১৯৭২ সালে বিদেশি সাংবাদিকরা ড. কামাল হোসেনকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় শক্তি কী? উত্তরে সে সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, মানুষের প্রতি ভালোবাসা। তাঁর সবচেয়ে বড় দুর্বলতা কী- এ প্রশ্নের জবাবেও ড. কামাল বলেন, মানুষের প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা।
মানুষের জন্য ভালোবাসাই শক্তি জুগিয়েছে তাঁর রাজনীতিতে, তাঁকে চালিত করেছে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে। এ ভালোবাসা ছিল নিখাদ, সহজাত; যা মানুষকে আপন করে নেয়, ভরসা দেয়।
দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে দেশের আনাচকানাচে ঘুরেছেন, সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশেছেন তাদেরই একজন হয়ে। মাটি ও মানুষের সঙ্গে তাঁর এ গাঁটছড়া ভাঙেনি তিনি যখন রাষ্ট্রপ্রধান তখনো। কোনো রাষ্ট্রাচার দেয়াল তুলতে পারেনি মানুষ ও তাঁর মধ্যে, কোনো গোপন সতর্কবার্তা চিড় ধরাতে পারেনি মানুষের প্রতি তাঁর বিশ্বাসে। তাঁকে যাঁরা কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছেন, মানুষের প্রতি তাঁর মমতা ও বিশ্বাসে তাঁরা চমৎকৃত হয়েছেন, বিস্মিত হয়েছেন। আবার শঙ্কিতও হয়েছেন। কারণ এ ভালোবাসা ছিল অন্ধ, এতে শত্রু-মিত্র ভেদ নেই, সন্দেহ নেই।
জাতীয় অধ্যাপক ডাক্তার নুরুল ইসলাম ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত চিকিৎসক। ১৯৮২ সালে যখন বঙ্গবন্ধু প্রায় নিষিদ্ধ একটি শব্দ, তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন : ‘আমি মার্শাল ল হোক, সিভিল ল হোক- যেকোনো লয়ের সামনে বলছি, যদি দুনিয়াতে আর কোনো ফেরেশতা হওয়ার প্রভিশন থাকত, তাহলে বঙ্গবন্ধু সেই ফেরেশতা হতেন।’
উদার মনেই সহনশীলতা, পরমতসহিষ্ণুতা থাকে। বঙ্গবন্ধুর তা ছিল। পাকিস্তানি সেনা সদস্যদের যুদ্ধাপরাধের বিচারে বঙ্গবন্ধু আগ্রহ হারাচ্ছেন- এমন একটি খবর ছাপা হয়েছিল ভারতের ‘দ্য স্টেটসম্যান’ পত্রিকায়, ১৯৭৩ সালে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে মুখিয়ে আছে দেশের মানুষ, ভারতের হাতে বন্দি ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনার ভাগ্য জড়িত এর সঙ্গে। খবরটি ওই সময়ে খুবই সংবেদনশীল। তোয়াব খান (তখন বঙ্গবন্ধুর প্রেসসচিব) ওই পত্রিকার প্রতিনিধি মানস ঘোষকে গণভবনে যেতে বললেন। সেই অভিজ্ঞতা মানস নিজেই লিখেছেন। বঙ্গবন্ধু স্বভাবতই বিচলিত। তবু তরুণ প্রতিবেদক মানস ঘোষকে হাসিমুখে সম্ভাষণ করলেন তাঁর কক্ষে। বললেন: ‘তুমি তো আমার সাথে শ্রীমতী গান্ধীর যুদ্ধ লাগায়ে দিছ।’ এরপর চা-বিস্কুট এগিয়ে দিয়ে হেসে বললেন, ‘তুমি তোমার কাজ করো।’ স্কুলজীবন থেকে স্টেটসম্যান পড়েন জানিয়ে বঙ্গবন্ধু পত্রিকাটির সুনাম অক্ষুণ্ন রাখার উপদেশ দিয়ে পিঠ চাপড়িয়ে বিদায় জানালেন মানসকে।
