মানুষের কত রকমেরই না স্বপ্ন থাকে। আর সে স্বপ্নের রূপ দিতে মানুষের চেষ্টা-সাধনারও যেন শেষ নেই। যেখানে দারিদ্র্যও হার মানে অদম্য ইচ্ছার কাছে।
ঠিক এমনই এক স্বপ্ন পূরণে চরম দারিদ্র্যকে হার মানিয়ে কঠোর পরিশ্রম আর অধ্যবসায়ে কাক্সিক্ষত স্বপ্নকে বাস্তব রূপ দিয়েছেন হতদরিদ্র কাঠমিস্ত্রি আতিক হাসান হৃদয়। দারিদ্র্যের কশাঘাতের মধ্যেও যার হৃদয়জুড়ে জায়গা করে নিয়েছে বঙ্গবন্ধুর প্রতি অসীম শ্রদ্ধা আর ভালবাসা।
সেই শ্রদ্ধা আর ভালবাসা থেকেই মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার দক্ষিণ হিংগাজিয়া গ্রামের মৃত মো. রেনু মিয়া ও আঙ্গুর বেগমের ছেলে আতিক হাসান হৃদয় নিয়েছিলেন এক ব্যতিক্রম উদ্যোগ। দু বোন ও এক ভাইয়ের সংসার চলে অতিকষ্টে, তবুও হাল ছাড়েননি তিনি।
এই দরিদ্র কাঠমিস্ত্রি হৃদয় বাংলাদেশের রূপকার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য উত্তরসুরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উপহার দেওয়ার জন্য তৈরি করেছেন একটি চেয়ার। আর এটি তৈরি করতে লেগেছে তার পাঁচ বছর।
অনন্য নান্দনিক এই চেয়ারটির নকশা, ওজন আর কাঠ ব্যবহারে তিনি এনেছেন নানা বৈচিত্র্য। দৃষ্টিনন্দন এই চেয়ারের উচ্চতা ৭ ফুট ৬ ইঞ্চি আর প্রস্থ ৩ ফুট ১ ইঞ্চি এবং ওজন প্রায় ১০ মন ১০ কেজি। আর্কষণীয় এ চেয়ার তৈরি হয়েছে প্রায় ২০ ফুট সেগুন, কয়েক ফুট মেহগনি আর কয়েক ফুট আকাশি কাঠ দিয়ে।
চেয়ারটি এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিতে অন্তত ৭-৮ জন লোকের প্রয়োজন। প্রতিদিন ২-৩ জন শ্রমিক নিয়ে ২-৩ ঘণ্টা করে কাজ করার পরও এটি তৈরিতে সময় লেগেছে পাঁচ বছর। জাতীয় পতাকা, জাতীয় ফুল, নৌকা, হাতির শূঁড় আর নানা প্রকারের ফুল ঠাঁই পেয়েছে রাজকীয় এই চেয়াররের কারুকাজে। এখন চলছে চূড়ান্ত ঘষামাজা আর রঙের কাজ। কয়েকদিনের মধ্যেই চেয়ার সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে যাবে।
এত কষ্ট সাধনার পরও কারিগর হৃদয়ের মনের কোণে আশঙ্কা, যার প্রতি এত শ্রদ্ধা, ভালবাসা আর আবেগ নিয়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে এ চেয়ার তৈরি করেছেন সেই কাক্সিক্ষত প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে তা আদৌ উপহার দিতে পারবেন কি না?
