হাওর বার্তা ডেস্কঃ বিশ্বখ্যাত নিউজউইক ম্যাগাজিন ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল প্রকাশিত সংখ্যায় বঙ্গবন্ধুকে ‘পোয়েট অব পলিটিকস’ বা ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। সেদিন অবিচল আস্থা ও গভীর শ্রদ্ধা নিয়ে একজন মহান নেতার উত্থান দেখেছিল বিশ্ব। তাঁকে গ্রহণ করেছিল শোষিত-নিপীড়িত মানুষের নেতা হিসেবেই। ফিদেল কাস্ত্রো থেকে শুরু করে অনেক বিশ্বনেতার প্রশংসাতেই আমরা তাঁর আঁচ পাই। আমরা যখন কবিতার মতো এক পরিশীলিত সমাজের কথা বলি, শোষণমুক্তি ও গণতন্ত্রের কথা বলি, তখন আমাদের সেই রাজনীতির কবিকে, বাঙালির মুক্তির দূতকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে। কারণ এই চিন্তার সূত্রটাই তো তিনি। তাঁর প্রবহমান রক্তের ধারায় এই চেতনা মিশে গেছে নদী-মাঠ-ঘাটে, বাংলার শ্যামলিমায়। আজ ১৫ আগস্ট শোকাহত চিত্তে বাঙালির সেই মহান নেতার প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা ।
এই নৃশংস ঘটনা কেবল বাংলাদেশের ইতিহাসেই নয়, পৃথিবীর ইতিহাসেও বিরল। এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে মুছে ফেলে পরাজিত শক্তিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা এবং স্বাধীনতার রূপকার। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ‘৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ‘৫৮-এর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ‘৬৬-এর ৬ দফা আন্দোলন, ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ‘৭০-এর নির্বাচনসহ বাঙালির মুক্তি ও অধিকার আদায়ে পরিচালিত প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও স্বাধিকার আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দেন। বাঙালির অধিকারের প্রশ্নে কখনও আপস করেননি, ফাঁসির মঞ্চেও গেয়েছেন বাংলা ও বাঙালির জয়গান।
জাতির পিতার চিন্তা-চেতনায় সব সময় কাজ করত বাংলা, বাঙালি ও বাংলাদেশ। তিনি ছিলেন এ দেশের স্থপতি। তার অসামান্য অবদানের জন্য আজ এ দেশের মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ এক ও অভিন্ন সত্তায় পরিণত হয়েছে। ঘাতকচক্র জাতির পিতাকে হত্যা করলেও তার নীতি ও আদর্শকে মুছে ফেলতে পারেনি। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন তার নাম এ দেশের লাখো কোটি মানুষের অন্তরে চির অমলিন, অক্ষয় হয়ে থাকবে।
যে অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা বলে গেছেন বঙ্গবন্ধু। যে সোনার বাংলা গড়ার জন্য তিনি জীবন দিয়েছেন, সেই চেতনা ও স্বপ্নকে বুকে ধারণ করেই আমাদের এখন ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। বঙ্গবন্ধু কোনো বিশেষ দলের নয়, তিনি এ দেশের সব মানুষের, সব বাঙালির। এই চেতনাকে ছড়িয়ে দিতে হবে সর্বত্র। একাত্তরের মুক্তি সংগ্রামে তিনি যেমন আমাদের ঐক্যের প্রতীক ছিলেন, এখনও দেশকে এগিয়ে নিতে, সোনার বাংলা গড়তে তাকে আমরা সেভাবেই বুকে ধারণ করতে পারি। ঐক্যবদ্ধ হতে পারি।
১৯৬২-৬৩ সালে আমি যখন কলেজে পড়ি তখন থেকে বঙ্গবন্ধুকে চিনতে শুরু করি। আর ‘৬৪ সালে তো তার সঙ্গে আমার দেখাই হয়। পরিচয়ের পর আস্তে আস্তে ঘনিষ্ঠতাও বাড়ে। এমন সময় গেছে, যখন কিছুদিন পরপর বঙ্গবন্ধুকে না দেখলে অস্থির হয়ে পড়তাম। কিশোরগঞ্জ থেকে ছুটে আসতাম ঢাকায়। এ বিষয়ে আমি বিস্তারিত বলেছি গত বছর ১৫ আগস্ট সমকালে প্রকাশিত এক লেখায়। এ জন্য আজকে আর এ ব্যাপারে বিশেষ আলোকপাত করব না।
