ঢাকা ১১:৫২ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৫ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঐতিহ্য হারাচ্ছে কাঠের দেশীয় বড় ছাতা

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৯:০৩:৩৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ৯ অগাস্ট ২০১৭
  • ৫০৬ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ আমদানিকৃত নিম্নমানের চায়না ছাতার কাছে হেরে যাচ্ছে দেশীয় ঐতিহ্য ক্ষুদ্রশিল্প ছাতা কোম্পানিগুলো। সহজে বহনযোগ্য ও ডিজাইনের কারণে চাহিদা বেশি নিম্নমানের আমদানি করা ছাতার। আর এতে বিলুপ্তির পথে দেশীয় ঐতিহ্য কাঠের ও লোহার হাতলের বড় ছাতা। এ পরিস্থিতিতে বিপাকে দেশীয় ছাতাশিল্পের মালিক ও কারিগররা।

বুধবার সরেজমিনে রাজধানীর কামরাঙ্গীর চর ও চকবাজারের ছাতার ছোট ফ্যাক্টরিগুলো ঘুরে দেখা মিলেছে এমন বাস্তবতার। কামরাঙ্গীর চরে ও পুরান-ঢাকার চকবাজারে নব্বই দশকে ছোট-বড় ছাতার ফ্যাক্টরি ছিল ৭ থেকে ৮টি। এর মধ্যে অন্যতম ছিল চক-বাজারের শরীফ ছাতা, নুরউদ্দিন ছাতা, এটলাস ছাতা ও কামরাঙ্গীর চরে লাবনী ছাতা।

বুধবার সকালে কামরাঙ্গীর চর গিয়ে দেখা যায় লাবনী ছাতার ফ্যাক্টরিটি বন্ধ, স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, বছর পাঁচেক আগ থেকে ফ্যাক্টরিটি বন্ধ। লাবনি ফ্যাক্টরিটির পাশে একটি ছোট ফ্যাক্টরির খোঁজ মেলে স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপকালে।

ছাতার কারিগর আলমগীর (৪৫) একটি ছোট ছাতা ফ্যাক্টরিটির মালিকও। টিনশেডের একটি বাড়িতে তিন রুমের ফ্যাক্টরিটি আলমগীরের পরিবারের সদস্যরাই কারিগর হিসেবে কাজ করে। লাবনি ফ্যাক্টরি বন্ধ হওয়ার পর থেকে আলমগীর ফ্যাক্টরিটি চালু করেন।

আলমগীর চকবাজারের পাইকারদের চাহিদা অনুযায়ী ছাতা তৈরি করেন। বড় ছাতা অর্ডার নেই তাই গত কয়েক বছর চায়না যন্ত্রাংশ দিয়ে চায়না ছাতা তৈরি করছেন এই ছাতা ফ্যাক্টরির মালিক।

কেন বড় ছাতা বিক্রি নেই- জানতে চাইলে আলমগীর হাওর বার্তাকে বলেন, গ্রামে-গঞ্জে বড় ছাতা টুকটাক চলে। কিন্তু শহরে চায়না ছাতা বেশি বিক্রি হয়। সামান্য বাতাসে এই ছাতা ভেঙে যায়। তবুও মানুষ সহজে এ ছাতা বহন করতে পারে। আবার ডিজাইন সুন্দরের কারণে চায়না ছাতা বিক্রি বেশি। তবে আগের ছাতা ছিল মজবুত এখনকার ছাতা ওয়ান টাইম।

লাবনি ছাতার ফ্যাক্টরি বন্ধের কারণে বর্তমানে কারিগররা কি করছে জানতে চাইলে আলমগীর বলেন, অনেকেই গ্রামে গিয়ে কৃষিকাজ করছে। কেউ বিদেশে চলে গেছে। শুধু আমি এই ব্যবসা ধরে পড়ে আছি। তবে দিনদিন এই ব্যবসা শেষের দিকে যাচ্ছে। এই কর্ম শেখা হয়েছে আমার পাপ। আমার ছেলে-মেয়ে আমাকে এ কাজে সাহায্য করে বলে আমি কোনোমতে টিকে আছি।