নেতার ব্যক্তিত্ব, পিতার মমত্ব ছিল তাঁর, তাই তাঁর মুখে ‘তুই’ সম্বোধন মানিয়ে যেত। জনসভায় দাঁড়িয়ে তিনি মানুষদের অভিহিত করতে ‘আমার মানুষ’ বলে, অনায়াসে ‘তুমি’, ‘তোমরা’ সম্বোধন করতেন। জনমানুষের নেতা বলেই পারতেন তিনি। তাঁর এ সম্বোধনে তাচ্ছিল্য ছিল না, ছিল গভীর স্নেহ, অধিকারবোধ। অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী যেমনটি বলেছেন : “তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে ‘হিউব্রিস’ বা অতিগর্বের প্রমাণ পাইনি। যেটা পাই তা এক পিতৃতান্ত্রিক মেজাজ, যার প্রভাবে তাঁর মুখে ‘তুই’ সম্বোধন সহজেই এসেছে। যাঁদের এ সম্বোধন করেছেন তাঁরা জেনেছেন এর পেছনে আছে এক গভীর মমত্ববোধ।”
সেই ভালোবাসায় চিরজীবী তিনি
জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী আরো লিখেছেন, “মহানুভবতা ও সহৃদয়তায় পরিপূর্ণ ছিল তাঁর অন্তর। রাজনৈতিকভাবে যারা তার প্রতিপক্ষ ছিল, তাদের জন্যও খোলা ছিল তার হৃদয়ের দ্বার। ‘ট্র্যাজিক ফ্ল’ বা চারিত্রিক দুর্বলতা যদি থেকে থাকে তবে তা তাঁর অতিরিক্ত সন্দেহমুক্ততা- যা মহৎ চরিত্রেরই লক্ষণ। ক্ষুদ্র স্বভাবেই থাকে সন্দেহপরায়ণতা, এ গুণটিও দোষ হয়ে যেতে পারে একজন রাষ্ট্রনায়কের বেলায়।”
বঙ্গবন্ধু একবার যাকে দেখতেন তাকে মনে রাখতেন, এমনকি নামও ভুলতেন না। কারণ তিনি দেখতেন হৃদয় দিয়ে, কথা বলতেন আপন মানুষের মতো, মনে গেঁথে নিতেন তাদের। ১৯৬৬ সালে একবার দেখা হয়েছিল কয়েক মিনিটের জন্য, এরপর ১৯৭৩ সালে। শিল্পী হাশেম খান গণভবনে গেছেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে, নতুন প্রণীত সংবিধানের অলংকরণ নিয়ে আলাপ করার জন্য। ড. কামালও (তখন আইনমন্ত্রী) আছেন সেখানে। বঙ্গবন্ধু উঠে এসে অভ্যর্থনা জানালেন শিল্পাচার্যকে। হাশেম খানকে পরিচয় করিয়ে দিতে শুরু করেছিলেন শিল্পাচার্য। তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধু বললেন: ‘আবেদিন ভাই, আমিই ওর পরিচয় দিচ্ছি। ও আমার ছয় দফার মনোগ্রাম, নকশা, পোস্টার করেছিল।’
পারিবারিক ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়েও অনেকে এসেছেন বঙ্গবন্ধুর কাছে। তাঁর গণভবনের অফিস, অথবা ধানমণ্ডি ৩২-এর বাসায়। দুটিই খোলা সবার জন্য। বিশ্বাস, একটা সমাধান মিলবেই সেখানে। প্রয়াত বিজ্ঞানী ড. এম ওয়াজেদ মিয়া তাঁর একটি বইতে লিখেছেন এমন একটি ঘটনার কথা, তাঁর দিনলিপির থেকে। ১৯৭২ সালের মে মাসের কোনো একটি দিনের স্মৃতি: ‘ঐদিন রাতে হাসিনা (বঙ্গবন্ধু কন্যা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) আমাকে জানায় যে কর্নেল (ঐ সময়ের পদমর্যাদা) জিয়াউর রহমান সাহেবের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বঙ্গবন্ধুকে তাঁর পারিবারিক কিছু সমস্যা সম্পর্কে অবহিত করার জন্যে ইতোপূর্বে বেশ কয়েকদিন বঙ্গবন্ধুর বাসায় এসেছিলেন। হাসিনা আমাকে আরও জানায়, ১৯৭১-এর মে মাসে বেগম খালেদা জিয়াকে জিয়াউর রহমান সাহেব লোক মারফত চিঠি লিখে ভারতে তাঁর (জিয়া সাহেবের) নিকট চলে যাওয়ার অনুরোধ জানানো সত্ত্বেও খালেদা জিয়া ভারতে যাননি বলে জিয়া সাহেব অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। তাছাড়া ১৯৭১-এর জুলাই মাসে বেগম খালেদা জিয়া তাঁর দুই সন্তানসহ পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার হওয়ার খবর শুনে জিয়া সাহেব শুধু দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হননি, মনে মনে ক্ষুব্ধও হয়েছিলেন। এসব ঘটনার কারণে ঐ সময় কর্নেল জিয়াউর রহমান সাহেব ও তাঁর স্ত্রী খালেদা জিয়ার মধ্যে মনোমালিন্য চলছিল। হাসিনা আমাকে আরও জানায় যে, এই পারিবারিক মনোমালিন্যের সমস্যা নিরসনে সাহায্য করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে ঐ সময় অনেক অনুরোধ করেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। খুশীর বিষয় যে, এর অল্প কিছুকাল পর বেগম জিয়ার পারিবারিক সমস্যা অবসান হয়েছিল।’
ধানমণ্ডির ৩২-এ রাষ্ট্রপতির বাসভবনে অভ্যর্থনাকারী হিসেবে কাজ করেছেন মুহিতুল ইসলাম মুহিত। ১৫ আগস্টের রাতেও তিনি দায়িত্বরত ছিলেন সেখানে। তাঁর কাছে জানা যায়, ব্যক্তিগত সহকারী বা অফিসের স্টাফ, নিরাপত্তার দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন তাঁদের সুবিধা-অসুবিধার দিকেও নজর রাখতেন রাষ্ট্রপতি। রাতে দায়িত্ব পালনকালে তাঁদের শোবার ব্যবস্থা ছিল না। তা দেখে বঙ্গবন্ধু সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ডেকে শোবার ব্যবস্থা রাখার নির্দেশ দিলেন।
বিরুদ্ধমত গ্রহণ করার উদারতা বঙ্গবন্ধুর ছিল বলেই স্বাধীনতা-উত্তরকালে দেশের চরম সংকটকালে নানাপন্থী ‘অতি-বাম’দের অপরাজনীতি সহ্য করেছিলেন। বেশ কয়েকটি কথিত বাম দল বাংলাদেশের স্বাধীনতাকেই স্বীকার করেনি, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে চিঠি দিয়ে অস্ত্র ও অর্থ সাহায্য চেয়েছে সরকার উৎখাতের জন্য। অনেকে ভিড়েছিলেন মওলানা ভাসানীর ছায়াতলে, যাঁর প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল অটল ভক্তি। মওলানার অনেক কর্মকাণ্ডই সদ্য স্বাধীন দেশের সরকারের জন্য বিব্রতকর ছিল। এতে বঙ্গবন্ধু নিজে দুঃখ পেলেও মওলানা ভাসানীর প্রতি শ্রদ্ধা হারাননি কখনো।
মওলানা ভাসানী সরকারবিরোধী জনসভা করছেন ঢাকা ও টাঙ্গাইলে, চীনপন্থী ও জাসদ নেতারাও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। এ রকম তথ্য দিয়ে তাঁকে অন্তরীণ করার অনুমতি নিতে বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলেন তৎকালীন জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা প্রধান। বঙ্গবন্ধু কয়েক মিনিট নীরব থেকে তাঁর সচিব রফিকউল্লাকে বললেন, জাফলং থেকে সবচেয়ে ভালো কমলা আর টাঙ্গাইলের দই-সন্দেশ ভাসানী সাহেবের কাছে পৌঁছে দিতে। গোয়েন্দা সংস্থা প্রধান নির্বাক অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। এ বিবরণ রয়েছে তখনকার অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের একটি লেখায়।
