দেশে ষষ্ঠ উপজেলা নির্বাচন চলছে। চার ধাপে ৪৯৫টি উপজেলায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। গত ৮ মে প্রথম ধাপে ১৩৯টি উপজেলায় ভোট হয়েছে। এবারের উপজেলা নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে সরকারি দলের মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনদের নির্বাচনে যোগ দেওয়া, না দেওয়া নিয়ে। অথচ এ নির্বাচনে আলোচনা হতে পারত স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়ন, স্থানীয় রাজনীতির গতিপ্রকৃতি, স্থানীয় উন্নয়ন ইত্যাদি নানা বিষয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ তথা এককেন্দ্রিক সরকারব্যবস্থা স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকেও গিলে খেয়েছে। অথচ প্রকৃত জনপ্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হলে স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতেই হবে।
আগে উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীরা ভোট চাইতে ইউনিয়নে ইউনিয়নে ঘুরে বেড়াতেন। এখন আর সেদিন নেই। ভোটে জয়ী হওয়ার জন্য প্রার্থীদের ব্যক্তিগত ইমেজ আজ গুরুত্বপূর্ণ নয়। ব্যক্তিগত ইমেজ, জনপ্রিয়তা, এলাকার উন্নয়ন প্রতিশ্রুতি ইত্যাদি দিয়ে ভোটারদের মনজয় করার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। যেভাবেই হোক দলীয় মনোনয়ন পাওয়াটাই বড় কথা। দলের টিকিট পেলে স্থানীয় নেতৃত্ব ও পুলিশ প্রশাসনকে একটু সামলে নিতে পারলেই নির্বাচনি বৈতরণী পার হওয়া যায়। নির্বাচনে ভোটারদের গুরুত্ব আজ নেই বললেই চলে। এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ সম্প্রতি একটি পত্রিকাকে বলেছেন, ‘উপজেলা পরিষদে এখন যে ধরনের নির্বাচন হতে যাচ্ছে তা নিয়ে মূল্যায়ন বা বিশ্লেষণের কিছুই নেই। এখানে সত্যিকারের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও কোনো আগ্রহ নেই। এখানে চলছে মূলত টাকার খেলা। টাকার বিনিময়েই অনেকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে যান। আর এর ফায়দা নিচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন। বিনিময়ে তারা নির্বাচনে প্রার্থীদের সহায়তা করছেন। কী অদ্ভুত সিস্টেম! বলতে গেলে প্রার্থীরা এবং প্রশাসন মিলেমিশে একাকার। এখানে ভোটারদের গুরুত্ব নেই। এসব কারণে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে এবার কোনো তরঙ্গ সৃষ্টি হয়নি। সাধারণ ভোটাররা ভোট দিতে কেন্দ্রে যাবেন বলেও মনে হয় না’ (ইত্তেফাক, ২৭ এপ্রিল ২০২৪)।
তার এ মন্তব্যে দেশের চলমান উপজেলা নির্বাচন তথা সার্বিক নির্বাচনব্যবস্থারই একটি বাস্তব চিত্র দৃশ্যমান। প্রথম ধাপের নির্বাচনে আমরা এরই প্রতিফলন দেখেছি। এ নির্বাচনে টাকার খেলা যেমন ছিল, তেমনি ছিল প্রশাসনকে হাত করে নেওয়ার মতো ঘটনাও। একটি নির্বাচনে দেশের সার্বিক আর্থ-সামাজিক তথা রাজনৈতিক অবস্থার প্রকৃত প্রতিফলন দেখা যায়। গত ১৫ বছরে আমরা দেশে বিভিন্ন মডেলের নির্বাচন দেখেছি। সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের সঙ্গে সঙ্গে ডামি প্রার্থীরাও নির্বাচন করেছেন। এ মডেলের নির্বাচনের নজির বিশ্বে বিরল। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে ডামি প্রার্থীরা নৌকা না পেলেও মুজিব কোট গায়ে দিয়েই অনেকে নির্বাচন করেছেন। নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে ডামি প্রার্থী দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারপরও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে ভোটকেন্দ্রমুখী করা যায়নি-এটাই বাস্তবতা।
জাতীয় নির্বাচনের মতো উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও জনগণের মাঝে ভোট নিয়ে কোনো উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা যায়নি। আওয়ামী লীগ জাতীয় নির্বাচনে নৌকা ও মুজিব কোট (ডামি প্রার্থী) নিয়ে নামলেও এবারের উপজেলা নির্বাচনে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রার্থী দেয়নি। দল থেকে কাউকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবেও সমর্থন করা হবে না বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। দল চেয়েছে, যোগ্য ও জনপ্রিয় নেতারা জিতে আসুক। এ জন্য দলের এমপি-মন্ত্রীদের উপজেলা নির্বাচনে সম্পৃক্ত না হওয়ারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অতীতে দলীয় প্রতীক দেওয়ায় স্থানীয় নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আরও বেড়ে গিয়েছিল। যারা প্রতীক পাননি দলের সঙ্গে তাদের দূরত্ব আরও বেড়েছে। কিন্তু এবার কাউকেই নৌকা প্রতীক দেওয়া হয়নি। তাতে দূরত্ব আরও বেড়েছে। নৌকার সঙ্গে সব নেতারই দূরত্ব বেড়েছে। কারণ, দলীয় প্রতীক পাওয়ার জন্যই মানুষ রাজনীতি করে। সেই প্রতীকই যদি না পাওয়া যায় তাহলে আর নৌকা, ধানের শীষ কেন?
