ঢাকা ১২:৩১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৫ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ডেঙ্গুর চেয়ে অধিক ভোগান্তির জ্বর চিকুনগুনিয়া

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:১৪:১৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৫ জুলাই ২০১৭
  • ৩২৭ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ  সম্প্রতি হঠাৎ করে তীব্র জ্বরের যে প্রকোপ দেখা দিচ্ছে তাকে ‘চিকুনগুনিয়া’ নামক ভাইরাসজনিত রোগ বলে অভিহিত করছেন দেশের একমাত্র রোগতত্ত্ব ও নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মাহমুদুর রহমান। ২০০৮ সালের অক্টোবরে প্রথম রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রথম এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে বলে সন্দেহ হলে ৩৯ ব্যক্তির রক্তরস সংগ্রহ করে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বেশ কয়েকজনের চিকুনগুনিয়া জ্বর ধরা পড়ে। ২০০৭-এর ডিসেম্বরের দিকে এ সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়ার পর আইসিডিডিআরবির একটি গবেষেক দল দুই জায়গাতেই রোগীর রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে বিষয়টি পুনরায় নিশ্চিত করে। এর আগে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩৭১টি বাড়ি থেকে মশার লার্ভা সংগ্রহ করে এডিস এলবোপিকটাস মশার উপস্থিতি নিশ্চিত করে। উল্লেখ্য, ২০০৬ সালে ভারতে চিকুনগুনিয়া জ্বরের প্রকোপ দেখা দিলে তখন ঢাকায় জ্বরে আক্রান্ত রোগীদেরকে অনেক বিশেষজ্ঞ চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে বলে সন্দেহ করে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার দুটি অঞ্চল থেকে ১৭৫ রোগীর রক্তরস পরীক্ষার জন্য আমেরিকায় পাঠায় আইসিডিডিআরবি। কিন্তু তখন তাদের কারও রক্তেই চিকুনগুনিয়ায় ভাইরাস পাওয়া যায়নি। কিন্তু সম্প্রতি চিকুনগুনিয়া ভাইরাসজনিত জ্বরের প্রমাণ পাওয়ায় বিশেষজ্ঞদের মধ্যে আবারও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। চিকুনগুনিয়া জ্বর অনেকটা ডেঙ্গুজ্বরের মতোই। এটিও মশাবাহিত রোগ। এই ভাইরাসেরও বাহক ডেঙ্গুজ্বরের ভাইরাস বহনকারী মশা এডিস। তবে ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক সাধারণত এডিস ঈজিপটি যা শহরাঞ্চলে বেশি দেখা দেয়, বংশবিস্তার করে স্বচ্ছ স্থির পানিতে। তবে ডেঙ্গু ভাইরাসের আরেক বাহক এডিস এলবোপিকটাস শহরাঞ্চলে থাকে না। এডিস এলবোপিকটাস মশা বংশবৃদ্ধি করে বাঁশ ও গাছের কোটরে জমে থাকা পানিতে। চিকুনগুনিয়া জ্বরের ভাইরাস বহনকারী মশা হিসেবে মূলত এডিস ঈজিপটিকে দায় করা হলেও এদেশে এডিস এলবোপিকটাস জাতীয় মশাকেই আপাতত চিহ্নিত করা গেছে। তবে যেকোনো প্রজাতির এডিস মশাই এই ভাইরাস বহন করে মানুষের মধ্যে ছড়াতে পারে। চিকুনগুনিয়া ভাইরাসবাহী মশার কামড়েই একজন মানুষ চার-পাঁচ দিনের মধ্যে চিকুনগুনিয়া জ্বরে আক্রান্ত হতে পারে। চিকুনগুনিয়া ভাইরাস চিকভি (ঈঐওকঠ) নামে পরিচিত। অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম এই রোগের অস্তিত্ব ধরা পড়লেও পরে ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও আফ্রিকাতে এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। চিকুনগুনিয়া জ্বরের উপসর্গ ও লক্ষণ অনেকটা একই রকম হলেও চিকুনগুনিয়ার ক্ষেত্রে উপসর্গের তীব্রতা অনেক বেশি, ফলে রোগীকে অনেক কষ্ট ভোগ করতে হয়। ২-৫ দিন তীব্র জ্বরের সঙ্গে শরীরের বিভিন্ন অস্থিসন্ধির