হাওর বার্তা ডেস্কঃ লেখার শুরুতেই কালের কণ্ঠে প্রকাশিত (২৯ ডিসেম্বর ২০১৬) একটি প্রতিবেদনের কিছু অংশ তুলে ধরছি। প্রতিবেদনের শুরুতেই বলা হয়েছে, ‘বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশনে মোড়ানো ‘ই-টেন্ডারিং’ আর ‘ই-জিপি’র প্রভাবে বিপাকে পড়েছে বাংলাদেশের সংবাদপত্রশিল্প।
নিয়মনীতি না মেনে সরকারি সংস্থাগুলো দরপত্র আহ্বান ও ক্রয় বিজ্ঞপ্তির বিজ্ঞাপনগুলো ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেই দায় সারছে। সংবাদপত্রের জন্য ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ‘ই-টেন্ডার নোটিশ’ দেওয়ায় জনগণের তথ্য জানার অধিকার সংকুচিত হচ্ছে। আর আয়ের সবচেয়ে বড় খাতটি এভাবে সংকুচিত হওয়ায় অস্তিত্ব হারানোর শঙ্কায় ভুগছে সংবাদপত্রগুলো। ’
প্রিয় পাঠক, উপরোল্লিখিত অংশটুকু পড়লে যে কেউ উপলব্ধি করতে পারবেন যে কিভাবে সংবাদপত্রশিল্পকে ধ্বংসের চক্রান্ত শুরু হয়েছে। এর সঙ্গে বাড়তি যোগ হয়েছে প্রস্তাবিত ২০১৭-১৮ সালের বাজেটে সংবাদপত্র শিল্পের ওপর ভ্যাট। আমদানিকৃত কাগজের ওপর ধার্যকৃত ১৫% ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ও কালি, পিএস প্লেটের ওপরও বাড়তি ভ্যাটের বোঝা। তদুপরি সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিজ্ঞাপণের ওপর ১৫% মূসক দেশের প্রিন্ট মিডিয়ার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এতে যে শুধু ছোট সংবাদপত্রগুলো বন্ধ হয়ে যাবে তা নয়, বড় সংবাদপত্রগুলোও কঠিন অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হবে। ইতিমধ্যেই সে সংকট শুরু হয়েছে।
বিজ্ঞাপণের ওপর ১৫% ভ্যাট আবশ্যক করায় বিজ্ঞাপণ দাতারা নিরুৎসাহিত হবে, এতে বিজ্ঞাপণের সংখ্যা কমবে ফলে পত্রিকার আয়ও কমবে। বাড়তি খরচ সমন্বয় করতে পত্রিকার দাম বাড়ালে পাঠক কমবে, সার্কুলেশন কমবে।
সরকারি বিজ্ঞাপনের রেট বাড়ানো হলেও বিজ্ঞাপনের পরিমাণ ব্যাপক হারে কমিয়ে দেওয়ার কারণে আর্থিক সংকটে পড়েছে সংবাদপত্রগুলো। ২০১২-১৩ দুই বছরে পর্যায়ক্রমে অষ্টম ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়ন করে দেশের প্রথম শ্রেণির দৈনিকগুলো। ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অধিকাংশ পত্রিকা কর্তৃপক্ষকে লোক ছাঁটাইও করতে হয়। কারণ আয় ও ব্যয়ের সঙ্গে সমন্বয় সাধনের জন্য তাদের এই অমানবিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
সরকারি বিজ্ঞাপন কমতে কমতে এখন এমন অবস্থায় দাঁড়িয়েছে যে বড় পত্রিকাগুলোও মাসে দেড়-দুই লাখ টাকার বেশি বিজ্ঞাপন পায় না। তা ছাড়া আগে বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ করত ডিএফপি। এখন প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরাই বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে। প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা নিজেদের খেয়ালখুশিমতো দু-একটি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়। ফলে বেশির ভাগ পত্রিকা বঞ্চিত হচ্ছে। ডিএফপি বিজ্ঞাপন দেওয়ার ক্ষেত্রে একধরনের বণ্টনব্যবস্থা চালু রেখেছিল। সেখানেও যে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়নি তা নয়। তার পরও সার্কুলেশনের ভিত্তিতে যেভাবে বিজ্ঞাপন বণ্টন করা হতো তাতে সবাই সন্তুষ্ট ছিল। এখন যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, ছোট-বড় কেউ-ই আর টিকে থাকতে পারবে না।
ইদানীং সরকারি বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে আরেকটি ‘নতুন কৌশল’ নিয়েছেন কর্তাব্যক্তিরা। এ ক্ষেত্রে রেটের কোনো বালাই নেই। মন্ত্রণালয় কিংবা ওই মন্ত্রণালয়-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা বিজ্ঞাপন দেওয়ার ক্ষেত্রে দর-কষাকষি করেন। তাঁরা বলেন, ‘পূর্ণপৃষ্ঠা (রঙিন) এত টাকা দেব। ইচ্ছা হলে ছাপেন, না হলে দরকার নেই। ’
