হাওর বার্তা ডেস্কঃ স্ত্রী মিতু হত্যার পর আলোচিত সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার এখন একটি বেসরকারি হাসপাতালে পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন। আগে শ্বশুরের বাসায় থাকলেও বর্তমানে দুই সন্তানকে নিয়ে আলাদা বাসায় থাকছেন। চাকরির পাশাপাশি সন্তানদের পড়াশোনাসহ সার্বিক বিষয় দেখভাল নিজেই করেন বাবুল আক্তার।
মাঝে মাঝে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বাচ্চাদের নিয়ে নানা খুনসুটির খবর জানান সাবেক এই পুলিশ কর্মকর্তা। এবার জানালেন বই পড়তে আগ্রহী বাচ্চাদের খবর। মঙ্গলবার রাতে নিজের ফেসবুকে বিস্তারিত একটি পোস্ট দেন তিনি। পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো:
পঞ্চাশের অপেক্ষায়…!
ছেলে আমার বেড়ে উঠছে ধীরে ধীরে, বাড়ছে তার পড়ে শেষ করা বইয়ের সংখ্যা। বিষন্নতা এবং ডিভাইস আসক্তি থেকে ছেলেমেয়েকে বের করে আনার মাধ্যম হিসেবে আমি বেছে নিয়েছি বই। শুরুর দিকে বাচ্চারা মোটেও বই পড়তে চাইতো না। তখন আমি তাদের দুজনকে কাছে নিয়ে নানা কসরতে বই পড়ে শুনাতাম। কখনও রাজকন্যা কাঁদছে বলে নিজেই কাঁদো কাঁদো হতাম আবার কখনোবা রাজা হেসে উঠল বলে নিজেই হেসে হেসে সাড়া হতাম। শরীর নাড়িয়ে গলা কাপিয়ে গল্পকে বই থেকে বের করে এনে দিতাম বাচ্চাদের দুই ঠোটের ফাঁকে, হাসিতে। সফদর আলীর আবিষ্কার পড়তে পড়তে আবিষ্কার করলাম ছেলেও বিজ্ঞানী হতে চায়। আর মেয়ে আমার আব্দুল হাই !! প্রায়ই সে কবিতা আওড়ায়….
“আব্দুল হাই করে খাই খাই,
এক্ষুনি খেয়ে বলে কিছু খাই নাই।”
এরপর এক অলস দুপুরে অবাক হয়ে দেখলাম ছেলে তার বোনকে কাছে নিয়ে গল্প পড়ে শুনাচ্ছে। নানা অঙ্গভঙ্গিমায় গল্পটাকে জীবন্ত করে দিচ্ছে। মনে কী যে আনন্দ খেলে গেল আমার! বুঝলাম আমি পেরেছি। শিখে নিলাম বাচ্চারা সত্যিই বায়বীয়, তাদের যে পরিবেশে রাখা হয়, তারা সেভাবেই বেড়ে উঠে।
গেল ৫জুন ছিল বাচ্চাদের মায়ের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। দিনটিতে আমরা এতিমখানার বাচ্চাদের সাথে ইফতার করি। আমরা তিনজন তাকিয়ে দেখে এতিম বাচ্চাদের সুখ-দুঃখ বুঝার চেষ্টা করি। ম্লান করে দিই নিজেদেরটা।
ছেলের বত্রিশটি বই পড়া শেষ হয়েছে। প্রতিটি বই পড়া শেষে সে একটি ডায়রিতে বইয়ের নাম ও পড়ে শেষ করার তারিখ লিখে রাখে। তাকে আরও উৎসাহিত করার জন্য বলেছি যেদিন পঞ্চাশটা বই পড়া শেষ হবে সেদিনটা আমরা উদযাপন করব ‘বই উৎসব’ নামে। যে গতিতে সে প্রতিদিন বই পড়ছে শিঘ্রই হয়তো তার গন্তব্যে পৌঁছে যাবে।
