয় হয়েছিলেন। বিএনপির ডজনখানেক নেতা তো ছিলেনই। তবে বিএনপির নেতাদের ডিগবাজিতে তেমন কেউ বিস্মিত হননি। কারণ, ডিগবাজি খাওয়া তাদের নির্লজ্জ বৈশিষ্ট্য। দেশব্যাপী বিস্ময় সৃষ্টি হয়েছে আওয়ামী লীগ নেতাদের দৌঁড়ঝাঁপ নিয়ে। এদের মধ্যে একজন তো কয়েক ধাপ এগিয়ে ডিগবাজির প্রস্তুতির কথা গোপন রাখার পর্দা উঠিয়ে ফেলেছিলেন নিজের বস্ত্রহরণ করার মতো। কিন্তু কর্মী ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এ নেতাও তৃণমূল থেকে তেমন কাউকে টানতে পারেননি। তার অতি ঘনিষ্ঠ শিষ্য হিসেবে পরিচিত জেলা পর্যায়ে এক নেতা এলাকার নেতা-কর্মীদের সঙ্গে আলাপ করলে তাকে সাফ জানিয়ে দেয়া হয়, গেলে তাকে একাই যেতে হবে! ফলে জেলা নেতাটিও আর কেন্দ্রীর নেতার সঙ্গে পো ধরেননি। এরপরও আওয়ামী লীগের উল্লেখ্য নেতাটি সামরিক যান্তার দোসর হিসেবে খুবই প্রকাশ্য ছিলেন। একদিন তিনি তার বাসায় কয়েক সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে কেবলা বদলের পক্ষে যুক্তি হিসেবে বলেছিলেন, ‘নেত্রী যে ভুল করেছেন তাতে আগামী বিশ বছরে আওয়ামী লীগ আর ক্ষমতায় আসতে পারবে না।’ সেদিন ‘রামের মুখে ভুতের নাম’ শুনে আমি আঁতকে উঠেছিলাম। এ সময় আরও কয়েকজন সাংবাদিকের মধ্যে মশিউর রহমানও ছিলো; আমরা তখন দৈনিক যায়যায়দিনে কাজ করি।
জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ শেষতক ব্যর্থ হয়েছেন জেনারেল খালেদ মোশাররফের মতো দ্বিধাপ্রবণ মানসিকতা, সেনা প্রধানের মূলভিত্তি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় অ্যাক্ট করতে না পারা এবং রাজনীতির অধিকতর শক্তিশালী তৃণমূল সাড়া না দেয়া। যে কারণে তিনি এবং তার সাঙ্গাতরা সিনিয়র নেতাদের জন্য দ্বিতীয় পর্যায়ের ভাত ছিটানোর আগেই রণেভঙ্গ দিয়েছেন। বলা হয়, ক্ষমতা দখল করে যাদের ঘাড়ে ধরেছিলেন তাদের এক পক্ষের পায়ে পড়ে সমঝোতার কাভারেজে দেশে ছেড়ে বেঁচেছেন মঈনউদ্দিন-ফখরুদ্দিন গং। অনেক অপকর্ম করা সত্ত্বেও তাদের সরকার এক রকম পপুলার সাপোর্ট পেয়েছিল। কিন্তু রাজনীতির তৃণমূল টানতে নিদারুণভাবে ব্যর্থতার কারণে তাদের লক্ষ্য মাটি হয়ে গেছে। কবির ভাষায় যে মাটিতে ব্যাঙ্গের ছাতা ছাড়া আর কোনো বৃক্ষ জন্মায় না।
তৃণমূল ম্যানেজ করা যে কত কঠিন তা প্রথম টের পেয়েছেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। যদিও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কারণে সেময় তৃণমূলের রাজনীতি কান্ডারিহীন নৌকার মতো ছিলো। এরপরও গুন্ডা ইমেজের হেমায়েত উল্লাহ আওরঙ্গকে মন্ত্রী করার টোপ দিয়েও জিয়ার দলে ভেড়াতে পারেননি তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কর্নেল মোস্তাফিজুর রহমান। আর মির্জা আব্বাসের মতো একজন নবীন ওয়ার্ড কমিশনারকে ম্যানেজ করতে জেনারেল জিয়াকে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে মেয়র হিসেবে ব্যরিস্টার আবুল হাসনাতকে ভোট দেবার জন্য।