যেখানে সরকার বিজ্ঞাপনের রেট ঠিক করে দিয়েছে, সেখানে কেন দর-কষাকষি? পত্রিকার সার্কুলেশন অনুযায়ী যে পত্রিকার যত রেট, তা দেওয়া হবে—এটাই তো স্বাভাবিক! অথচ সরকারি বিজ্ঞাপন নিয়ে একধরনের তুঘলকি কাণ্ড চলছে। এমনও দেখা গেছে, একটি পত্রিকায় ক্রোড়পত্র দেওয়া হয়েছে। চিঠিও পাঠানো হয়েছে। কিন্তু ডিজাইন দেওয়ার সময় দেখা যায়, শেষ মুহূর্তে ওই পত্রিকার নাম কেটে অন্য পত্রিকাকে দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি ওই পত্রিকা কর্তৃপক্ষকে জানানোও হয় না।
পত্রিকার সার্কুলেশন অনুযায়ী কালের কণ্ঠ’র অবস্থান তৃতীয়। প্রথম অবস্থানে আছে আমাদের গ্রুপেরই (ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ) আরেকটি বাংলা দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন। আর দ্বিতীয় অবস্থানে প্রথম আলো। অনলাইন ভার্সনে প্রথমে অবস্থান করছে প্রথম আলো এবং দ্বিতীয় অবস্থানে কালের কণ্ঠ। বাংলাদেশে এলেক্সা র্যাংকিংয়ে কালের কণ্ঠ’র অবস্থান সাত। এর আগে আছে ইউটিউব, গুগলবিডি, গুগল, প্রথম আলো, ইয়াহু এবং ফেসবুক।
প্রতিদিন আমাদের অনলাইন পাঠকসংখ্যা গড়ে ২৩-২৪ লাখ। ফেসবুক ফ্যানসংখ্যার দিক থেকেও প্রথম আলোর পরই আমাদের অবস্থান। প্রায় ৭০ লাখ। কালের কণ্ঠ’র প্রতিটি প্রতিবেদন, নিবন্ধ ও ফিচার লাখ লাখ শেয়ার হয়। সে হিসাবে বলা যায়, প্রতিদিন কালের কণ্ঠ পড়েন কোটি পাঠক।
অথচ সরকারি বিজ্ঞাপন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আমরা অনেকটাই পিছিয়ে। এ ক্ষেত্রে একটি অশুভ শক্তি নেপথ্যে কাজ করছে বলে মনে হয়। ডিএফপি মিডিয়া লিস্টে আমাদের যে তৃতীয় অবস্থান, সেখান থেকে সরাতে অশুভ শক্তিটি নানামুখী অপতত্পরতা চালাচ্ছে। এই মহলটি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির সঙ্গে আঁতাত করে কালের কণ্ঠকে দুর্বল করতে চায়। কারণ কালের কণ্ঠ শুরু থেকেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়ে এসেছে। যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে অব্যাহতভাবে সমর্থন জানিয়ে আসছে। এ জন্য অপশক্তির হুমকি-ধমকি ও চোখরাঙানি সহ্য করতে হয়েছে এবং হচ্ছে। তার পরও আমরা আমাদের অবস্থান থেকে একচুলও নড়িনি।
স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিটিই সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করেছে। তারা বলছে, পত্রিকার কণ্ঠরোধ করার জন্য সরকার কৌশলে বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ করছে। কিন্তু আমার ধারণা, মিডিয়াবান্ধব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্যই এক শ্রেণির আমলা সুকৌশলে কাজটি করছেন। কেউ কেউ শেখ হাসিনার চেয়েও বেশি আওয়ামী লীগার হয়ে যত অকাজ-কুকাজ আছে তা করছেন। আবার প্রধানমন্ত্রীকে কুপরামর্শ দিয়ে ভুল পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করছেন।
ডিএফপির শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তার কথা জানি। তাঁকে মুখোশধারী ‘আওয়ামী কর্মকর্তা’ বলে অনেকে বলে থাকেন। তিনি হুটহাট কিছু পত্রিকার সার্কুলেশন সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়ে পত্রিকাগুলোর মধ্যে কোন্দল লাগিয়ে দিয়েছেন। একটি পত্রিকা ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তথ্যমন্ত্রীর কাছে তাঁর কর্মকাণ্ডের বিষয়ে নালিশ জানিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ওই পত্রিকার সার্কুলেশন প্রায় অর্ধ লাখ বাড়িয়ে দিয়েছেন। ব্যস, শুরু হয়ে গেল পত্রিকাগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব! এ ধরনের হীন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ওই কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন।
আমরা আশা করি, শিগগিরই ডিএফপি রাহুমুক্ত হবে এবং বিজ্ঞাপন বিলি-বণ্টনের দায়িত্ব ডিএফপির হাতে ন্যস্ত হবে। বিজ্ঞাপন দেওয়ার দায়িত্ব প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকলে দুর্নীতি ও অনিয়ম বেশি হবে। অবশ্য ইতিমধ্যেই দুর্নীতি-অনিয়মের অনেক অভিযোগ পাওয়া গেছে।
