রাষ্ট্র যখন আইনবহির্ভূত হত্যার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে, রাজনীতির মানে যখন সহিংসতা কিংবা বলের শাসন, ধর্মের নামে যখন অন্যের প্রাণ সংহারকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা জারি থাকে, অসহিষ্ণুতা যখন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ে, আইনের শাসন যখন অপসৃত, তখন কেবল শিশুহত্যার বিষয়ে আলাদা করে উদ্বিগ্ন হওয়া যথেষ্ট কি না, সেটা ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে।
শিশুহত্যা কি অন্য হত্যা থেকে আলাদা?
কিছুদিন ধরে আমরা সবাই শিশুদের নিয়ে উদ্বিগ্ন আছি। আমাদের উদ্বেগ দেখলে মনে হতে পারে যেন হঠাৎ করেই শিশু নির্যাতন বেড়েছে। প্রতিদিন আমরা কোনো না কোনোভাবে জানতে পারছি আরও একটি শিশু অমানবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। প্রতিটি হত্যার ঘটনা আগের ঘটনার চেয়েও ভয়াবহ, আরও বেশি মর্মান্তিক। প্রতিবার গা শিউরানো এসব ঘটনা দেখে মনে হচ্ছে এত অমানবিক মানুষ কী করে হয়? এতটা পৈশাচিকতা আমাদের চারপাশে কেমন করে বিরাজ করে?
কিন্তু বাস্তব ঘটনা কি আসলেই তাই? শিশুহত্যার ঘটনার তথ্যগুলো আমাদের জানা থাকার কথা। যাঁরা জানেন তাঁদের জন্য স্বাভাবিক হচ্ছে এসব ঘটনাকে অনেক ঘটনার অংশ হিসেবেই বিবেচনা করা। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সারা দেশে ৬৯ জন শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে গত জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত ১৩ জনকে নৃশংস কায়দায় হত্যা করা হয়েছে। ২০১২ সালে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ১২৬টি, ২০১৩ সালে ১২৮টি, ২০১৪ সালে ১২৭টি। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএএফ) তথ্যমতে, ২০১২ সালে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় ২০৯ শিশু। এ সময় হত্যার চেষ্টা করা হয় আরও পাঁচজনকে। ২০১৩ সালে হত্যা করা হয় ২১৮ শিশুকে এবং হত্যার চেষ্টা করা হয় ১৮ শিশুকে। ২০১৪ সালে দেশে ৩৫০ শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। এ সময় আরও ১৩ শিশুকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। আর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত হত্যা করা হয়েছে ১৯১ শিশুকে। এ সময় হত্যার চেষ্টা করা হয় আরও ১১ শিশুকে।
শিশু ধর্ষণ, অপহরণ, অপহরণের পরে হত্যার আরও ঘটনা ঘটেছে। সেগুলোর পরিসংখ্যানও সহজেই পাওয়া যায়। এগুলোকে আমরা পরিসংখ্যান বলেই বিবেচনা করি, এর বেশি নয়। ফলে খুব নাটকীয় কিছু না ঘটলে, উপর্যুপরি ঘটনা না ঘটলে আমরা উদ্বিগ্ন হওয়ার তাগিদ বোধ করি না। এগুলো মনে হয় আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। সমাজের যে অংশের উদ্বেগ-আশঙ্কাকে আমরা ধর্তব্যের মধ্যে নিই তাঁরা কেন এই নিয়ে উদ্বিগ্ন হন না, সেটা কি আমাদের বোধগম্য? পরিসংখ্যানের ভারে চাপা পড়া এসব শিশু সমাজের কোন অংশের বাসিন্দা? বুঝতে চাইলে গত কয়েক সপ্তাহের খবরগুলো আবার পাঠ করা যেতে পারে। নাম ধরে নাহয় না-ই বললাম। এরা কাদের সন্তান তাও তো আমরা জানি—‘নিম্নমধ্যবিত্ত দেশের’ দরিদ্রের সন্তান। তাই সব খবর হয় না, হলেও বড়জোর খবর হয় সংবাদপত্রের ভেতরের পাতায়। কিন্তু আমাদের টনক নড়ে না। আমাদের টনক নড়বে কবে তা আমি জানি, আপনিও জানেন। কিন্তু জানা না–জানাটা আসল বিষয় নয়।
সিলেটের কুমারগাঁও এলাকায় শিশু রাজনকে পৈশাচিকভাবে হত্যার পর আমি যে কথাগুলো লিখেছিলাম তার জন্য ব্যবহৃত ছাপার কালি শুকিয়ে যায়নি; তবু বলি, ‘এমন পৈশাচিকতা কি খুব বিরল?’ (প্রথম আলো, ১৪ জুলাই ২০১৫)। তার সঙ্গে আরেকটু যোগ করে প্রশ্ন করতে চাই, এই যে নির্মমতা, এই যে হত্যাকাণ্ড, তাকে কী অন্য সব হত্যাকাণ্ড থেকে আসলেই আলাদা করে দেখা সম্ভব? সমাজে আলাদা করে কেবল শিশুদের নিরাপত্তা কী করে নিশ্চিত হবে, যখন আরও অনেকের জীবনের নিরাপত্তাই প্রশ্নবিদ্ধ? যখন নিরাপত্তার ধারণাই বদলে যেতে শুরু করেছে, সে সময় সমাজের কোনো অংশের জীবনের, নিরাপত্তার অধিকারকে আলাদা করে বহাল রাখার চেষ্টা কত দূর পর্যন্ত যেতে পারবে?