একদিন মিরপুর রোড দিয়ে রিকশায় যাওয়ার সময় হঠাৎ ডাক শুনে তাকালেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন (বর্তমানে পর্যটনমন্ত্রী)। দেখলেন গাড়ির কাচ নামিয়ে বঙ্গবন্ধু ‘স্বভাবসুলভ রসিকতায় হাত দিয়ে কান মলে দেওয়ার ভঙ্গি করছেন।’ বঙ্গবন্ধু তখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। মেনন স্মৃতিকথায় লিখেছেন: ‘এখন যেমন প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার জন্য আগে-পিছে নিরাপত্তা রক্ষীর গাড়ির বহরের পাশাপাশি সমস্ত রাস্তা জনমানুষকে ফাঁকা করে দিতে হয়, বঙ্গবন্ধুর জন্য তার প্রয়োজন পড়েনি। অতি সাধারণভাবেই তিনি সাধারণ মানুষদের সাথে মিশে থাকতে পেরেছেন।’
বঙ্গবন্ধু বাকশাল কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন, তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। একদিন মেনন আর হায়দার আকবর খান রনোকে বাসায় ডাকলেন রাষ্ট্রপতি। বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একমত হতে পারেননি ওয়ার্কার্স পার্টির ওই দুই নেতা, দ্বিমত করে যুক্তি তুলে ধরেছেন। ‘সেদিন তাঁর বিরাট ব্যক্তিত্বের সামনে এভাবে কথা বলার সাহস পেয়েছিলাম একটিমাত্র কারণে যে তিনি রাজনৈতিক কর্মীদের ভালোবাসতেন, তাদের আদর্শ ও বিশ্বাসকে সম্মান দিতেন।’
‘৭২-এর ১৩ জানুয়ারি থেকে ‘৭৫-এর ১০ আগস্ট পর্যন্ত গণভবনে উপসচিব ও যুগ্ম সচিব ছিলেন মনোয়ারুল ইসলাম। বঙ্গবন্ধুকে নিবিড়ভাবে দেখেছেন তিনি, অনেক ঘটনার সাক্ষী। তাঁর মূল্যায়ন, দেশের মানুষকে তিনি কঠিন হয়ে শাসন করতে চাননি, ভালোবেসে লালন করতে চেয়েছিলেন। অপরাধের শাস্তি দেওয়ার কথা উঠলেই বঙ্গবন্ধু বেশ অস্বস্তিবোধ করতেন। মনে হতো নিজেই যেন শাস্তি পেতে যাচ্ছেন। নানাভাবে জিজ্ঞেস করতেন, ওয়ার্নিং দিয়ে মাফ করে দেওয়ার কোনো সুযোগ আছে কি না। পথ বাতলে দিলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতেন। মানুষের প্রতি দরদের কারণেই এ ক্ষমাশীলতা, যাকে রাষ্ট্র পরিচালনায় দুর্বলতা বলেই মনে করতেন কেউ কেউ।
যাঁরা তাঁর জন্য সামান্য কিছু করেছেন, বিশেষ করে তাঁর দীর্ঘ রাজনীতির কঠিন দিনগুলোতে, তাঁদের কথা মনে গেঁথে রাখতেন তিনি। এঁদের মধ্যে ছিলেন খেটেখাওয়া প্রান্তিক মানুষ, তাঁদের জন্য বঙ্গবন্ধু যেন অপেক্ষায় থাকতেন বাসায়, অফিসে। একদিন গণভবনের গেটে এলেন এক দীনহীন বৃদ্ধ, মুখে পাকা দাড়ি, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে চান। নামটাও বলতে চান না। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে তাঁকে বিদায় করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি তা নেবেন না। একটিবার বঙ্গবন্ধুকে দেখেই চলে যাবেন।
শুনে বঙ্গবন্ধু হাতের কাজ সরিয়ে রেখে বৃদ্ধকে ভেতরে নিয়ে আসতে বললেন। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বুড়ো মানুষটি বঙ্গবন্ধুকে সালাম জানিয়ে জিজ্ঞেস করলেন : ‘আমাকে কি চিনবার পারছেন, বাবা?’ দেশের প্রধানমন্ত্রী কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ চিনেছি। ‘৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট ইলেকশন মিটিং করার সময় বরিশালে নৌকায় পার হয়েছিলাম। আপনি সেই নৌকার মাঝি না?’ আবেগে বুড়ো মানুষটি চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে দিলেন। উঠে এসে বঙ্গবন্ধু তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, গেট পর্যন্ত তাঁকে এগিয়ে দিয়ে এলেন। কোনো কিছুই তাঁকে দেওয়া গেল না। ২০ বছর পরও জাতির জনক তাঁকে চিনতে পেরেছেন, এটাই তাঁর কাছে বড় পাওয়া।
