হাওর বার্তা ডেস্কঃ সরকারের আমদানিকৃত চালের প্রথম এবং দ্বিতীয় চালান দেশের বাজারে এলেও উত্তরাঞ্চলের বাজারে চালের দাম কমেনি। পূর্বের মতই বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে চাল। অপরদিকে মোটা চালের আমদানি এখানকার বাজারে খুব কম। ব্যবসায়ীরা বলছে মিল থেকে মোটা চাল আসছে না। কোয়ালিটি ভেদে ৪৩-৫০ টাকায় এখনো বিক্রি হচ্ছে মোটা চাল। ছোট ছোট মিলারদের অভিযোগ, আসল ঘটনা আড়াল করার জন্যই একটি মহল চালের বাজার বৃদ্ধির জন্য মালিকদের দোষ দিচ্ছে। তারা দোষারোপকারীদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারা যেকোনো সময় মিল এবং আমাদের গুদাম দেখে যান কোথায় আমরা ধান চাল লুকিয়ে রেখেছি। দেশের বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর ইচ্ছেমতো চালের দাম নির্ধারণকে বর্তমান বাজার পরিস্থির জন্য দায়ী করেন। এদিকে খুচরা চালের আড়তদাররা বলছে সরকারে আমদানিকৃত চালও সিন্ডিকেটের হাতে চলে গেছে। দেশে বর্তমানে পর্যাপ্ত চাল থাকা সত্ত্বেও হাতেগোনা কিছু অসাধু ব্যক্তির কারসাজিতে চালের দাম এখনো কমছে না।
এদিকে উত্তরের সাত জেলায় চলমান বন্যায় কৃষকের ২২৪০৭ হেক্টর বিভিন্ন ফসলি জমি পানির নিচে চলে যাওয়ায় ব্যাপক ফসলহানির আশঙ্কায় আছে এই অঞ্চলের মানুষ। এর সঙ্গে আগে থেকে চাল আতঙ্ক আছেই। সব মিলে এই অঞ্চলের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ চরম বিপকে পড়ে আছে। সিন্ডিকেটদের দৌড়াত্ম এখনি থামানো না গেলে বাজার পরিস্থিতি আরো অস্বাভাবিক হতে পারে।
অপরদিকে প্রাণ, এসিআই, স্কোয়ারসহ মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো কৃষকের ধান মৌসুমের শুরুতে কম দামে কিনে গোডাউন জাত করে এখন চাল করে ইচ্ছেমতো দামে বিক্রি করছে। এর প্রভাবও চরমভাবে বাজারে পড়েছে বলে দাবি করছেন মিলমালিক নেতৃবৃন্দ। বাজারে বিআর-২৮ ৪৬ টাকা কেজি হলেও প্রাণের লেবেলে সেই চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৫৬টাকায়। এসব কোম্পানির বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ হলো তারা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলো ছাড়া খোলাবাজারে চাল বিক্রি করে না। ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোতে তারা খোলাবাজার থেকে প্রত্যেক আইটেম চালেই ১০-১২টাকা কেজিতে বেশি বিক্রি করছে। ক্রেতা এবং খুচরা বিক্রেতারা অভিযোগ করেন এসব বড় বড় কোম্পানি বিআর-২৮ চাল মিনিকেট হিসেবে প্যাকেটজাত করে বিক্রি করছে। তাতে এই দাম বেড়ে ৬০টাকা পর্যন্ত হচ্ছে। খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বললেন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর চাল বেশি দামে বিক্রির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার এখতিয়ার নেই। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বিষয়টি দেখেন। কিছু করার থাকলে তারাই করতে পারবেন। এর প্রভাব পড়েছে সরকারি খাদ্যগুদামেও। বাজারে চালের দাম বাড়ায় সরকারের বেঁধে দেয়া ৩৪ টাকা কেজিতে চাল দিতে অধিকাংশ মিলার নারাজ। এবার উত্তরাঞ্চলের এক তৃতীয়াংশ মিলার খাদ্য অফিসের সাথে চাল দিতে চুক্তিবদ্ধ হয়নি। এতে সরকারি খাদ্যগুদামে লক্ষমাত্রা পূরণ না হওয়ার আশঙ্ক করছেন কর্মকর্তারা। চালের চলমান অস্থির বাজার এর জন্য দায়ী। ছোট ছোট মিলারদের লোকসানে খাদ্যগুদামে চাল দিতে বাধ্য করা হলেও রাঘববোয়ালরা এক কেজি চালও গুদামে এখন পর্যন্ত দেয়নি। তারা সরকারি গুদামে চাল দেওয়ার পরিবর্তে খোলা বাজারে কেজিতে ১৫-১৮ বেশিতে চাল বিক্রি করছে।