ছাতা ব্যাবসায় দামের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চায়না ছাতা পাইকারি ১১০ থেকে ১১৫ টাকা দরে বিক্রি করি। প্রতি ডজন ছাতায় ৪০ থেকে ৫০ টাকা লাভ হয়।

এদিকে চকবাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রত্যেক দোকানে দেশীয় বড় ছাতার চেয়ে চায়না ছাতা কয়েকগুণ বেশি রয়েছে। শত শত ছাতার ভিড়ে দেশি ছাতা রয়েছে বিশ/পঁচিশটি। গ্রামের কিছু পাইকাররা বড় ছাতা মাঝে মাঝে নেয় বলে জানা যায়।

চকবাজার লতিফ মার্কেটের শরিফ ছাতা শো-রুমে কথা হয় ম্যানেজার আ. মতিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, চায়না মাল বেশি চলে। আমাদের এক সময়ের শরিফ ছাতার বাজার ছিল সর্বোচ্চ স্থানে। এখন বেচা-বিক্রি নেই। আগের বড় ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে এখন ছোট কাটারাতে ছোট ফ্যাক্টরি। এখন সিজনে কিছু বিক্রি হলেও অফ-সিজনে আমাদের কোম্পানির শো-রুমে ব্যাগ বিক্রি করে দোকান ভাড়া দেয়ার চেষ্টা করি।

ছোট কাটারা শরিফ ছাতার কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, দুই রুমের ছোট কারখানায় মাত্র ৮ জন কারিগর কাজ করছে। বিক্রি না থাকায় কারিগর কম- এমনটাই জানা যায় কারখানার ম্যানেজার বাবুর সঙ্গে আলাপকালে। বাবু নতুন সময়কে বলেন, বৃষ্টি-বাদলের সিজন হলেও নিম্নমানের চায়না ছাতার কাছে মার খাচ্ছে দেশীয় ছাতাশিল্প। অথচ এসব ছাতা অত্যান্ত টেকশই।

কেমন উৎপাদন জানতে চাইলে ম্যানেজার বলেন, বিক্রি না থাকলে প্রোডাকশন করে কি লাভ? এ বছর গত বছরগুলোর থেকে বিক্রি অর্ধেকে নেমে এসেছে। কারণ চায়না ছাতায় বাজার সয়লাব। অথচ মাত্র ১১৫ টাকায় দেশীয় ছাতা পাঁচ বছর নিশ্চিন্তে ব্যবহার করা যাবে।

কথা হয় ত্রিশ বছরের পুরানো ছাতার কারিগর রবিউলের (৫৭) সঙ্গে। তিনি বলেন, আমরা এই কাজ শিখে বিপদে আছি। এই শিল্প এখন বন্ধের পথে। কি করে খাব আমরা? শ্রমিক হিসেবে মাটিকাটা ছাড়া গতি নেই। আমাদের সাথের অন্যান্য কারিগররা গাঁও-গ্রামে হালচাষ করে। কারণ প্রায় সব বড় ছাতা কোম্পানি বন্ধের পথে।

কেমন রোজগার হচ্ছে এখন- জানতে চাইলে রবিউল বলেন, প্রোডাকশনে কাজ করি আমরা। মাল বিক্রি না থাকলে প্রোডাকশনও কম। পুরো মাস কাজ করে ১০/১২ হাজার টাকা থাকে। ছাতার কাজ শিখে বেঁছে নিলাম অভিশপ্ত জীবন।

এক সময় গাঁয়ের মানুষের হাতে হাতে ছিল কাঠ ও লোহার বড় ছাতা। অথচ আধুনিক সমাজে এখন আর নেই ঐতিহ্যের এই ছাতার ব্যবহার। আবার আমদানিকৃত নিম্নমানের ছাতার দাপটে বিলুপ্তির পথে এই দেশীয় ঐতিহ্য।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

