চিরতরে বিদায় নিচ্ছে ‘ছিটমহল’ শব্দটি। এরই বেড়াজালে আটকেপড়া কয়েক হাজার মানুষের স্বাধীন দেশে মুক্তভাবে পথচলা শুরু হবে আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরই। ছয় যুগ ধরে ছিটমহল নামে যে খাঁচায় তারা বন্দি ছিল, সেখান থেকে যেন পঙ্গু হয়েই বের হচ্ছে প্রায় অর্ধকোটি মানুষ। এদের পঙ্গুত্ব দূর করে বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডে থাকা মানুষের সঙ্গে সমতা আনতে হয়তো সময় লাগবে। তবে তাদের দাবি, বিশেষ উন্নয়ন প্যাকেজের মাধ্যমে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। ওইসব মানুষ পিছিয়ে পড়েছে শিক্ষা-দীক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগসহ সর্বক্ষেত্রে।
বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশে ১৬২টি ছিটমহলের মধ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ছিল ১১১টি। কাগজে-কলমে ১১১টি ছিটমহলের বাসিন্দারা ভারতীয় নাগরিক হলেও তাদের কিছুটা গোপন ও কিছুটা প্রকাশ্য বিচরণ ছিল বাংলাদেশ ভূখণ্ডে। এসব ছিটের মানুষের চোখের সামনে স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, পুলিশ, আদালত, হাটবাজারসহ সবই ছিল; কিন্তু সেসব থেকে সুযোগ-সুবিধা বা সেবা নেওয়ার কোনো অধিকার ছিল না তাদের। এ ধরনের কত না বঞ্চনা তাদের যুগের পর যুগ সহ্য করতে হয়েছে! তাদের মৌলিক চাহিদাগুলো ছিল একেবারে উপেক্ষিত। এর ফলে ওইসব ছিটমহল গড়ে উঠেছিল দুষ্কৃতকারীদের অভয়ারণ্যে।
পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার ছিটমহল শালবাড়ী ইউনিয়নের সচিব আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, আর কেউ নিজ ভূমে পরবাসী নয়। তাই দেবীগঞ্জ উপজেলার চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার পরামর্শ অনুযায়ী ইউনিয়নটির যোগাযোগ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়ে প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরি করে জমা দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে ওই ছিটমহলের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম জানান, শালবাড়ি, কাজলদীঘি, বেউলাডাঙ্গা ও নাটকটোকা নিয়ে গঠিত এই ছিটমহল ইউনিয়নটিতে প্রাইমারি স্কুল আটটি, হাইস্কুল তিনটি এবং একটি কলেজ স্থাপনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ, ব্রিজ-কালভার্টসহ রাস্তা নির্মাণের প্রস্তাব।
এ ব্যাপারে দেবীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান হাসনাত জামান চৌধুরী জজ বলেন, জেলা প্রশাসন এরই মধ্যে কয়েক দফা মিটিং করে উন্নয়নকাজের ফিরিস্তি সংগ্রহ করেছেন। সেখানে রয়েছে কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইন-শৃঙ্খলা উন্নয়ন এবং স্থানীয় সরকারের কাঠামো গড়ার পরিকল্পনা, যাতে সরকারের ঘোষণা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত সেসব বাস্তবায়ন করা যায়। পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট গোলাম আজম জানান, তারা আর ছিটমহলের বাসিন্দা থাকছেন না। নিয়ম অনুযায়ী দেশের সব সুযোগ-সুবিধাই তারা পাবেন। ১১১ ছিটমহলের মধ্যে চারটি রয়েছে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলায়। সবচেয়ে ছোট্ট এসব ছিটমহলের
বাসিন্দার সংখ্যা হচ্ছে ৫৪৫। সেখানকার জিগাবাড়ি এলাকার জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘আগত মুই হাফ বাংলাদেশি আছুনু। এখন পুরা হয়া গ্যাছু। এখন হামার ছাওয়ালগুলাক যদি ইসকুল ও কলেজোত ভর্তি করি বিনা টাকাত পড়াইলে হয়, তা-হইলে হামরা অ্যানা জলদি আগেবার পাইনো হয়।’ ওইসব এলাকায় এরই মধ্যে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে পাঁচটি শিক্ষাকেন্দ্র চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান নীলফামারী জেলা ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপপরিচালক মো. সাইদুর রহমান।
ছিটমহল বিনিময় আন্দোলনের উপদেষ্টা আব্রাহাম লিঙ্কন বলেন, ৬৮ বছর ধরে পিছিয়ে থাকা মানুষদেরকে দেশের মূলধারার সঙ্গে সমন্বয় করতে হলে তাদের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিশেষ বরাদ্দ রেখে পরিকল্পনা নিতে হবে। তিনি বলেন, রাস্তাঘাট, শিক্ষা, চিকিৎসা, খাদ্য নিরাপত্তা দ্রুত নিশ্চিত করতে হবে। একই কথা বলেন বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা। তিনি বলেন, পশ্চাৎপদ ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসেবে চিহ্নিত করে আমাদের এগিয়ে নিতে উন্নয়নের প্যাকেজ ঘোষণা দিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
কুড়িগ্রামের সবচেয়ে বড় ছিটমহল ফুলবাড়ী উপজেলার দাসিয়ারছড়ার অধিবাসীরা মনে করেন, সবার আগে শিক্ষা প্রয়োজন। এ জন্য তারা এরই মধ্যে নিজ উদ্যোগে ও নিজস্ব জমিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কাজ শুরু করেছেন। ফুলবাড়ী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন মাহমুদ জানান, অন্ধকারে ডুবে থাকা এই ছিটমহলের (দাসিয়ারছড়া) বাসিন্দাদের আলোর মুখ দেখাতে গ্রহণ করা হচ্ছে একাধিক উন্নয়ন পরিকল্পনা। এ পরিকল্পনায় রয়েছে সরকারি-বেসরকারিসহ সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো। এখন চলছে তালিকা তৈরির কাজ। এ জন্য সব মিলিয়ে প্রায় ৮৫ কোটি টাকার চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে।
প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন সফিকুল আলম ও শাহিনুর রহমান শাহিন