প্রদাহজনিত ব্যথায় রোগী কাবু হয়ে পড়ে। জ্বর সেরে যাওয়ার পর অস্থিসন্ধির এই ব্যথা সারতে বয়সভেদে কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস লেগে যায়। জ্বরের মাত্রা থাকে ১০৪ ডিগ্রি পর্যন্ত। সঙ্গে মাথাব্যথা, চোখের সাদা অংশের প্রদাহ, আলোর প্রতি দৃষ্টির অসহিষ্ণুতা লক্ষ করা যায়। এছাড়া ডেঙ্গুর মতো শরীরে র্যাশ বা লালাভ দাগও দেখা যায়। তবে সাধারণত এই জ্বর দুই দিনের মাথায় সহসাই সেরে যায়। তবে জ্বর পরবর্তী অস্থিসন্ধির প্রদাহের কারণে ভোগান্তি হয় দীর্ঘমেয়াদি। চিকুনগুনিয়া নির্ণয়ে রক্তরসের পরীক্ষা আরটি-পিসিআর ও আইজিএম-চিকুনগুনিয়া এখনও সহজলভ্য নয়। চিকিত্সার ক্ষেত্রে ডেঙ্গুর সঙ্গে চিকুনগুনিয়ার খুব একটা পার্থক্য না থাকলেও মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অব মালয়েয়া, কুয়ালালামপুরের গবেষকরা এই জ্বরের চিকিত্সায় ম্যালেরিয়ায় ব্যবহূত ওষুধ ক্লোরোকুইন ফসফেট দৈনিক ২৫০ মিগ্রা মাত্রায় আশাব্যঞ্জক ফল পেয়েছেন। আর ব্যথা কমানোর জন্য প্রচলিত ব্যথানাশক (আইবুপ্রুফেন, ন্যাপ্রোক্সেন) খুব একটা কার্যকর নয় বলেও জানিয়েছেন গবেষকরা। মশার কামড় থেকে ছড়ায় বলে এই জ্বর মহামারী আকারে দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে ডেঙ্গুর মতো একই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এখন থেকে। সেই সঙ্গে এড়িয়ে চলতে হবে মশার কামড়। প্রয়োজনে শরীরে এনএন-ডাইইথাইল-মেটা-টলুমাইড / এনএন-ডাইইথাইল ১-৩-মিথাইল-বেঞ্জামাইড / ইকারিডিন ইত্যাদি উপাদান সমৃদ্ধ মশা বিতারক বা রিপিলেন্ট লোশন ব্যবহার করারও পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রতিরোধের যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হলে আগামী জুন মাসের মধ্যেই ডেঙ্গুর পাশাপাশি আরও ভোগান্তির জ্বর চিকুিনগুনিয়ার ঝুঁকিতে পড়তে হবে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

ডেঙ্গুর চেয়ে অধিক ভোগান্তির জ্বর চিকুনগুনিয়া

আপডেট টাইম : ১২:১৪:১৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৫ জুলাই ২০১৭

হাওর বার্তা ডেস্কঃ  সম্প্রতি হঠাৎ করে তীব্র জ্বরের যে প্রকোপ দেখা দিচ্ছে তাকে ‘চিকুনগুনিয়া’ নামক ভাইরাসজনিত রোগ বলে অভিহিত করছেন দেশের একমাত্র রোগতত্ত্ব ও নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মাহমুদুর রহমান। ২০০৮ সালের অক্টোবরে প্রথম রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রথম এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে বলে সন্দেহ হলে ৩৯ ব্যক্তির রক্তরস সংগ্রহ করে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বেশ কয়েকজনের চিকুনগুনিয়া জ্বর ধরা পড়ে। ২০০৭-এর ডিসেম্বরের দিকে এ সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হওয়ার পর আইসিডিডিআরবির একটি গবেষেক দল দুই জায়গাতেই রোগীর রক্তের নমুনা সংগ্রহ করে বিষয়টি পুনরায় নিশ্চিত করে। এর আগে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩৭১টি বাড়ি থেকে মশার লার্ভা সংগ্রহ করে এডিস এলবোপিকটাস মশার উপস্থিতি নিশ্চিত করে। উল্লেখ্য, ২০০৬ সালে ভারতে চিকুনগুনিয়া জ্বরের প্রকোপ দেখা দিলে তখন ঢাকায় জ্বরে আক্রান্ত রোগীদেরকে অনেক বিশেষজ্ঞ চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে বলে সন্দেহ করে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার দুটি অঞ্চল থেকে ১৭৫ রোগীর রক্তরস পরীক্ষার জন্য আমেরিকায় পাঠায় আইসিডিডিআরবি। কিন্তু