গ্রুপ ক্যাপ্টেন (তখনকার পদবি) এ কে খন্দকার তখন বিমানবাহিনী প্রধান। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে হেলিকপ্টারে বরিশালের একটি গ্রামে নেমেছিলেন তাঁরা। হেলিকপ্টার ঘিরে তখন মানুষের ভিড়। বঙ্গবন্ধু নেমে তাদের সঙ্গে কথা বলছেন, নাম ধরে ডাকছেন। একজনের নাম ধরে বললেন, ‘কিরে তোর কানের ঘা শুকিয়েছে?’ মানুষের প্রতি সত্যিকারের ভালোবাসা না থাকলে এ গুণ অর্জন সম্ভব নয়।
মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা সাফল্য এনেছে আন্তর্জাতিক দরকষাকষিতেও। আইন ও যুক্তির মারপ্যাঁচে আমলারা যখন পথ হারাচ্ছেন, গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা দিতে রাজি না হওয়ায় ভারতের সঙ্গে আলোচনা যখন ভেঙে যাচ্ছে, তখন বঙ্গবন্ধু রাতেই ফোন করলেন ইন্দিরা গান্ধীকে। বললেন, ‘জেলে মাঝিদের প্রায় সবাই সংখ্যালঘু হওয়ায় পাকিস্তান আর্মি এদের বাড়িঘর, নৌকা জাল সব পুড়িয়ে দিয়ে গেছে। এ সময় যদি আপনারা আমার গঙ্গা-মেঘনা শুকিয়ে ফেলেন তাহলে এদের পুনর্বাসন কিভাবে হবে? এরা আবার রিফিউজি হয়ে ভারতে চলে যাবে।’ ইন্দিরা তখনই জগজীবন রামকে (ভারতের তৎকালীন জলসম্পদমন্ত্রী) বলে দিলেন। সবাই অবাক হয়ে দেখল, ভারতীয় পক্ষ বাংলাদেশের দাবি মেনে চুক্তি সই করে দিল্লি ফিরল। বঙ্গবন্ধুর মুখে গভীর প্রশান্তি। যুক্তিতর্কে জিতে যাওয়ার গর্ব নয়, দরিদ্র মানুষের কঠিন সমস্যার সমাধানের অপার তৃপ্তি।
মেধার মূল্যায়ন করতেন তিনি, দলীয় পরিচয় দেখতেন না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদের মুখে শাহ এ এম এস কিবরিয়ার ছাত্রজীবনের কৃতিত্বের কথা শুনেছিলেন বঙ্গবন্ধু, তাঁকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক সচিব হিসেবে পদোন্নতি দিয়েছেন। কিবরিয়ার ভাষায়, ‘ভালো ছাত্রদের তিনি খুব পছন্দ করতেন। মেধাকে তিনি যথাযোগ্য গুরুত্ব ও মর্যাদা দিতেন।’
প্রশাসনে দলীয়করণের চেষ্টা তখনো ছিল, মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশে থেকে গিয়েছিলেন এমন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাকিস্তানপন্থী ‘কলাবরেটর’ বলে চাকরিচ্যুত করা, আবার মুজিববাদী, ছাত্রলীগের পরিচয় দিয়ে চাকরি বাগানোর জোর তৎপরতাও ছিল। সেদিকে তীক্ষ্ন নজর ছিল বঙ্গবন্ধুর। তিনি যোগ্যতাকে প্রাধান্য দিতেন, আবার ঢালাও অভিযোগে কারো চাকরি যাক- তা চাইতেন না। মনোয়ারুল ইসলাম ছাত্রলীগও করেননি, ভারতেও যাননি, মুক্তিযুদ্ধও করেননি। এটি জেনেও তাঁকে তাঁর দপ্তরে নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ‘কলাবেরটর’ আখ্যা দিয়ে বেশ কিছু সৎ ও দক্ষ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার চাকরিচ্যুতির ফাইলগুলো লুকিয়ে রাখতে বললেন মনোয়ারুল ইসলামকে। বঙ্গবন্ধু তাতে সই করেননি। তাঁরা সবাই দক্ষতার সঙ্গে পরবর্তী সময়ে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর সহকারী একান্ত সচিব ছিলেন শাহ্রিয়ার ইকবাল। তাঁর দেখা কিছু ঘটনা তিনি লিখেছেন, তাতে দেখা যায় বঙ্গবন্ধুর বিশাল হৃদয় শত্রুমিত্র ভেদাভেদ জানত না। তাঁদের বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করেছিলেন, সেই বিশ্বাসের মূল্য তাঁরা রাখেননি।