উত্তরের দুই বিভাগ রাজশাহী ও রংপুরের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক অফিসের চলতি মেীসুমের খাদ্য সংগ্রহের মোট টার্গেটের ধারের কাছেও যেতে পারেনি। এবারে রাজশাহী অঞ্চলের বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, রাজশাহী, চাঁপাই নবাবগঞ্জ এই ৮ জেলায় মোট চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্র ধরা হয়েছে ২লাখ ৬৫ হাজার ৫০৯ টন। এর মধ্যে সিদ্ধ চাল ১ লাখ ৯৫ হাজার ২৩০ এবং আতব চাল ৭০ হাজার ২৭৯ টন। এই অঞ্চলে মোট বৈধ মিলারের সংখ্যা ৬ হাজার ২২৬। এর মধ্যে মাত্র ১হাজার ৮৮০ জন মিলার সরকারি খাদ্য গুদামে চাল দেওয়ার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে।
অপর দিকে রংপুর আঞ্চলিক খাদ্য অফিসের অধীনে রংপুর, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় এই ৮ জেলায় চলতি মৌসুমে মোট খাদ্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২লাখ ২১ হাজার ৫১২ টন। এর মধ্যে সিদ্ধ চাল ২লাখ ৮হাজার ৫৫৯ এবং আতব চাল ১২ হাজার ৯৫৩ টন। এই অঞ্চলে মোট বৈধ মিলারের সংখ্যা ৮ হাজার ১৬৩। এর মধ্যে অটো মিল ২৫৮ এবং হাসকিং ৭হাজার ৯০৫টি। এর মধ্যে মাত্র ৩হাজার ২০ জন মিলার সরকারি খাদ্য গুদামে চাল দেওয়ার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে।
উত্তরের এই ১৬ জেলায় মোট খাদ্য সংগ্রহের লক্ষমাত্রা ৪ লাখ ৮৭ হাজার ২ টন। এর মধ্যে রংপুর অঞ্চলে মাত্র ৪৮ হাজার ৪৬০ মে.টন এবং রাজশাহী অঞ্চলে ২৮ হাজার ৯৭৩ টন চাল সংগ্রহ হয়েছে।
দুই অঞ্চলে মোট মিলার সংখ্যা ১৪ হাজার ৩৮৯। এর মধ্যে খাদ্য গুদামে চাল দেওয়ার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে ৪হাজার ৯০০। বাকি ৯হাজার ৪৮৯ মিলার কালো তালিকায় চলে গেছে। চুক্তি না হওয়া মিলারদের থেকে সরকার দুই বছরে চার মৌসুম চাল না কেনার সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যেই নিয়েছে।
এদিকে মিলালরা খাদ্য বিভাগের এই নিষেধাজ্ঞাকে জুলুম বলছেন। তারা অভিযোগ করে বলেন, সরকারি গুদামে চাল দেওয়ার বাধ্যবাধকতা না থাকলেও অবৈধভাবে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এবারের সংগ্রহ মূল্য প্রতিকেজি বোরো সিদ্ধ চাল ৩৪ টাকা ও আতপ চাল ৩৩ টাকা। গত ২০শে মে পর্যন্ত খাদ্য বিভাগের সঙ্গে মিলারদের (চালকল মালিক) চাল সরবরাহের চুক্তির সময়সীমা থাকলেও কমসংখ্যক মিলার চুক্তি করায় ৩১শে মে পর্যন্ত চুক্তির সময় বাড়ানো হয়। তাতেও সুবিধাজনক সাড়া মেলেনি। এদিকে সংগ্রহ কার্যক্রম চলবে ৩১শে আগস্ট।
এদিকে উত্তরাঞ্চলের বাজার ঘুরে জানা গেছে, মোটাচাল ৪৩-৫০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। যার কারণে শুরু থেকে চালকল মালিকদেরা সরকারি গুদামে চাল সরবরাহে চুক্তি করতে আগ্রহ হচ্ছে না।