তখন তাদের কারও রক্তেই চিকুনগুনিয়ায় ভাইরাস পাওয়া যায়নি। কিন্তু সম্প্রতি চিকুনগুনিয়া ভাইরাসজনিত জ্বরের প্রমাণ পাওয়ায় বিশেষজ্ঞদের মধ্যে আবারও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। চিকুনগুনিয়া জ্বর অনেকটা ডেঙ্গুজ্বরের মতোই। এটিও মশাবাহিত রোগ। এই ভাইরাসেরও বাহক ডেঙ্গুজ্বরের ভাইরাস বহনকারী মশা এডিস। তবে ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক সাধারণত এডিস ঈজিপটি যা শহরাঞ্চলে বেশি দেখা দেয়, বংশবিস্তার করে স্বচ্ছ স্থির পানিতে। তবে ডেঙ্গু ভাইরাসের আরেক বাহক এডিস এলবোপিকটাস শহরাঞ্চলে থাকে না। এডিস এলবোপিকটাস মশা বংশবৃদ্ধি করে বাঁশ ও গাছের কোটরে জমে থাকা পানিতে। চিকুনগুনিয়া জ্বরের ভাইরাস বহনকারী মশা হিসেবে মূলত এডিস ঈজিপটিকে দায় করা হলেও এদেশে এডিস এলবোপিকটাস জাতীয় মশাকেই আপাতত চিহ্নিত করা গেছে। তবে যেকোনো প্রজাতির এডিস মশাই এই ভাইরাস বহন করে মানুষের মধ্যে ছড়াতে পারে। চিকুনগুনিয়া ভাইরাসবাহী মশার কামড়েই একজন মানুষ চার-পাঁচ দিনের মধ্যে চিকুনগুনিয়া জ্বরে আক্রান্ত হতে পারে। চিকুনগুনিয়া ভাইরাস চিকভি (ঈঐওকঠ) নামে পরিচিত। অস্ট্রেলিয়ায় প্রথম এই রোগের অস্তিত্ব ধরা পড়লেও পরে ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও আফ্রিকাতে এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। চিকুনগুনিয়া জ্বরের উপসর্গ ও লক্ষণ অনেকটা একই রকম হলেও চিকুনগুনিয়ার ক্ষেত্রে উপসর্গের তীব্রতা অনেক বেশি, ফলে রোগীকে অনেক কষ্ট ভোগ করতে হয়। ২-৫ দিন তীব্র জ্বরের সঙ্গে শরীরের বিভিন্ন অস্থিসন্ধির প্রদাহজনিত ব্যথায় রোগী কাবু হয়ে পড়ে। জ্বর সেরে যাওয়ার পর অস্থিসন্ধির এই ব্যথা সারতে বয়সভেদে কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস লেগে যায়। জ্বরের মাত্রা থাকে ১০৪ ডিগ্রি পর্যন্ত। সঙ্গে মাথাব্যথা, চোখের সাদা অংশের প্রদাহ, আলোর প্রতি দৃষ্টির অসহিষ্ণুতা লক্ষ করা যায়। এছাড়া ডেঙ্গুর মতো শরীরে র্যাশ বা লালাভ দাগও দেখা যায়। তবে সাধারণত এই জ্বর দুই দিনের মাথায় সহসাই সেরে যায়। তবে জ্বর পরবর্তী অস্থিসন্ধির প্রদাহের কারণে ভোগান্তি হয় দীর্ঘমেয়াদি। চিকুনগুনিয়া নির্ণয়ে রক্তরসের পরীক্ষা আরটি-পিসিআর ও আইজিএম-চিকুনগুনিয়া এখনও সহজলভ্য নয়। চিকিত্সার ক্ষেত্রে ডেঙ্গুর সঙ্গে চিকুনগুনিয়ার খুব একটা পার্থক্য না থাকলেও মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অব মালয়েয়া, কুয়ালালামপুরের গবেষকরা এই জ্বরের চিকিত্সায় ম্যালেরিয়ায় ব্যবহূত ওষুধ ক্লোরোকুইন ফসফেট দৈনিক ২৫০ মিগ্রা মাত্রায় আশাব্যঞ্জক ফল পেয়েছেন। আর ব্যথা কমানোর জন্য প্রচলিত ব্যথানাশক (আইবুপ্রুফেন, ন্যাপ্রোক্সেন) খুব একটা কার্যকর নয় বলেও জানিয়েছেন গবেষকরা। মশার কামড় থেকে ছড়ায় বলে এই জ্বর মহামারী আকারে দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে ডেঙ্গুর মতো একই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এখন থেকে। সেই সঙ্গে এড়িয়ে চলতে হবে মশার কামড়। প্রয়োজনে শরীরে এনএন-ডাইইথাইল-মেটা-টলুমাইড / এনএন-ডাইইথাইল ১-৩-মিথাইল-বেঞ্জামাইড / ইকারিডিন ইত্যাদি উপাদান সমৃদ্ধ মশা বিতারক বা রিপিলেন্ট লোশন ব্যবহার করারও পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রতিরোধের যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হলে আগামী জুন মাসের মধ্যেই ডেঙ্গুর পাশাপাশি আরও ভোগান্তির জ্বর চিকুিনগুনিয়ার ঝুঁকিতে পড়তে হবে।