খুব কাছ থেকে দেখেছি, মানুষের সঙ্গে মিশতে পারার যে অসম্ভব গুণ ছিল বঙ্গবন্ধুর ভেতরে, সেটাই তাকে পরিণত করেছিল বাঙালির মহান নেতায়। ‘আমি তোমাদেরই লোক’- জনগণের ব্যাপারে তিনি সব সময়ই বুকে ধারণ করতেন এই আপ্তবাক্য। এই চেতনাই তাকে পৌছে দেয় অনন্য উচ্চতায়। পরিণত করে বঙ্গবন্ধুতে, অতঃপর জাতির পিতায়।
হাওর বার্তার নির্বাহী সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি অনুরোধ জানিয়েছেন, আমি যেন স্মৃতি থেকে পার্লামেন্টারিয়ান বঙ্গবন্ধুর ব্যাপারে কিছুটা আলোকপাত করি। আমরা জানি, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের সময় প্রথম পার্লামেন্টে যান বঙ্গবন্ধু। তখন তো আমি একেবারেই ছোট। ১৯৭০ সালে সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যখন এমএনএ নির্বাচিত হলাম, তখনও আমরা পার্লামেন্টে বসতে পারিনি। সুযোগটি এলো দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে। তখন সংবিধান তৈরির নয় মাস আমরা একসঙ্গে গণপরিষদে ছিলাম। নিতান্ত নবীন সদস্য হিসেবে বয়োজ্যেষ্ঠ এবং অভিজ্ঞদের কর্মকাণ্ড খুব আগ্রহভরেই তখন প্রত্যক্ষ করতাম। পার্লামেন্টারিয়ান বঙ্গবন্ধু তখন ছিলেন আমার আগ্রহের একেবারেই কেন্দ্রে।
গণপরিষদে ওই অর্থে কোনো বিরোধী দল না থাকলেও বিরোধী পক্ষের দু-একজন সদস্য তো ছিলেনই। আমার স্পষ্ট মনে আছে, ন্যাপ থেকে নির্বাচিত তৎকালীন গণপরিষদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কথা। পার্লামেন্টে বক্তৃতা করার সুযোগ চাইলে সব সময়ই তিনি সুযোগ পেতেন। স্পিকার মাঝে মাঝে তাকে মাইক দিতে না চাইলে বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘ওকে সুযোগ দেন, বিরোধী পক্ষের কথা আগে শুনতে হবে।’
লক্ষ্য করেছি, পার্লামেন্টে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে স্পিকার বিব্রত হতেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধু হতেন না। উদার না হলে, গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন না হলে এটা ভাবাই যেত না।
১৯৭৩ সালের পার্লামেন্টে আতাউর রহমান খান, এমএন লারমাসহ বিরোধী দলের কয়েকজন এমপি ছিলেন। তখনও দেখেছি, তারা কথা বলতে চাইলেই সুযোগ পেতেন। প্রায় সময় বঙ্গবন্ধুই স্পিকারকে বলে সে সুযোগ করে দিতেন। বিরোধী দলের প্রতি বঙ্গবন্ধুর আলাদা একটা মনোযোগ ছিল বলেই এটা সম্ভব হয়েছিল।
আইয়ুব-ইয়াহিয়াবিরোধী আন্দোলনের অগ্নিপুরুষ বঙ্গবন্ধুকে নিজের দেশের রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সব সময়ই দেখেছি মার্জিতভাবে কথা বলতে। সবুর খান, শাহ আজিজুর রহমান- এদের সম্পর্কে বলতে গিয়েও কোনো সময় তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেননি। বঙ্গবন্ধুর এই যে ভদ্রতা, এই যে শিষ্টাচারের সংস্কৃতি এটা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। তার ঘনিষ্ঠ না হলে সেটা হয়তো সম্ভব হতো না। আমি সব সময়ই বলি, বঙ্গবন্ধুই আমার রাজনৈতিক গুরু; যা শিখেছি তার কাছ থেকেই শিখেছি। সেই শিক্ষাগুলোই পরে প্রয়োগ করেছি নিজের রাজনৈতিক জীবনে।
আমি নিজে জাতীয় সংসদের স্পিকার থাকা অবস্থায় বিরোধী দলকে যে সুযোগ দিতাম সেটাও আসলে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকেই শেখা। কোনো সময়ই বিরোধী দল আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করেনি। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া যখনই পার্লামেন্টে দাঁড়িয়েছেন, তখনই তাকে মাইক দিয়েছি। একবার তো তিনি প্রায় দুই ঘণ্টা বক্তৃতা করলেন। আমি বিরোধী দলকে বেশি সময় দিই- সরকারি দল বরং আমার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ করত।
