ঢাকা ০৫:৪৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাজেটে ভ্যাট প্রসঙ্গ

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:০৯:০৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৫ জুন ২০১৭
  • ৩৭০ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষের কথা মাথায় না রেখে এবারের বাজেট ঘোষণা করলেন অর্থমন্ত্রী! পুরো ১৫ শতাংশ ভ্যাট থাকছেই। গণমানুষের দাবি উপেক্ষিত হয়েছে এই বাজেটে। যারা বেআইনিভাবে টাকা উপার্জন করল, যারা দেশের টাকা বিদেশে নিয়ে গেল, যারা এখনও করের আওতায় নেই বা যারা অনেক কম ট্যাক্স দেয়, তাদেরকে ধরার ক্ষেত্রে কোনো উদ্যোগ বা উদ্ভাবনী কৌশল আমরা দেখলাম না। অনেকেই ভেবেছিলেন, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে অর্থমন্ত্রী এমন একটা বাজেট দেবেন, যাতে জনগণের ওপর করের চাপ কম থাকে। বাজেট পেশের কিছুদিন আগে অর্থমন্ত্রী করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। আর ব্যবসায়ীদের একটা বড় দাবি ছিল, ভ্যাটের হার ও করপোরেট করহার কমানো। অর্থমন্ত্রী এ দুটি ক্ষেত্রে করহার কমবে বলেছিলেন। কিন্তু জাতীয় সংসদে আগামী অর্থবছরের (২০১৭-১৮) যে বাজেট পেশ করলেন, তাতে সে কথা রাখা হয়নি। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত যে বাজেট পেশ করলেন, তাতে তিনি ব্যয় করতে চান ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা। আয় করতে চান ২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা। বাকি ১ লাখ ১২ হাজার ২৭৬ কোটি টাকার ঘাটতি তিনি ঋণ ও অনুদানের মাধ্যমে মেটাতে চান। এ বাজেটকে অবাস্তব ও অবাস্তবায়নযোগ্য বলেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি গণমাধ্যমকে সাক্ষাত্কারে বলেছেন, এনবিআরের পক্ষে এত বড় অঙ্কের রাজস্ব আদায় সম্ভব নয়। এত বড় অঙ্ক ব্যয়ের সামর্থ্যও সরকারের নেই। অবশ্য অর্থমন্ত্রী নিজেও এ বাজেটকে উচ্চাভিলাষী বললেও বাস্তবায়ন সম্ভব বলে মন্তব্য করেছেন। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন এ বাজেটকে ‘মিশ্র ঝুড়ি’র বাজেট বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি একটি জাতীয় দৈনিককে সাক্ষাত্কারে বলেন, আগের মতোই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা এবারও রয়েছে। রাজস্ব আয়ে প্রায় ৩২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে। রাজস্ব আয়ে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৪ শতাংশ। বিদেশি ঋণের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তা অর্জন করতে হলে পাইপলাইনে থাকা অর্থ ব্যবহারের হার ৩০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। বর্তমানে এ হার ১৫ শতাংশের মতো। শুধু সরকারি বিনিয়োগ বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনও প্রশ্নসাপেক্ষ মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। আগামী অর্থবছরের বাজেটে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা কমে হয়েছে ৩ লাখ ১৭ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটের তুলনায় নতুন বাজেটের ব্যয় লক্ষ্যমাত্রা ৮৩ হাজার কোটি টাকা বা ২৬ শতাংশ বেশি। নতুন বাজেটে অনুন্নয়নমূলক ব্যয় ২ লাখ ৩৪ হাজার ১৩ কোটি টাকা। আগের বাজেটে যা ছিল ২ লাখ ১৫ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা কমে হয়েছে ১ লাখ ৯২ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা। নতুন বাজেটে অনুন্নয়ন রাজস্ব ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৭ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা। মোট উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৫৯ হাজার ১৩ কোটি টাকা, যার মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপি ১ লাখ ৫৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। আগের বাজেটে এডিপির আকার ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। নতুন বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরের মাধ্যমে আসবে ২ লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। রাজস্ব