১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে আয়োজিত রাষ্ট্রীয় নৈশভোজে দুজন অতিথিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এ দুজন হলেন শাহ্ আজিজুর রহমান ও জহিরুদ্দিন। হানাদার পাকিস্তান বাহিনীর দালালি করার জন্য দালাল আইনে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে জেলে ছিলেন। ক্ষমালাভ করে মুক্তি পেয়েছিলেন। শাহ্ আজিজকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত করে পাঠানো হবে এমন কথা শোনা গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জেনারেল জিয়া এই শাহ্ আজিজকে প্রধানমন্ত্রী আর জহিরুদ্দিনকে পাকিস্তানে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতার কারণে কিছু রাজনৈতিক নেতা জেলে ছিলেন। তাঁদের পরিবারের যাতে কষ্ট না হয় তার জন্য আর্থিক সাহায্য করতেন বঙ্গবন্ধু।
কারো চাকরি গেলে তিনি ব্যথিত হতেন। অপরাধীর প্রতিও কঠিন হতে পারতেন না তিনি। এ রকম একটি ঘটনার কথা লিখেছেন এ কে খন্দকার। কোন এক অপরাধে এক সরকারি কর্মচারীর চাকরিচ্যুতি ঘটে। মুখ্য সচিব ওই ফাইল নিয়ে এলে বঙ্গবন্ধু ইতস্তত করে তাতে সই করে দেন। আবার মুখ্য সচিবকে বলে দিলেন : ‘চাকুরি তো গেল, লোকটি যেন পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে তার একটা বন্দোবস্ত করো।’
তাঁর উদারতার সুযোগ নিয়েছেন অনেকে, অপব্যবহার করেছেন। পাকিস্তানপন্থী হিসেবে পরিচিত ফরেন সার্ভিসের এক কর্মকর্তাকে গোপনে বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর এপিএস শাহ্রিয়ার ইকবাল। বঙ্গবন্ধুর কক্ষ থেকে হাসিমুখে বের হলেন ওই কর্মকর্তা, এক সপ্তাহের মধ্যেই তিনি মিসরে রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হলেন। কিন্তু মিসরে যাওয়ার আগেই ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলেন। খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেই ওই কর্মকর্তাকে পররাষ্ট্রসচিব নিয়োগ করলেন।
সরকারি চাকরি ছাড়তে চাইলেন এক কর্মকর্তা। তাঁর পিতার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর মতপার্থক্য ছিল। এতে তাঁর চাকরিতে কোনো অসুবিধা হবে না এমন নিশ্চয়তা দিয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁকে চাকরি না ছেড়ে প্রয়োজনে ছুটি নেওয়ার পরামর্শ দিলেন। তবু চাকরি ছেড়ে আমেরিকা চলে যান ওই কর্মকর্তা। ‘৭৫-এ পট পরিবর্তনের পর দেশে ফিরে খন্দকার মোশতাকের কাছে গিয়ে তিনি বললেন, তাঁর পিতার সঙ্গে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক মতবিরোধ থাকায় তাঁকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল। মোশতাক তাঁকে চাকরিতে পুনর্বহাল করলেন। এরপর আবারও আমেরিকা গিয়ে আর দেশে ফেরেননি তিনি।