গণতন্ত্রের মূল শিক্ষা হলো সবাইকেই ছাড় দিতে হয়। অতীতে কে কী খারাপ করেছে, সেই আলোচনার চেয়ে ভবিষ্যতে কে কী ভালো করবে রাজনীতিতে, সেই আলোচনা যদি আমরা শুরু করতে পারি তাহলে দেশের উন্নতি হতে বাধ্য। রাজনৈতিক দলগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে বাস্তবতার নিরিখে খোলা মন নিয়ে। সরকার আসবে-যাবে, কিন্তু কিছু বিষয়ে আমাদের ঐকমত্য থাকলে দেশে আর কোনো সমস্যাই থাকবে না। সবার ওপরে রাখতে হবে দেশটাকেই।
বঙ্গবন্ধু তার দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জাতিকে এক করেছিলেন, বাঙালিকে একটি স্বাধীন ভূখণ্ড দিয়েছিলেন। তিনি সব সময় গণতন্ত্রের কথা ভাবতেন, পুরোমাত্রায় বিশ্বাসী ছিলেন সংসদীয় গণতন্ত্রে। প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে বাকশাল করেছিলেন কেন। আসলে সেটাও করেছিলেন পরিস্থিতি সামাল দিতে। বলেছিলেন, দেশ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরলে আবার সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরবেন। আমি একজনের বিরুদ্ধে বললে অন্যজনও আমার বিরুদ্ধে বলবে- এ বিশ্বাস তার ভেতরে পুরোমাত্রায় ছিল। তিনি বলতেন, গণতন্ত্রে দল থাকবে কিন্তু আমাদেরকে দলে অন্ধ হলে চলবে না। আমাদেরকে অন্ধ হতে হবে দেশের প্রতি, দেশের স্বার্থে।
বঙ্গবন্ধু কোনো দলের নয়, সবার- এটা আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে। যারা তাকে মানতে চায়নি, তারা বাংলাদেশকেও মানতে পারেনি। তাদের সংখ্যা কিন্তু একেবারে কম নয়। একাত্তরের পরাজিত শক্তিই পঁচাত্তরে জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করে দেশকে পেছনের দিকে ঘুরিয়ে দিতে চেয়েছে। সেই জায়গা থেকে আমরা আবার ফিরেছি প্রগতির পথে। আমরা এখন মধ্যম আয়ের দেশ। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, আরও এগিয়ে যাব। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই আমাদের অগ্রযাত্রায় মূল শক্তি। এটাকে আমরা যত ছড়িয়ে দিতে পারব, ততই আমাদের বিভাজন কমবে।
রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে সারাজীবন সংগ্রাম করে গেছেন বঙ্গবন্ধু। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত ‘সোনার বাংলা’ প্রতিষ্ঠাই ছিল তার স্বপ্ন। আমাদের দায়িত্ব হবে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে একটি সুখী ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ে তোলা। তাহলেই আমরা চিরঞ্জীব এই মহান নেতার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে পারব।
বাংলাদেশ আজ উন্নয়ন ও অগ্রগতির মহাসড়কে ধাবমান। ধারাবাহিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নসহ আর্থ-সামাজিক প্রতিটি সূচকে এ দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। একদিন এই দেশ উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হবেই। এ জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত প্রয়াস। আসুন, আমরা জাতির পিতাকে হারানোর শোককে শক্তিতে রূপান্তর করি এবং সবাই মিলে তার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে আত্মনিয়োগ করি।
মো. আবদুল হামিদ, রাষ্ট্রপতি, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