আয়ে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে প্রায় ৩২ শতাংশ। শুধু এনবিআরের ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে প্রায় ৩৪ শতাংশ। এনবিআর-বহির্ভূত কর ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৬২২ কোটি টাকা। কর ছাড়া আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৩১ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা। আয় ও মুনাফার ওপর কর থেকে আসবে ৮৬ হাজার ৮৬৭ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট থেকে প্রায় ৩৬ শতাংশ বেশি। ভ্যাট থেকে আয় আসবে ৯১ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা, যা আগের বাজেটের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা থেকে ২২ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা বা ৩৩ শতাংশ বেশি। আমদানি ও রফতানি শুল্ক থেকে ৩০ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা এবং সম্পূরক শুল্ক থেকে আসবে ৩৮ হাজার ২১২ কোটি টাকা। রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করতে গিয়ে মুহিত বলেন, যুগোপযোগী করনীতি, দক্ষ কর ব্যবস্থাপনা এবং ব্যবসায়ীসহ সকল স্টেকহোল্ডারের মাধ্যমে এনবিআর এ রাজস্ব আদায় করতে পারবে। তিনি দাবি করেন, দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের মাধ্যমে রাজস্ব প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে আমরা এর ফল পাচ্ছি না। এই উচ্চাভিলাষী বাজেট কি মানুষের ভাগ্যে পরিবর্তন আনবে? এটাই এখন বড় প্রশ্ন। বর্তমান সরকারের প্রস্তাবিত বাজেটকে নিজেদের পকেট ভর্তি করার বাজেট বলে মন্তব্য করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘সাধারণ মানুষের পকেট কেটে নিজেদের পকেট ভর্তি করতে সরকার জনগণের ওপর বাজেট চাপিয়ে দিয়েছে। বাজেটে জনগণের ওপর করের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সরকারের বাজেট দেওয়ার অধিকার নেই। তাদের জনগণের কাছে কোনো জবাবদিহিতা নেই। সংসদে কোনো বিরোধী দল নেই। সংসদেও তাদের জবাবদিহিতা নেই।’ এদিকে ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তা, অর্থনীতিবিদসহ ভ্যাট বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সর্বক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপের পদক্ষেপ বাংলাদেশের বাস্তবতায় একেবারেই অবাস্তব। এই হার কার্যকর হলে পণ্য ও সেবার খরচ বাড়বে। এতে করে ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন জিনিসের দাম বাড়িয়ে দেবেন। যার প্রভাব শেষ পর্যন্ত এসে পড়বে সাধারণ ভোক্তা বা জনগণের ওপর। তারা আরও বলেন, ভ্যাট ভোক্তারা দেন। এই কর জনগণের কাছ থেকে ব্যবসায়ীরা আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা দেন। আগামী বছরের শেষে অথবা ২০১৯ সালের শুরুতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের যে বাজেট প্রস্তাব করেছেন, তা নির্বাচনের আগে তার পূর্ণাঙ্গ বাজেট। আগামী বছর যে বাজেট প্রস্তাব করবেন, তা এই সরকার বাস্তবায়ন করে যেতে পারবে না। তাই এ বাজেট কিছুটা রাজনৈতিক বিবেচনায় করা হয়েছে বলে মনে হয়। আকারে ঊর্ধ্বগতি আছে। ব্যয় বৃদ্ধির দিক থেকে অনেক বড় বাজেট। ব্যয় বৃদ্ধিকে খারাপ মনে করি না। নির্বাচন সামনে রেখে বাজেট বিধায় স্থানীয় সরকার পর্যায়ে উন্নয়ন বাজেট, বিশেষত এলজিইডির মাধ্যমে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে তার আকার অনেক বাড়বে। তবে তাতে গুণগত মান বজায় থাকবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। অর্থমন্ত্রী আগামী অর্থবছরের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৪০ শতাংশ হবে বলে আশা করেছেন। প্রবৃদ্ধি নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। অনেকে মনে করেন, এ লক্ষ্যমাত্রা রাজনৈতিক বিবেচনায় করা হয়েছে। এটা বাস্তবভিত্তিক হওয়া উচিত। এখন বিদায়ী অর্থবছরে ৭ দশমিক ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি যদি সত্যি সত্যি অর্জিত হয়, সেক্ষেত্রে ৭ দশমিক ৪০ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রা