তারপরও আতিক হাসান হৃদয় (২৮) বুক ভরা স্বপ্ন আর প্রত্যাশা নিয়ে আশায় আছেন চোখ ধাঁধানো চেয়ারটিকে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে উপহার দেবেনই। যদিও কীভাবে এই উপহার প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছাবেন তা তার জানা নেই। আর যদি প্রধানমন্ত্রী চেয়ারটি গ্রহণ না করেন তা হলে তার দীর্ঘ স্বপ্ন, প্রত্যাশা আর শ্রম পণ্ডশ্রমে পরিণত হবে, এমন দুশ্চিন্তাও রয়েছে তার মনে।
চেয়ারের কারুকাজে মুগ্ধ হয়ে অনেকেই দাম দিয়ে নিতে চাচ্ছেন। এ পর্যন্ত প্রায় ২ লাখ টাকা দাম উঠেছে এ চেয়ারের। অনেকেই নানা প্রলোভনে চেয়ারটি কিনতে চাচ্ছেন। কিন্তু কোন প্রলোভন তাকে কাবু করতে পারছে না। প্রধানমন্ত্রীর সম্মানার্থে কাউকে বসতেও দিচ্ছেন না চেয়ারটিতে। তার এক কথা, এটা শুধুই বঙ্গবন্ধুকন্যার জন্য তৈরি।
জানান, প্রায় ১৮ বছর থেকে কাঠমিস্ত্রি পেশার সঙ্গে জড়িত। ছোটবেলা থেকেই তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মনেপ্রাণে ভালোবাসেন। তিনি বলেন, তার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন তার প্রিয় নেতার কন্যাকে তার পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোন উপহার নিজ হাতে তৈরি করে তাকে দিবেন। আর এই ভাবনা থেকেই তার এই দৃষ্টিনন্দন চেয়ার তৈরি।
তিনি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার এ নগণ্য উপহার গ্রহণ করে একটিবার চেয়ারটিতে বসলে তার জীবন ধন্য হয়ে যাবে। তার এখন একটাই চিন্তা, কীভাবে এ চেয়ার প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছাবেন। তিনি অনেকটা কান্নাজড়িত কণ্ঠে আকুতি জানান, ভাই অনেক স্বপ্ন নিয়ে উপহারটি তৈরি করেছি। আমি উপহারটি আমার প্রিয় নেতার পরিবারকে দিতে চাই, এই বিষয়টি আপনাদের লেখনীর মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে খবরটা পৌঁছান।
আতিক আরও জানান, এর আগে তিনি পরীক্ষামূলকভাবে একটি চেয়ার তৈরি করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়ার জন্য কিন্তু সেটি তার মনমতো না হওয়ায় তা বিক্রি করে দেন। এক লাখ টাকা দিয়ে তা কিনে নেন সিলেটের বিশিষ্ট শিল্পপতি আলহাজ রাগীব আলী।
পরবর্তীতে আতিক টুঙ্গিপাড়া, জাতীয় জাদুঘরসহ নানা স্থানে ঘুরেছেন চেয়ারের নকশার ধারণা নিতে। এরপর বাড়িতে ফিরে কারিতাস থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে কাঠ সংগ্রহ করে কাজ শুরু করেন। কাজটি শেষ করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত রাত জেগে তাকে কাজ করতে হয়েছে। কারণ দিনের বেলা তাকে কারখানায় কাজ করতে হয়। কারখানায় কাজ করে যে পারিশ্রমিক পান তা দিয়েই চলে তার অভাব-অনটনের সংসার। তিনি জানান, চেয়ারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে গিয়ে অনেকদিন না খেয়েও থাকতে হয়েছে তাকে।
এ বিষয়ে কুলাউড়া উপজেলা চেয়ারম্যান, আওয়ামী লীগ নেতা আ স ম কামরুল ইসলাম, কাদিপুর ইউপি চেয়ারম্যান ও অধ্যক্ষ এ কে এম শফি আহমদ সলমান জানান, বঙ্গবন্ধু পাগল এ ছেলেটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে উপহার দেওয়ার জন্য বিগত পাঁচ বছর থেকে নানা অভাব-অনটনের মধ্যেও চেয়ারটি বানিয়ে যে ভালোবাসার নজির দেখিয়েছেন, তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।
কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাজমুল হাসান জানান, তিনি এখনও চেয়ারটি দেখেননি। তিনি চেয়ারটি দেখে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।