ঐতিহ্য হারাচ্ছে কাঠের দেশীয় বড় ছাতা

আপডেট টাইম : ০৯:০৩:৩৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ৯ অগাস্ট ২০১৭

হাওর বার্তা ডেস্কঃ আমদানিকৃত নিম্নমানের চায়না ছাতার কাছে হেরে যাচ্ছে দেশীয় ঐতিহ্য ক্ষুদ্রশিল্প ছাতা কোম্পানিগুলো। সহজে বহনযোগ্য ও ডিজাইনের কারণে চাহিদা বেশি নিম্নমানের আমদানি করা ছাতার। আর এতে বিলুপ্তির পথে দেশীয় ঐতিহ্য কাঠের ও লোহার হাতলের বড় ছাতা। এ পরিস্থিতিতে বিপাকে দেশীয় ছাতাশিল্পের মালিক ও কারিগররা।

বুধবার সরেজমিনে রাজধানীর কামরাঙ্গীর চর ও চকবাজারের ছাতার ছোট ফ্যাক্টরিগুলো ঘুরে দেখা মিলেছে এমন বাস্তবতার। কামরাঙ্গীর চরে ও পুরান-ঢাকার চকবাজারে নব্বই দশকে ছোট-বড় ছাতার ফ্যাক্টরি ছিল ৭ থেকে ৮টি। এর মধ্যে অন্যতম ছিল চক-বাজারের শরীফ ছাতা, নুরউদ্দিন ছাতা, এটলাস ছাতা ও কামরাঙ্গীর চরে লাবনী ছাতা।

বুধবার সকালে কামরাঙ্গীর চর গিয়ে দেখা যায় লাবনী ছাতার ফ্যাক্টরিটি বন্ধ, স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, বছর পাঁচেক আগ থেকে ফ্যাক্টরিটি বন্ধ। লাবনি ফ্যাক্টরিটির পাশে একটি ছোট ফ্যাক্টরির খোঁজ মেলে স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপকালে।

ছাতার কারিগর আলমগীর (৪৫) একটি ছোট ছাতা ফ্যাক্টরিটির মালিকও। টিনশেডের একটি বাড়িতে তিন রুমের ফ্যাক্টরিটি আলমগীরের পরিবারের সদস্যরাই কারিগর হিসেবে কাজ করে। লাবনি ফ্যাক্টরি বন্ধ হওয়ার পর থেকে আলমগীর ফ্যাক্টরিটি চালু করেন।

আলমগীর চকবাজারের পাইকারদের চাহিদা অনুযায়ী ছাতা তৈরি করেন। বড় ছাতা অর্ডার নেই তাই গত কয়েক বছর চায়না যন্ত্রাংশ দিয়ে চায়না ছাতা তৈরি করছেন এই ছাতা ফ্যাক্টরির মালিক।

কেন বড় ছাতা বিক্রি নেই- জানতে চাইলে আলমগীর হাওর বার্তাকে বলেন, গ্রামে-গঞ্জে বড় ছাতা টুকটাক চলে। কিন্তু শহরে চায়না ছাতা বেশি বিক্রি হয়। সামান্য বাতাসে এই ছাতা ভেঙে যায়। তবুও মানুষ সহজে এ ছাতা বহন করতে পারে। আবার ডিজাইন সুন্দরের কারণে চায়না ছাতা বিক্রি বেশি। তবে আগের ছাতা ছিল মজবুত এখনকার ছাতা ওয়ান টাইম।

লাবনি ছাতার ফ্যাক্টরি বন্ধের কারণে বর্তমানে কারিগররা কি করছে জানতে চাইলে আলমগীর বলেন, অনেকেই গ্রামে গিয়ে কৃষিকাজ করছে। কেউ বিদেশে চলে গেছে। শুধু আমি এই ব্যবসা ধরে পড়ে আছি। তবে দিনদিন এই ব্যবসা শেষের দিকে যাচ্ছে। এই কর্ম শেখা হয়েছে আমার পাপ। আমার ছেলে-মেয়ে আমাকে এ কাজে সাহায্য করে বলে আমি কোনোমতে টিকে আছি।