তখন মেয়র নির্বাচিত হতেন কমিশনারদের মধ্য থেকে; কমিশনারদের ভোটে। মেয়র পদে ব্যারিস্টার হাসনাতকে ভোট দেয়ার জন্য জেনারেল জিয়ার তৎপরতার কাহিনী শুনেছি মির্জা আব্বাসের মুখে কর্নেল আকবরের বাসায় তার সঙ্গে প্রথম দেখার দিন। তার বক্তব্য অনুসারে জিয়াউর রহমান অনেকটা ধমকাধমকি করে ব্যারিস্টার হাসনাতকে ভোট দিতে বাধ্য করেছিলেন। সাজানো নির্বাচনে মেয়র হবার পর অখ্যাত ব্যারিস্টার থেকে জাতীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন আবুল হাসনাত। জিয়াউর রহমান তাকে বাছাই করার কারণ ছিলো মাজেদ সর্দার; আর সে সময় পুরান ঢাকায় ব্যারিস্টার গোছের ‘মহা শিক্ষিত’ লোক খুব বেশি ছিলো না। মজার বিষয় হচ্ছে, নানান মেকানিজমে ব্যারিস্টার হাসনাতকে মেয়র বানিয়ে জাতীয় ফিগারে পরিণত করে নেতা হবার স্বর্ণদ্বার খুলে দিলেও তিনি শেষতক জিয়ার দল বিএনপিতে থাকেননি; আবার জনতার স্মৃতিতে বেঁচে থাকার মতো গ্রহণযোগ্য জাতীয় পর্যায়ের নেতাও হতে পারেননি।
বিএনপির মহাসচিব থাকাকালে কে এম ওবায়দুর রহমান দল থেকে বহিষ্কৃত হবার পর তার সঙ্গে জোট বাঁধার চেষ্টা করেন ব্যারিস্টার হাসনাত। এক দিন তাকে আসাদ গেটে ওবায়দুর রহমানের বাসায় দেখে বললাম, হাসনাত ভাই আপনি এখানে? বিব্রত হাসনাতকে বাঁচাতে আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন বহিষ্কৃত ওবায়দুর রহমান, “হাসনাত এখন আমাদের সঙ্গে জাতীয় রাজনীতি করবে।’ কিন্তু তিনি জাতীয় রাজনীতি করার জন্য বেশি দিন ওবায়দুর রহমানের সঙ্গে থাকেননি। তার গোপন যোগাযোগ হয় জেনারেল এরশাদের সঙ্গে। যার ক্ষমতা দখলের পর গোপনে দেশ ত্যাগ করে চামড়া বাঁচিয়েছিলেন ব্যারিস্টার হাসনাত। এদিকে আর এক ব্যারিস্টার মওদুদের পিঠের চামড়া তুলে ফেলার মতো অবস্থা করেছিলেন জেনারেল এরশাদ। এরপরও এরশাদের মন্ত্রী ও উপ-রাষ্ট্রপতি হয়েছেন ব্যারিস্টার মওদুদ; তিনি এখন বিএনপির নীতিনির্ধারণী নেতা। এ দৈন্যতাও সম্ভবত বিএনপির দুর্গতির প্রধান কারণগুলোর একটি।
এরশাদ সরকারের শেষ দিকে তার সঙ্গে গাটছড়া বাঁধেন ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত। এ নিয়ে গুঞ্জন প্রসঙ্গে তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, “এরশাদের সঙ্গে গেলে পাবলিক আমার মুখে থুথু দেবে না।’ এ শিরোণামে তার বক্তব্য ছাপাও হয়েছিলো সাপ্তাহিক সুগন্ধায়। এর সপ্তাহ খানেক পরই তিনি এরশাদের মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন। রেডিওতে এ খবর শুনে রাতে তাকে আমি ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম, পাবলিক এখন আপনার মুখে কি পরিমাণ থুথু দেবে? তিনি বললেন, “কেন লজ্জা দেন আলম রায়হান।’ এর অনেক আগে আমার কাছে একই রকমের লাজুক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন মানিকগঞ্জের ক্যাপ্টেন হালিম জেনারেল এরশাদ সরকারে যোগ দেবার পর। এদিকে সাংবাদিক মাহমুদ হাসানের কাছে শুনেছি, এরশাদ সরকারের মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেবার আগের সন্ধ্যায় ধানমন্ডি সাতাশ নম্বরে বিএনপি অফিসে গুঞ্জনের জবাবে ব্যারিস্টার হাসনাত বলেছিলেন, বিএনপিতে কেউ না থাকলেও তিনি বাতি জ্বালাবার জন্য থেকে যাবেন। কিন্তু তিনি থাকেননি। এদিকে এরশাদ সরকারের পতন হওয়ায় বেশি দিন মন্ত্রিত্বের আসনেও থাকা হয়নি তার। এরপর তিনি রাজনীতিতে উপযোগিতা হারিয়ে হয়ে যান অনেকটা অচ্ছুত। অথচ ছাত্রজীবনে রাজনীতিতে তিনি বেশ প্রভাবশালী ছিলেন। হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বাতিলের দাবিতে ঐতিহাসিক পলটন ময়দানে ছাত্র-জনতার সমাবেশের মঞ্চে যে নেতারা প্রথম সাঁড়িতে বসেছেন তাদের মধ্যে আবুল হাসনাতও ছিলেন। কিন্তু জাতীয় রাজনীতিতে তিনি প্রথম সাঁড়িতে কখনো আসন করেনিতে পারেননি। এদিকে জেনারেল জিয়ার ধমকে তাকে ভোট প্রদানকারী কমিশনার মির্জা আব্বাস বিএনপিতেই থেকেছেন; বলা হয় বিএনপির নেতাদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার। আর এ দল থেকেই তিনি হয়েছেন মেয়র-মন্ত্রী এবং দলের নীতি নির্ধারণী নেতা। এই আব্বাসের সঙ্গে প্রথম দেখা হয় কর্নেল আকবরের বাসায়; নানান তিক্ততার পর দ্বিতীয় দেখা হয় সচিবালয়ে কর্নেল আকবরের অফিসে। যা আগেই বলেছি। দ্বিতীয় দেখাই শেষ দেখা হতে পারতো। কিন্তু তা হয়নি মোস্তফা ফিরোজের কারণে।
একুশে টিভির পর্ব চুকিয়ে সূচনা পর্বে এনটিভি-তে যারা যোগ দেন তাদের মধ্যে মোস্তফা ফিরোজও ছিলেন। তিনি আমার পূর্ব পরিচিত দৈনিক সমাচার দিয়ে; তখন তিনি দৈনিক দেশ-এর বিশ্ববিদ্যালয়ের রিপোর্টার হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি দৈনিক সমাচারেও রিপোর্ট দিতেন। দৈনিক সমাচারের অফিস ছিলো বাংলাবাজার এলাকায় পোস্ট অফিস লাগোয়া। সেই পরিচয়ের সূত্র ধরে পরে তার সঙ্গে একান্ত ঘনিষ্ঠতা হয়েছে; তার মাধ্যমেই পত্রিকা থেকে আমার টেলিভিশনে যুক্ত হওয়া। মাঝেমধ্যে কিছু তিক্ততা সৃষ্টি হলেও তা আমাদের সম্পর্কে বড় কোনো ফাটল ধরায়নি; অবশ্য এ ক্ষেত্রে বেশি সহায়ক মোস্তফা ফিরোজের উদার মানসিকতা।
আনুষ্ঠানিক অনএয়ার হবার আগে টেলিভিশনের অনেক কাজ থাকে, আগে থেকেই অনেক কিছু করে রাখতে হয়। এ কাজে ব্যস্ততার মধ্যে মোস্তফা ফিরোজের সঙ্গে একদিন দেখা হয় সচিবালয়ে। তখন আমি দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকায়। বললেন, চলেন আপনার বন্ধুর কাছে যাই।
: কে?
: মির্জা আব্বাস..
তখন মির্জা আব্বাস পূর্তমন্ত্রী এবং ভূমি দস্যুদের তোপের মুখে নিপতিত। আঁতকে ওঠার মতো প্রচণ্ড আপত্তি করে বললাম, না ভাই; আমি যাবো না। তবে শেষতক গিয়েছিলাম, ভয়ে ভয়ে। পরে মনে হয়েছে, সে দিন না গেলে নতুন এক মির্জা আব্বাসকে মিস করতাম; সে ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা, অন্য এক মানুষ চেনা।
আলম রায়হান, জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়