এদিকে উত্তরাঞ্চলের অধিকাংশ মিল এখন চালু। বাজারেও পর্যপ্ত চালের আমদানী। তার পরেও মোটা চাল কিনতে গুনতে হচ্ছে ৫০ টাকার বেশি। চালের মূল্য বৃদ্ধি লাগামহীনভাবে সামনের দিকে যাচ্ছে। কোন মহল থেকেই সেই লাগাম টেনে ধরা হচ্ছে না। দিন দিন পরিস্থিতি আরো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। খেটে খাওয়া গরিব মানুষ এবার ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবে। নওগাঁ, জয়পুরহাট, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, বগুড়া ঘুরে চালের বাজারে এমন চিত্র দেখা গেছে। এ অঞ্চলের কৃষকরা ধান কাটা শুরু থেকেই বাজারে ধান বিক্রি করছে। বর্তমানে কৃষকের ঘরে ধান নেই। রাঘব বোয়াল মিলার এবং স্টক ব্যবসায়ীদের হাতে গুদামজাত হয়ে আছে উত্তরাঞ্চলের বেশির ভাগ ধান। দেশের হাওর অঞ্চলের দুর্যোগকে পূঁজি করে অসাধু মিলার এবং স্টক ব্যবসায়ীরা সেই ধান চাল করে উচ্চমূল্যে বাজারে ছাড়ছে। এতে রাতারাতি হাতেগোনা কিছু ব্যবসায়ী হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যাচ্ছে। অসাধু ব্যক্তিরা দেশের মানুষকে জিম্মি করলেও সরকার তাদের কিছু বলছে না। খুচরা ব্যবসায়ীদের অভিযোগ অসাধু স্টক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে আতাত আছে।
বিভিন্ন মহল থেকে চালের বাজারে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি জন্য মিলারদের ঘাড়ে দোষ চাপালেও মিলাররা বলেছেন তারা অসহায়। ধানের দাম বেশি এবং সরকারি ভাবে বাজার মনিটরিং না থাকায় চালের বাজার অস্বাভাবিক হচ্ছে। তারা অভিযোগ দেশের বড় বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পিগুলোর কারণে চালের বাজার বেশি। ওই সব রাঘবোয়াল কোম্পানির বিরুদ্ধে কেউ কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এমনকি কোনো কথাও বলছে না।
উত্তরাঞ্চলের একাধিক হাসকিং চালকল মালিকরা বলছেন, বর্তমান বাজারে মোটা চালে সর্বসাকুল্যে খরচ পড়বে কেজিপ্রতি ৩৯ টাকা। আর সরকার দাম নির্ধারণ করছে ৩৪ টাকা। এতে মিল মালিকদের প্রতিকেজি চালে কমপক্ষে ৫ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। নিশ্চিত এই লোকসানের মুখে ফেলার জন্য মিলমালিকরা সরকারকে দুষছেন। তাদের অভিযোগ সরকার দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে চালকল মালিকদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা করেনি। অপর দিকে চালকল মালিকরা ১১০ শতাংশ জামানত দিয়ে ধান নিয়ে চাল সরবরাহ করতে হয়। সরকারে বেঁধে দেয়া জামানত এবং নির্ধারিত দামে চাল সরবরাহ সরকারে পক্ষ থেকে অলিখিত চাপ মনে করছেন মিলাররা।
বগুড়া জেলা চাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শাহ মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, দেশে এমন কোনো মহামারি দেখা দেয়নি যার ফলে মোটা চালের দাম ৫০ টাকা ছেড়ে যাবে। তিনি মনে করেন কিছু অসাধু ব্যবসায়ী হাজার হাজার টন চাল স্টক করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে। তিনি সরকারের প্রতি দাবি জানান চালের বাজারে সংকট সৃষ্টিকারীদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হোক। রাজশাহী আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের কর্মকর্তা মুমিনুল ইসলাম এবং রংপুর আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের কর্মকর্তা শাহাদৎ হোসেন জানান, আগামী ৩১শে আগস্ট পর্যন্ত চাল সংগ্রহ অভিযান চলবে। এই সময়ের মধ্যে মিলারদের চাল দেয়ার জন্য নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। তারা আশা করেন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সন্তোষজনক চাল সংগ্রহ হবে।
সংবাদ শিরোনাম
আমদানির পরও উত্তরাঞ্চলে কমেনি চালের দাম
- Reporter Name
- আপডেট টাইম : ১১:৪২:২৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৯ জুলাই ২০১৭
- ২৫০ বার
Tag :
জনপ্রিয় সংবাদ