হাওর বার্তা ডেস্কঃ সোনালি আঁশের রঙিন স্বপ্নে বিভোর হাজারো কৃষক। এদেরই একজন ইজাবত আলী। বয়স ৫৫ বছরের কাছাকাছি। থাকেন পাবনার চাটমোহর উপজেলার ডিবিগ্রামে। চোখে-মুখে তার স্বপ্ন। ন্যায্য দামে পাট বিক্রি করে সংসারের চাকা সচল রাখার পাশাপাশি ছেলে-মেয়ের পড়ালেখার খরচ যোগাবেন তিনি। তাই প্রতিমণ পাট দুই হাজার টাকা দরে বিক্রির আশা তার। এ বছর তিন বিঘা জমিতে পাটচাষ করেছেন তিনি।
ইজাবত আলীর শত সহস্র স্বপ্ন রয়েছে সোনালি আঁশকে ঘিরে। যদিও কৃষকদের ন্যায্য দামে পাট বিক্রির দাবির চেয়ে বাজার দরে বেশ পার্থক্য রয়েছে। আঁশের মান ও রঙ অনুযায়ী বর্তমানে প্রতিমণ পাট এক হাজার ৫০০ থেকে এক হাজার ৭০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। কৃষকদের আশংকা, দাম আরও কমে যেতে পারে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এ বছর পাবনা জেলায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে পাটের আবাদ বেশি হয়েছে। পাশাপাশি অনুকূল আবহাওয়া থাকায় পাটের ফলনও ভালো হয়েছে। ভালো দাম পাওয়ায় কৃষক পাট চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।
পাবনা জেলা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিভূতি ভূষণ সরকার হাওর বার্তাকে জানান, এ বছর পাবনা জেলার মোট ৩৮ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে উৎপাদন লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু আবাদ হয়েছে প্রায় ৪৫ হাজার ৭৫ হেক্টর জমিতে। ২০১৬ সালে আবাদ হয়েছিল ৪২ হাজার হেক্টর জমিতে। ২০১৫ সালে আবাদের পরিমাণ ছিল ৩৮ হাজার ১৫ হেক্টর জমি। এবার চাটমোহর উপজেলায় সাত হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে।
চাটমোহর উপজেলার পাট চাষিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, এক বিঘা জমি চাষ, বীজ, সার, কীটনাশক ক্রয়, পরিচর্যা, পঁচানি দিতে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গা নেয়ার পরিবহন খরচ থেকে শুরু করে পাট ছাড়ানো ও রোদে শুকিয়ে ঘরে তোলা পর্যন্ত প্রায় ১৬ থেকে ১৮ হাজার টাকা ব্যয় হবে। এর মধ্যে পাট কাটতে এবং জাগ দেয়ার জন্য নদীতে পৌঁছাতে পরিবহনসহ বিঘা প্রতি ১০ হাজার টাকা লাগছে।
পাটের উৎপাদন ভালো হওয়ায় হাসি ফুটেছে কৃষকের মুখে। সোনালি আঁশে রঙিন স্বপ্ন দেখছেন তারা। এখন ন্যায্য দামের নিশ্চয়তা চায় কৃষকেরা। পাটের ন্যায্য মূল্য না পেলে পাট চাষিদের আর্থিকভাবে লোকসান গুনতে হবে।
উপজেলার কামালপুর গ্রামের কৃষক সাজেদুর রহমান হাওর বার্তাকে জানান, এখন পাটকাটা ও জাগ দেয়া শুরু হয়েছে পুরোদমে। মাঠ-ঘাট, গ্রামীণ পথ থেকে শুরু করে সর্বত্রই এখন সোনালি আঁশের গন্ধ; পাট প্রস্তুত করার ব্যস্ততা। তবে, পাটকাটা, জাগ ও আঁশ ছাড়ানোর জন্য শ্রমিক পাওয়া কিছুটা কষ্টকর হয়েছে। বর্তমানে দিনপ্রতি ৫০০ টাকা দরে শ্রমিকের মূল্য দিতে হচ্ছে। গ্রামের নারীরা পাট ছাড়িয়ে পাট কাঠি নেয়ার চুক্তিতে কাজ করছেন। এতে পাটের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। একজন শ্রমিক দিনে সর্বোচ্চ নয় শতক জমির পাট কাটতে পারে। তবে, ক্ষেত থেকে বাড়িতে আনা বা জাগ দেয়া সম্ভব হয় না। আর পাটের আঁশ ছাড়ানো, পানিতে ধুয়ে পরিচ্ছন্ন করা এবং শুকানোর জন্য আলাদা শ্রমিক প্রয়োজন হয়।