অন্যান্য দলের প্রার্থী ও দলনিরপেক্ষ ভোটারদের ভোটমুখী করাও উপজেলা নির্বাচনে প্রতীক না দেওয়ার অন্যতম কারণ। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। বিএনপির কিছু বিদ্রোহী প্রার্থী নির্বাচনে গেলেও সাধারণ ভোটাররা সেভাবে ভোটকেন্দ্রে যাননি। বরং সংসদ নির্বাচনে যে পরিমাণ ভোট পড়েছিল, উপজেলা নির্বাচনে তার চেয়েও কম ভোট পড়েছে। নির্বাচন কমিশনের হিসাবেই দেখা যাচ্ছে, প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনে ৩৬.১ শতাংশ ভোট পড়েছে। কাজেই, সরকারের কৌশলের কারণে ভোট তো বেশি পড়েইনি, বরং দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের নজির সৃষ্টি হয়েছে। মন্ত্রী-এমপিরা নির্বাচনে সম্পৃক্ত হয়েছেন। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বা বিএনপির প্রার্থীদের নির্বাচনে আনার এজেন্ডা বাস্তবায়িত না হলেও নিজ দলে শৃঙ্খলা ভঙ্গ হওয়ার নজির সৃষ্টি হয়েছে।
আসলে জাতীয় নির্বাচন থেকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন-সব ক্ষেত্রেই চলছে একতরফা নির্বাচনের মহোৎসব। এমন একটি পরিস্থিতিতে মানুষের মাঝে ভোট নিয়ে আগ্রহ থাকার কথাও না। অথচ এদেশের মানুষের কাছে ভোট ছিল একটি উৎসব। সে উৎসবটিও আজ কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এর দায় রাজনৈতিক দলগুলোকেই নিতে হবে। সরকারের দায় অবশ্যই বেশি। এখানে পর্যায়ক্রমে নির্বাচনের যে নজির সৃষ্টি করা হচ্ছে, জনগণকে তা চূড়ান্তভাবে ভোটবিমুখ করছে। দেশে যতটুকু ভোটাভুটি এখনো বাকি আছে, সেখানেও দেখা যায় অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা। প্রকাশ্যে ব্যালটে সিল মারা, জাল ভোট দেওয়া, মারামারি, ভোটকেন্দ্র দখল ইত্যাদি লেগেই আছে। অতিসম্প্রতি যোগ হয়েছে ভোটের আগে প্রতিদ্বন্দ্বীকে অপহরণ করা। এক প্রতিমন্ত্রীর পরমাত্মীয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে এক প্রার্থী। ফলে ওই প্রতিদ্বন্দ্বীকে অপহরণ করা হয়। যদিও ওই অপহরণকারী পরমাত্মীয়ের প্রার্থিতা বাতিল করা হয়েছে; কিন্তু অপহরণের ঘটনার বিচার হয়েছে বলে শোনা যায়নি। অপহরণ একটি চরম ফৌজদারি অপরাধ। ফৌজদারি অপরাধের বিচার করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এসব ঘটনা ভোটারদের হতাশ করে। তাদের ভোটবিমুখ করে।
সরকারে দাবি, বিরোধী দল হতাশ। ১৫ বছর ক্ষমতায় না থাকলে হতাশা থাকতেই পারে। কিন্তু যেসব দল ক্ষমতার ভাগিদার, সেই দলগুলোর মাঝেও তো হতাশার কমতি নেই। জাতীয় পার্টি বা সরকারের বন্ধু কিংস পার্টিগুলো কেন উপজেলা নির্বাচনে আসেনি? অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য তো তাদেরও মাঠে নামানো যেত? কেন তারা মাঠে নামেনি? কারণ তারা জানে, ভাগবাঁটোয়ারার বাইরে এদেশে নির্বাচন বলতে কিছু নেই। ভোটের ফয়সালা হয় টেবিলে। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪৪টি দলের মধ্যে যখন নগণ্যসংখ্যক কয়েকটি দল নির্বাচনে অংশ নেয়, তখন সে নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে জনগণ আগে থেকেই হতাশ। তাদের বিভিন্ন মন্তব্য ও ভূমিকা জনগণকে ভোটকেন্দ্র থেকে আরও দূরে সরিয়ে নিচ্ছে। ভোটার দিবস পালন করে ভোটারদের ভোটের মাঠে আনা যায় না। সে জন্য ভোটের মাঠের পরিবেশ ঠিক করতে হয়।
উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এক প্রার্থীর পক্ষে গোপন বৈঠক করার অভিযোগে এক শিক্ষক ও পাঁচজন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা গ্রেফতার হয়েছেন। এরকম ঘটনা নতুন নয়। এ ধরনের গোপন বৈঠকের খবর প্রকাশ হোক বা না হোক, ভোটের ফলাফল যে বৈঠকেই নির্ধারিত হয়, জনগণ তা বোঝে। কাজেই, সে ধারণার পরিবর্তন ঘটাতে হলে সরকার ও কমিশনকে এগিয়ে আসতে হবে। উপজেলা নির্বাচন উপলক্ষ্যে গত ২৫ এপ্রিল জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘এবারের উপজেলা নির্বাচন ব্যর্থ হলে ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা ক্ষুণ্ন হবে।’ এর আগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দাবি করেছিলেন, গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচন ১৯৭৫ সালের পর দেশে অনুষ্ঠিত সব নির্বাচনের তুলনায় সুষ্ঠু হয়েছে। ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে কমিশনের মতে ৪২ শতাংশ ভোট পড়েছে। আর ৮ মে’র প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনে ভোট পড়েছে ৩৬ শতাংশ। কাজেই জাতীয় নির্বাচনে ৪২ শতাংশ ভোট পড়লে স্থানীয় নির্বাচনে ৩৬ শতাংশ কম কিসে! ৭ জানুয়ারির ভোটের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রের অধীনে ৮ মে’র মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচন মানানসই বটে! তাদের মন্তব্যের যৌক্তিক ব্যাখ্যা তো তা-ই বলে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর আমরা ৭ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে গর্ব করি। সে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্র নিয়েই আমরা তুষ্ট। এ অবস্থায় জনগণের ভোটের ভবিষ্যৎ কী তা অনুমান করাও কঠিন। কিন্তু এদেশের মানুষ ক্ষুধার্ত। ক্ষুধা তার ভাতের ও ভোটের।
শেষ করি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের আরেকটি বয়ান দিয়ে। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে কম ভোট পড়া নিয়ে তিনি বলেছেন, ‘ভোটাররা ধান কাটায় ব্যস্ত থাকায় কেন্দ্রে যাননি।’ তিনি ঠিকই ধরেছেন। এদেশের মানুষ চাষাভুষা। আমরা চাষাভুষার সন্তান। আমাদের বাপ-দাদারা চাষাভুষা ছিলেন। তাদের কথা মাথায় রেখে আগামী উপজেলা নির্বাচনগুলো যাতে ধান কাটার মৌসুমে না হয়, কমিশন যেন সেদিকে একটু খেয়াল রাখে। তাহলে আমাদের ধানচাষি বাপ-দাদারা বা আমরা চাষাভুষার সন্তান তথা এদেশের জনগণ হয়তো ভোট দিতে পারব। এছাড়া ভোটারদের আর কী-ই বা বলার আছে!