বঙ্গবন্ধুর মুখ্য সচিব রুহুল কুদ্দুছ চিকিৎসা ছুটি নিয়ে লন্ডন চলে যান ‘৭৫-এর ফেব্রুয়ারি মাসে। এই প্রবীণ প্রশাসক যে জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। বিদায় নেওয়ার আগে তিনি মনোয়ারুল ইসলামকে ডেকে বলেছিলেন, ‘তোমারও এখানে বেশি দিন থাকা হবে না বোধ হয়।… আগস্ট মাস পার হবে না।’
কথাটি বঙ্গবন্ধুকেও বলেছিলেন রুহুল কুদ্দুছ। তিনি কি বিশ্বাস করেছিলেন? করলেও তিনি কোথায় যাবেন এ দেশ, এ মাটি আর মানুষ ছেড়ে? দেশের বাইরেও ষড়যন্ত্র ছিল। বিদেশি বন্ধুরা তাঁকে সতর্কও করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন এক কর্মকর্তার মাধ্যমে তাঁর আশঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী পিয়ের ট্রুডো। বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর জীবনের ঝুঁকি আছে, গভীর ষড়যন্ত্র চলছে তাঁর বিরুদ্ধে।
কাছের মানুষরা যে অভিমান নিয়ে দূরে সরে যাচ্ছে। চারপাশ থেকে নানা গুঞ্জন, অশনিসংকেত, নানা আলামত। সাহস করে কেউ কেউ তাঁর কানে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, গায়ে মাখেননি বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু কি কিছুই বোঝেননি? সবাই তো তাঁর ভালোবাসার মানুষ, আপনজন, কাকে কী বলবেন তিনি!
‘৭৫-এর ১৫ আগস্ট রাতে বঙ্গবন্ধুর শয়নকক্ষের সামনের বারান্দায় শুয়েছিলেন সেলিম ও আবদুর রহমান। দুজনই ওই বাসায় কাজ করতেন। পুরো বাড়িতে তখন সশস্ত্র ঘাতকদের তাণ্ডব। নিচে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে তারা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে আসছে। হাতে ও পেটে গুলি খেয়ে রক্তাক্ত সেলিম তখন সিঁড়িতে বসে আছেন। আদালতে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে সে বীভৎস রাতের বর্ণনা দেন সেলিম। চার-পাঁচজন আর্মির লোক বঙ্গবন্ধুকে তাঁর ঘর থেকে সিঁড়ির দিকে নিয়ে যায়। সেলিমকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে বলেন, ‘এই ছেলেটা ছোটবেলা থেকে আমাদের এখানে থাকে, একে কে গুলি করল?’ মুহূর্তের মধ্যেই সিঁড়িতে গুলির শব্দ। কিছুক্ষণ পর সেলিম নিচে নামতে গিয়ে দেখেন বঙ্গবন্ধুর লাশ সিঁড়িতে পড়ে আছে।
আজীবন সাধারণ মানুষকে ভালোবেসেছেন। ঘাতকের বুলেটে বিদ্ধ হওয়ার আগেও গৃহকর্মীর যন্ত্রণায় কাতর হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ৪০ বছর কেটে গেছে। সেলিমদের মতো সাধারণ মানুষদের কাছে বঙ্গবন্ধু আপনজন, মহামানব। সভা-সেমিনার বক্তৃতা-বিবৃতির আড়ম্বরে নয়, বঙ্গবন্ধুকে তাঁরা আগলে রেখেছেন হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসায়। কোনো কিছু পাওয়ার আশায় নয়। কেউ রোজা রাখছেন, কেউ জুতা পরা ছেড়ে দিয়েছেন, কেউ বা ছবি আঁকছেন, ভাস্কর্য অথবা চেয়ার তৈরি করছেন। এঁরা বঙ্গবন্ধুকে কোনোদিন দেখেনওনি। মানুষের ভালোবাসায় এভাবেই বেঁচে থাকবেন বঙ্গবন্ধু।