চাটমোহরের আলমনগর গ্রামের আবু বক্কার হাওর বার্তাকে বলেন, এ বছর পাটের ফলন খুব ভালো হয়েছে। দাম ভালো পেলে আমাদের কোনো ক্ষতি হবে না। মল্লিকবাইন গ্রামের আব্দুর কাদের হাওর বার্তাকে বলেন, আমাদের দাবি প্রতিমণ পাটের দাম দুই হাজার টাকা। একই গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম জানান, প্রতিমণ পাট দুই হাজার টাকা দরে বিক্রি করতে পারলে কৃষকেরা চাষাবাদে আরও উৎসাহ পাবেন।
এ বছর তিন বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছেন ছাইকোলা গ্রামের আব্দুল গণি। ফলনও ভালো হয়েছে। তিনি ন্যায্যমূল্যর প্রত্যাশা করছেন।
চাটমোহরের সহকারী কৃষি কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান হাওর বার্তাকে বললেন, প্রতিমণ পাটের দাম কমপক্ষে দুই হাজার টাকা হলে কৃষক বেঁচে থাকতে পারবেন। তা না হলে দিনে দিনে কৃষক পাট চাষে উৎসাহ হারাবেন। তিনি বলেন, এ বছর পাটের উৎপাদন ভালো হওয়ায় কৃষক খুশি হয়েছেন। তবে,বাজার দরটা হঠাৎ করে যেন নিম্নমুখী না হয়; সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ দরকার।
পাট ব্যবসায়ী মহরম হোসেন হাওর বার্তাকে বলেন, বতর্মানে প্রতিমণ পাট এক হাজার ৬০০ টাকা দরে কেনা হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে দাম কমতেও পারে, আবার বাড়তেও পারে। সরকার নাকি ১৮০০ টাকা দর নির্ধারণ করেছে।
পাট ব্যবসায়ী মোতালেব হোসেন জানান, হাট-বাজারে পাটের আমদানি বেশি হলে দাম কমে যেতে পারে। হাট-বাজারে পাটের আমদানি বেড়ে গেলে পাইকারি ব্যবসায়ীরা দাম কমিয়ে দেন। তাই স্থানীয় ব্যবসায়ীরা কৃষকদের কাছ থেকে কম দামে পাট কিনতে বাধ্য হন। এক্ষেত্রে দাম নির্ধারণসহ দরপতন রোধে সরকারি হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
এদিকে, পাট বিক্রির পাশাপাশি পাট কাঠিরও কদর রয়েছে। পাটকাঠি দিয়ে জ্বালানির পাশাপাশি গোবরের লাকড়ি তৈরি করছেন নারীরা। এছাড়া ঘরের বেড়া,তরকারির মাঁচাসহ পানের বরজে পাটকাঠি ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে পাটকাঠি পোড়ানো ছাই বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। বর্তমানে একশ’ আঁটি পাট কাঠি ২০০’ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এ বছর ভালো দামের প্রত্যাশা করছেন কৃষক।
চাটমোহর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ রওশন আলম হাওর বার্তাকে বলেন, এ উপজেলার মাটি ও আবহাওয়া পাট চাষের উপযোগী। পাট পচনের (জাগ) ক্ষেত্রেও রয়েছে অনেক ডোবা, নালা, খাল, বিল ও জলাশয়। এ বছর আগাম বৃষ্টি হওয়ায় পাট পচনের ক্ষেত্রে পানির কোনো সমস্যা দেখা যায়নি। এছাড়া ফলন যেমন ভালো হয়েছে, তেমনি কৃষকেরা দামও ভালো পাবেন বলে আশা করছি।
পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিভুতি ভূষণ সরকার হাওর বার্তাকে বলেন, পাবনায় কাঁচা পাট ও পাট খড়ি প্রক্রিয়াজাতের নতুন নতুন কারখানা তৈরি হয়েছে। এতে বিপনন সহজ হচ্ছে। পাটের নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।