রাষ্ট্র যখন আইনবহির্ভূত হত্যার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে, রাজনীতির মানে যখন সহিংসতা কিংবা বলের শাসন, ধর্মের নামে যখন অন্যের প্রাণ সংহারকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা জারি থাকে, অসহিষ্ণুতা যখন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ে, আইনের শাসন যখন অপসৃত, তখন কেবল শিশুহত্যার বিষয়ে আলাদা করে উদ্বিগ্ন হওয়া যথেষ্ট কি না, সেটা ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। তার অর্থ এই নয় যে আমি এই উদ্বেগ এবং এসব পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের নায়কদের বিচারের দাবিকে অপ্রাসঙ্গিক মনে করি। বরং এসব দাবি তোলা এবং তার জন্য নাগরিকের সক্রিয়তার তাগিদ দিতে চাই। কিন্তু একে যারা বিচ্ছিন্ন বিষয় বলে ভাবেন, তাঁদের সঙ্গে আমার ভিন্নমতটাও জানিয়ে রাখতে চাই। সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলা জরুরি মনে করি, এ ধরনের প্রতিবাদকে কেবল সাময়িক প্রতিক্রিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে তার পরিণতি আগের চেয়ে ভিন্ন কিছু হবে না। শিশুদের ওপরে নির্মমতাকে যদি এই সপ্তাহের বিষয় বলে ভাবি, আগামী সপ্তাহে অন্য কোনো বিষয়ে আমাদের মনোযোগ থাকবে বলেই ধরে নিই, তবে এই পরিসংখ্যান আরও বড় হবে; গত কয়েক বছরে ক্রমবর্ধমান সংখ্যাই তার প্রমাণ।
এসব নির্মম ঘটনাকে কেন্দ্র করে সমাজের ভেতরে যে প্রতিক্রিয়া, তার একটি দিকের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই। অনেকেই বলছেন যে এসব ঘটনার মধ্যে প্রকাশিত হচ্ছে বিরাজমান নৈতিকতার সংকট। আপাতদৃষ্টে এই কথাটির সঙ্গে দ্বিমতের অবকাশ কম। যেকোনো সমাজে যখন এ ধরনের প্রবণতা ছড়িয়ে পড়ে, তখন তার আশু এবং দীর্ঘমেয়াদি কারণ অনুসন্ধান করা অত্যাবশ্যক। কিন্তু বিরাজমান ব্যবস্থার নৈতিকতার অভাবকে যদি একমাত্র কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তখন রাজনৈতিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার ত্রুটির চেয়ে ‘নৈতিকতা’র প্রশ্নটিই প্রাধান্য লাভ করবে। প্রশ্ন উঠবে তার বিকল্প কী? এই ‘নৈতিকভাবে দেউলিয়া ব্যবস্থা’র বিকল্প হিসেবে, বিরাজমান ‘মূল্যবোধের অবক্ষয়’ রোধে যে ব্যবস্থার কথা বলা হবে, তার ভিত্তি ইতিমধ্যেই তৈরি হচ্ছে কি না, সেটাও ভাবা দরকার। আশু স্বার্থ বিবেচনা করে এখন রাজনৈতিক এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিরাজমান সংকটকে মোকাবিলা করতে না চাইলে ভবিষ্যতে এই পরিণামের পথেই দেশকে ঠেলে দেওয়া হবে।