গত বইমেলায় আমরা কিছু বই কিনেছিলাম। সেগুলো পড়া শেষ হলে কয়েকদিন আগে গিয়েছিলাম বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে। সেখানে অনেক ভালো ভালো বই আছে তবে বাচ্চাদের বইয়ের সংখ্যা খুব বেশি না। তাছাড়া বাচ্চাদের বই নির্বাচনের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিৎ। কারণ, কিছু কিছু বই বাচ্চাদের পড়ে শোনাতে গিয়ে দেখি এমন কিছু কথা লেখা থাকে যা বয়স উপযোগী নয় এবং কচি মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। যেমন: রাজপুত্র রাজকন্যাকে বিয়ে করে সুখেশান্তিতে জীবন কাটাতে লাগল। অথবা রাজকন্যার রুপে মুগ্ধ হয়ে রাজপুত্র তার প্রেমে পড়ে গেল। এধরনের বয়স অনুপযোগী কোন কথা যখন গল্পে এসে যায় তখন আমি বাচ্চাদের যতটুকু সম্ভব বাস্তবতার আলোকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি।
বই কেনার চেষ্টা করি বাচ্চাদের পছন্দমত। এতে তারা পড়তে উৎসাহী হয়। বাচ্চারা তাদের পছন্দের বইটি বার বার পড়তে পছন্দ করে। এক মহাদানা মুত্তার গল্প কতবার যে পড়ে শুনিয়েছি এবং শুনেছি তার কোন ইয়ত্তা নেই।
বাচ্চারা যেহেতু অনুকরণপ্রিয় তাই আমি চেষ্টা করি তাদের সামনে পড়তে। হোক সেটা যে কোন বই বা পত্রিকা কিংবা ম্যাগাজিন বা ব্লগ, সন্তান যেন পড়ার প্রতি আমার উৎসাহটুকু বুঝে নিজের মাঝে লালন করতে পারে তাতে আমার চেষ্টা থাকে শতভাগ। কারণ সন্তান লালন করতে গিয়েই একজন পাঠক লালন করা সম্ভব। তাই আমি প্রতিদিনই তাদের গল্প পড়ে শোনাই।
শুরুতে পাঠক হলেও ক্রমে এই দায়িত্ব সন্তানের হাতে তুলে দিয়ে ইদানীং আমি মনোযোগী শ্রোতা। সে যখন দেখে যে আমি তার গল্প পড়া তার মতই উপভোগ করছি তখন সে আরও উদ্বুদ্ধ হয়। ফলাফল ছেলে সময় পেলেই বই নিয়ে বসে যায় আর মেয়ে তার ভাইয়ের সাথে গড়িয়ে গড়িয়ে সেই বইপড়া শুনে। মেয়েটা যদিও এখনো গল্প পড়তে পারে না তবে ছেলে যখন পড়ে, তখন সেও পড়ার চেষ্টা করে। অঙ্গভঙ্গিতে সে একজন ‘Mature’ পাঠক! সেদিন দেখলাম এক আত্মীয়ের বাচ্চাছেলেকে পাশে শুইয়ে গল্পপড়ে শুনাচ্ছে দু’ভাইবোন।
আবার পড়ার মত পরিবেশও চাই। ছিমছাম বইময় পরিবেশে যে কেউই বইপ্রেমী হবে। তাই ঘরে বইয়ের ছোঁয়া রেখেছি। পড়ার জন্য নির্দিষ্ট একটা রুম রেখেছি। সেখানে বাচ্চাদের বই রাখার আলাদা একটা সেলফ আছে, বই কিনে নিজেরাই সেখানে ইচ্ছেমত সাজায়, পছন্দমত বই নিয়ে পড়ে আবার নিজেরাই সুন্দরভাবে গুছিয়ে রাখে। তবে রাতে গল্প পড়ার আসর জমে শোবার ঘরের বিছানায়।
যতদূর সম্ভব চেষ্টা করি ‘পড়া’ বিষয়টিকে আনন্দময় করার। কখনও কখনও জ্যামে আটকে থাকলে বিরক্ত না হয়ে বরং বাচ্চার সাথে খেলার ছলে বিভিন্ন সাইনবোর্ড পড়ি। আবার রান্নার রেসিপি বা যে কোন প্যাকেট বা কাগজের লিখাও পড়ি একসাথে।
একটি বই নিয়ে সন্তানের সাথে বসে পড়া, এরপর কণ্ঠে সর্বোচ্চ আনন্দ মেখে পড়ে শুনানো, ঘোড়া ছুটছে বলে নিজের ছোটা, খুকু নাচছে বলে বাচ্চাদের সাথে নিয়ে নিজের নেচে উঠা; এসবের মধ্য দিয়েই তারা পরিচিত হয় নতুন এক আনন্দের সাথে যা রয়েছে কেবলই বইয়ের পাতায়।