বেশি নয়। এডিপি বাস্তবায়ন হলে, বেসরকারি পর্যায় থেকে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ বাড়ানো গেলে, মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে থাকলে এবং রফতানিতে যে শ্লথগতি আছে তা দূর করা গেলে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে না। অর্থমন্ত্রী প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৫ শতাংশে সীমিত রাখার প্রস্তাব করেছেন। এটা অর্জন করতে পারলে খুবই ভালো হবে। যদিও চালসহ অন্য কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে বর্তমান মূল্যস্ফীতি অনেকটা চড়া। এটাকে সহনীয় পর্যায়ে রাখতে অনেক বাধা আছে। শেষ পর্যন্ত এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সরকারের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এদিকে রাজস্ব আদায় বাড়াতে গিয়ে সরকার ছোট ছোট কিছু খাত থেকে আয় বাড়ানোর চেষ্টা করেছে। এর মধ্যে একটা বড় ভুল পদক্ষেপ আছে। তা হল ব্যাংকের সঞ্চয়ের ওপর আবগারি শুল্ক বৃদ্ধি। এটা খুবই খারাপ হয়েছে। এটা মানুষকে বৈধ পন্থায় সঞ্চয় ও লেনদেনে নিরুত্সাহিত করবে। অবৈধ পথে লেনদেন বাড়বে, যা সরকারই নিরুত্সাহিত করে। কো-অপারেটিভসহ ডেসটিনি, যুবকের মতো ভুঁইফোড় কোম্পানির দিকে ঝুঁকে পড়বে মানুষ। অনেকে ব্যাংক থেকে টাকা সরিয়ে নেবে। অবৈধ অর্থনীতির আকার বড় হবে। যাকে আমরা মাটির নিচের অর্থনীতি বলি। বাজেটের বড় লক্ষ্য হওয়া উচিত মানুষের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন। এজন্য সরকারকে সামাজিক অবকাঠামো খাতে ব্যয় বাড়াতে আরও মনোযোগী হতে হবে। এজন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও দারিদ্র্যবিমোচনে সরকারকে বর্তমানের তুলনায় অনেকগুণ ব্যয় বরাদ্দ রাখতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, শিক্ষায় জিডিপির আকারের ৬-৭ শতাংশ ব্যয় করার প্রয়োজন থাকলেও সরকার করছে মাত্র ২ শতাংশ। যেটা অনেক কম ও নিতান্তই স্বল্প। লেখক : ব্যবসায়ী
abdullahalmehedi@ymail.com

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

বাজেটে ভ্যাট প্রসঙ্গ

আপডেট টাইম : ১১:০৯:০৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৫ জুন ২০১৭

হাওর বার্তা ডেস্কঃ সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষের কথা মাথায় না রেখে এবারের বাজেট ঘোষণা করলেন অর্থমন্ত্রী! পুরো ১৫ শতাংশ ভ্যাট থাকছেই। গণমানুষের দাবি উপেক্ষিত হয়েছে এই বাজেটে। যারা বেআইনিভাবে টাকা উপার্জন করল, যারা দেশের টাকা বিদেশে নিয়ে গেল, যারা এখনও করের আওতায় নেই বা যারা অনেক কম ট্যাক্স দেয়, তাদেরকে ধরার ক্ষেত্রে কোনো উদ্যোগ বা উদ্ভাবনী কৌশল আমরা দেখলাম না। অনেকেই ভেবেছিলেন, জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে অর্থমন্ত্রী এমন একটা বাজেট দেবেন, যাতে জনগণের ওপর করের চাপ কম থাকে। বাজেট পেশের কিছুদিন আগে অর্থমন্ত্রী করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। আর ব্যবসায়ীদের একটা বড় দাবি ছিল, ভ্যাটের হার ও করপোরেট করহার কমানো। অর্থমন্ত্রী এ দুটি ক্ষেত্রে করহার কমবে বলেছিলেন। কিন্তু জাতীয় সংসদে আগামী অর্থবছরের (২০১৭-১৮) যে বাজেট পেশ করলেন, তাতে সে কথা রাখা হয়নি। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত যে বাজেট পেশ করলেন, তাতে তিনি ব্যয় করতে চান ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা। আয় করতে চান ২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা। বাকি ১ লাখ ১২ হাজার ২৭৬ কোটি টাকার ঘাটতি তিনি ঋণ ও অনুদানের মাধ্যমে মেটাতে চান। এ বাজেটকে অবাস্তব ও অবাস্তবায়নযোগ্য বলেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি গণমাধ্যমকে সাক্ষাত্কারে বলেছেন, এনবিআরের পক্ষে এত বড় অঙ্কের রাজস্ব আদায় সম্ভব নয়। এত বড় অঙ্ক ব্যয়ের সামর্থ্যও সরকারের নেই। অবশ্য অর্থমন্ত্রী নিজেও এ বাজেটকে উচ্চাভিলাষী বললেও বাস্তবায়ন সম্ভব বলে মন্তব্য করেছেন। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন এ বাজেটকে ‘মিশ্র ঝুড়ি’র বাজেট বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি একটি জাতীয় দৈনিককে সাক্ষাত্কারে বলেন, আগের মতোই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা এবারও রয়েছে। রাজস্ব আয়ে প্রায় ৩২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে। রাজস্ব আয়ে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৪ শতাংশ। বিদেশি ঋণের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তা অর্জন করতে হলে পাইপলাইনে থাকা অর্থ ব্যবহারের হার ৩০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। বর্তমানে এ হার ১৫ শতাংশের মতো। শুধু সরকারি বিনিয়োগ বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনও প্রশ্নসাপেক্ষ মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। আগামী অর্থবছরের বাজেটে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা কমে হয়েছে ৩ লাখ ১৭ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটের তুলনায় নতুন বাজেটের ব্যয় লক্ষ্যমাত্রা ৮৩ হাজার কোটি টাকা বা ২৬ শতাংশ বেশি। নতুন বাজেটে অনুন্নয়নমূলক ব্যয় ২ লাখ ৩৪ হাজার ১৩ কোটি টাকা। আগের বাজেটে যা ছিল ২ লাখ ১৫ হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা কমে হয়েছে ১ লাখ ৯২ হাজার ৯৩২ কোটি টাকা। নতুন বাজেটে অনুন্নয়ন রাজস্ব ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৭ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা। মোট উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৫৯ হাজার ১৩ কোটি টাকা, যার মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপি ১ লাখ ৫৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। আগের বাজেটে এডিপির আকার ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। নতুন বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৮৭ হাজার ৯৯১ কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরের মাধ্যমে আসবে ২ লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। রাজস্ব আয়ে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে প্রায় ৩২ শতাংশ। শুধু এনবিআরের ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে প্রায় ৩৪ শতাংশ। এনবিআর-বহির্ভূত কর ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৬২২ কোটি টাকা। কর ছাড়া আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৩১ হাজার ১৭৯ কোটি টাকা। আয় ও মুনাফার ওপর কর থেকে আসবে ৮৬ হাজার ৮৬৭ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট থেকে প্রায় ৩৬ শতাংশ বেশি। ভ্যাট থেকে আয় আসবে ৯১ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা, যা আগের বাজেটের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা থেকে ২২ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা বা ৩৩ শতাংশ বেশি। আমদানি ও রফতানি শুল্ক থেকে ৩০ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা এবং সম্পূরক শুল্ক থেকে আসবে ৩৮ হাজার ২১২ কোটি টাকা। রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করতে গিয়ে মুহিত বলেন, যুগোপযোগী করনীতি, দক্ষ কর ব্যবস্থাপনা এবং ব্যবসায়ীসহ সকল স্টেকহোল্ডারের মাধ্যমে এনবিআর এ রাজস্ব আদায় করতে পারবে। তিনি দাবি করেন, দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের মাধ্যমে রাজস্ব প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে আমরা এর ফল পাচ্ছি না। এই উচ্চাভিলাষী বাজেট কি মানুষের ভাগ্যে পরিবর্তন আনবে? এটাই এখন বড় প্রশ্ন। বর্তমান সরকারের প্রস্তাবিত বাজেটকে নিজেদের পকেট ভর্তি করার বাজেট বলে মন্তব্য করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘সাধারণ মানুষের পকেট কেটে নিজেদের পকেট ভর্তি করতে সরকার জনগণের ওপর বাজেট চাপিয়ে দিয়েছে। বাজেটে জনগণের ওপর করের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সরকারের বাজেট দেওয়ার অধিকার নেই। তাদের জনগণের কাছে কোনো জবাবদিহিতা নেই। সংসদে কোনো বিরোধী দল নেই। সংসদেও তাদের জবাবদিহিতা নেই।’ এদিকে ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তা, অর্থনীতিবিদসহ ভ্যাট বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সর্বক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপের পদক্ষেপ বাংলাদেশের বাস্তবতায় একেবারেই অবাস্তব। এই হার কার্যকর হলে পণ্য ও সেবার খরচ বাড়বে। এতে করে ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন জিনিসের দাম বাড়িয়ে দেবেন। যার প্রভাব শেষ পর্যন্ত এসে পড়বে সাধারণ ভোক্তা বা জনগণের ওপর। তারা আরও বলেন, ভ্যাট ভোক্তারা দেন। এই কর জনগণের কাছ থেকে ব্যবসায়ীরা আদায় করে সরকারি কোষাগারে জমা দেন। আগামী বছরের শেষে অথবা ২০১৯ সালের শুরুতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৭-১৮ অর্থবছরের যে বাজেট প্রস্তাব করেছেন, তা নির্বাচনের আগে তার পূর্ণাঙ্গ বাজেট। আগামী বছর যে বাজেট প্রস্তাব করবেন, তা এই সরকার বাস্তবায়ন করে যেতে পারবে না। তাই এ বাজেট কিছুটা রাজনৈতিক বিবেচনায় করা হয়েছে বলে মনে হয়। আকারে ঊর্ধ্বগতি আছে। ব্যয় বৃদ্ধির দিক থেকে অনেক বড় বাজেট। ব্যয় বৃদ্ধিকে খারাপ মনে করি না। নির্বাচন সামনে রেখে বাজেট বিধায় স্থানীয় সরকার পর্যায়ে উন্নয়ন বাজেট, বিশেষত এলজিইডির মাধ্যমে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে তার আকার অনেক বাড়বে। তবে তাতে গুণগত মান বজায় থাকবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। অর্থমন্ত্রী আগামী অর্থবছরের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৪০ শতাংশ হবে বলে আশা করেছেন। প্রবৃদ্ধি নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। অনেকে মনে করেন, এ লক্ষ্যমাত্রা রাজনৈতিক বিবেচনায় করা হয়েছে। এটা বাস্তবভিত্তিক হওয়া উচিত। এখন বিদায়ী অর্থবছরে ৭ দশমিক ২০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি যদি সত্যি সত্যি অর্জিত হয়, সেক্ষেত্রে ৭ দশমিক ৪০ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রা বেশি নয়। এডিপি বাস্তবায়ন হলে, বেসরকারি পর্যায় থেকে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ বাড়ানো গেলে, মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে থাকলে এবং রফতানিতে যে শ্লথগতি আছে তা দূর করা গেলে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে না। অর্থমন্ত্রী প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৫ শতাংশে সীমিত রাখার প্রস্তাব করেছেন। এটা অর্জন করতে পারলে খুবই ভালো হবে। যদিও চালসহ অন্য কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে বর্তমান মূল্যস্ফীতি অনেকটা চড়া। এটাকে সহনীয় পর্যায়ে রাখতে অনেক বাধা আছে। শেষ পর্যন্ত এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সরকারের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এদিকে রাজস্ব আদায় বাড়াতে গিয়ে সরকার ছোট ছোট কিছু খাত থেকে আয় বাড়ানোর চেষ্টা করেছে। এর মধ্যে একটা বড় ভুল পদক্ষেপ আছে। তা হল ব্যাংকের সঞ্চয়ের ওপর আবগারি শুল্ক বৃদ্ধি। এটা খুবই খারাপ হয়েছে। এটা মানুষকে বৈধ পন্থায় সঞ্চয় ও লেনদেনে নিরুত্সাহিত করবে। অবৈধ পথে লেনদেন বাড়বে, যা সরকারই নিরুত্সাহিত করে। কো-অপারেটিভসহ ডেসটিনি, যুবকের মতো ভুঁইফোড় কোম্পানির দিকে ঝুঁকে পড়বে মানুষ। অনেকে ব্যাংক থেকে টাকা সরিয়ে নেবে। অবৈধ অর্থনীতির আকার বড় হবে। যাকে আমরা মাটির নিচের অর্থনীতি বলি। বাজেটের বড় লক্ষ্য হওয়া উচিত মানুষের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন। এজন্য সরকারকে সামাজিক অবকাঠামো খাতে ব্যয় বাড়াতে আরও মনোযোগী হতে হবে। এজন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও দারিদ্র্যবিমোচনে সরকারকে বর্তমানের তুলনায় অনেকগুণ ব্যয় বরাদ্দ রাখতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য, শিক্ষায় জিডিপির আকারের ৬-৭ শতাংশ ব্যয় করার প্রয়োজন থাকলেও সরকার করছে মাত্র ২ শতাংশ। যেটা অনেক কম ও নিতান্তই স্বল্প। লেখক : ব্যবসায়ী
abdullahalmehedi@ymail.com