ছাতা ব্যাবসায় দামের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চায়না ছাতা পাইকারি ১১০ থেকে ১১৫ টাকা দরে বিক্রি করি। প্রতি ডজন ছাতায় ৪০ থেকে ৫০ টাকা লাভ হয়।

এদিকে চকবাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রত্যেক দোকানে দেশীয় বড় ছাতার চেয়ে চায়না ছাতা কয়েকগুণ বেশি রয়েছে। শত শত ছাতার ভিড়ে দেশি ছাতা রয়েছে বিশ/পঁচিশটি। গ্রামের কিছু পাইকাররা বড় ছাতা মাঝে মাঝে নেয় বলে জানা যায়।

চকবাজার লতিফ মার্কেটের শরিফ ছাতা শো-রুমে কথা হয় ম্যানেজার আ. মতিনের সঙ্গে। তিনি বলেন, চায়না মাল বেশি চলে। আমাদের এক সময়ের শরিফ ছাতার বাজার ছিল সর্বোচ্চ স্থানে। এখন বেচা-বিক্রি নেই। আগের বড় ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে এখন ছোট কাটারাতে ছোট ফ্যাক্টরি। এখন সিজনে কিছু বিক্রি হলেও অফ-সিজনে আমাদের কোম্পানির শো-রুমে ব্যাগ বিক্রি করে দোকান ভাড়া দেয়ার চেষ্টা করি।

ছোট কাটারা শরিফ ছাতার কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, দুই রুমের ছোট কারখানায় মাত্র ৮ জন কারিগর কাজ করছে। বিক্রি না থাকায় কারিগর কম- এমনটাই জানা যায় কারখানার ম্যানেজার বাবুর সঙ্গে আলাপকালে। বাবু নতুন সময়কে বলেন, বৃষ্টি-বাদলের সিজন হলেও নিম্নমানের চায়না ছাতার কাছে মার খাচ্ছে দেশীয় ছাতাশিল্প। অথচ এসব ছাতা অত্যান্ত টেকশই।

কেমন উৎপাদন জানতে চাইলে ম্যানেজার বলেন, বিক্রি না থাকলে প্রোডাকশন করে কি লাভ? এ বছর গত বছরগুলোর থেকে বিক্রি অর্ধেকে নেমে এসেছে। কারণ চায়না ছাতায় বাজার সয়লাব। অথচ মাত্র ১১৫ টাকায় দেশীয় ছাতা পাঁচ বছর নিশ্চিন্তে ব্যবহার করা যাবে।

কথা হয় ত্রিশ বছরের পুরানো ছাতার কারিগর রবিউলের (৫৭) সঙ্গে। তিনি বলেন, আমরা এই কাজ শিখে বিপদে আছি। এই শিল্প এখন বন্ধের পথে। কি করে খাব আমরা? শ্রমিক হিসেবে মাটিকাটা ছাড়া গতি নেই। আমাদের সাথের অন্যান্য কারিগররা গাঁও-গ্রামে হালচাষ করে। কারণ প্রায় সব বড় ছাতা কোম্পানি বন্ধের পথে।

কেমন রোজগার হচ্ছে এখন- জানতে চাইলে রবিউল বলেন, প্রোডাকশনে কাজ করি আমরা। মাল বিক্রি না থাকলে প্রোডাকশনও কম। পুরো মাস কাজ করে ১০/১২ হাজার টাকা থাকে। ছাতার কাজ শিখে বেঁছে নিলাম অভিশপ্ত জীবন।

এক সময় গাঁয়ের মানুষের হাতে হাতে ছিল কাঠ ও লোহার বড় ছাতা। অথচ আধুনিক সমাজে এখন আর নেই ঐতিহ্যের এই ছাতার ব্যবহার। আবার আমদানিকৃত নিম্নমানের ছাতার দাপটে বিলুপ্তির পথে এই দেশীয় ঐতিহ্য।