তা ছাড়া ই-টেন্ডারিং করা হলেও বিজ্ঞাপন দেওয়ার হার আগের মতোই রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রটিতেও যদি বিশ্বব্যাংক খবরদারি করে, তাহলে পত্রিকা পরিচালনার দায়িত্বও বিশ্বব্যাংকই পালন করুক! আমরা তো অতীতে দেখেছি, বিশ্বব্যাংকের খবরদারি-মাতব্বরির কারণে আমাদের অনেক ধরনের ক্ষতি হয়েছে। গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প শেষ মুহূর্তে বিশ্বব্যাংকের দ্বিমতের কারণে বাদ দিতে হয়েছে। পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকেও ঠুনকো অজুহাতে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। পরে যখন শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত নিলেন, নিজেরাই পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন করবেন, তখন আবার নাকে খত দিয়ে ফিরে আসে ব্যাংকটি।
আমার ধারণা, এখানে বিশ্বব্যাংকের কোনো দুরভিসন্ধি আছে। কুচক্রী মহলের মতো বিশ্বব্যাংক মিডিয়াকে সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে চায়। এই চক্রটিই মিডিয়াকে উসকানোর চেষ্টায় লিপ্ত। আবার বিজ্ঞাপন ব্যাপক হারে কমিয়ে মিডিয়াকে রুগ্ণ করার হীন চক্রান্তে লিপ্ত তারা।
সরকারি বিজ্ঞাপন ব্যাপক হারে কমিয়ে দেওয়ার কারণে সাংবাদপত্রশিল্প যখন ধুঁকছে, ঠিক তখনই আরেকটি ওয়েজ বোর্ডের আলোচনা শুরু করা হয়েছে। এ ধরনের তত্পরতা সংবাদপত্রশিল্পের জন্য অশুভ ইঙ্গিত বলে মনে করি। দেশের স্বার্থে, উন্নয়নের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে সংবাদপত্রশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এই শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হলে শুধু কয়েক হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা নয়, দেশও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
প্রিয় পাঠক, আপনারা সবাই জানেন যে এ দেশে সবার আগে সংবাদপত্রই তথ্য-প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিজেদের উন্নীত করেছে। সাংবাদপত্রের কারণেই দেশে তথ্য-প্রযুক্তি খাতটি দ্রুত অগ্রগতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যতেও সংবাদপত্রের সহায়তা লাগবে। সংবাদপত্র যদি রুগ্ণ হয়ে পড়ে, তাহলে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ার ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
আমরা মনে করি, এখনো বাংলাদেশ তথ্য-প্রযুক্তির ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়নি। অধিকাংশ মানুষই তথ্য-প্রযুক্তির সেবা থেকে বঞ্চিত। ই-টেন্ডারিং অবশ্যই আমরা সমর্থন করি। তবে এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংবাদপত্রকেও রাখতে হবে। তা না হলে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে না।
আমরা জানি, দেশে বেসরকারি বিজ্ঞাপনের বাজার খুবই সীমিত। কিছু বহুজাতিক কম্পানি, টেলিফোন কম্পানি, ব্যাংক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে। এখানেও অবশ্য সংবাদপত্রকে অনলাইনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এখন ফেসবুক-অনলাইনের দিকে বেশি ঝুঁকছে। ফলে সবদিক থেকেই সংবাদপত্রগুলো চাপের মুখে পড়েছে।
দেশের সংবাদপত্রশিল্পকে বাঁচাতে হলে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা লাগবে। মনে রাখতে হবে, সংবাদপত্র ব্যক্তিমালিকানায় পরিচালিত হলেও অন্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। অন্য ব্যবসার সঙ্গে সংবাদপত্রকে তুলনা করলে হবে না।
ভারত সরকার এখনো সংবাদপত্রশিল্পকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছে। আমাদের এখানে কেন নয়? বিষয়টি নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাববেন এবং সংবাদপত্রশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন।
এটা তো ঠিক, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে উদ্যোগী হয়ে সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট করেছেন। জাতীয় প্রেসক্লাবে সুউচ্চ মিডিয়া কমপ্লেক্স করার উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি থাকতে সংবাদপত্রশিল্প রুগ্ণ হবে, তা আমি বিশ্বাস করি না।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক