ফুলেল সড়কে স্বস্তির যাত্রা

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক নিয়ে যাঁদের তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে, নিঃসন্দেহে তাঁদের কাছে এখন অচেনা মনে হবে মহাসড়ক। একসময়ের ধুলোবালিতে নাকাল মহাসড়কের ডিভাইডারে শোভা পাচ্ছে নানা রঙের ফুল আর শোভাবর্ধন গাছের চারা। যাত্রাপথে বকুল, কৃষ্ণচূড়া, সোনালু, জারুল, রাধাচূড়া, করবী, হৈমন্তী, কুরচী, কাঞ্চন আর পলাশ ফুলের গন্ধ, রূপ, লাবণ্য যে কাউকে মোহিত করবেই।

সরেজমিন দেখা যায়, মিরসরাইয়ের বড়তাকিয়া বাজারের দক্ষিণ পাশ থেকে হাদিফকিরহাট বাজারের উত্তরপাশ পর্যন্ত মহাসড়কের ডিভাইডারে ফুটেছে নানা রঙের ফুল। এছাড়া সীতাকুণ্ডের কুমিরা এলাকায় মহাসড়কের ডিভাইডারে শোভা পাচ্ছে মৌসুমি ফুল। যা যাত্রাপথে যাত্রীদের সুবাসিত করছে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম চারলেন প্রকল্প কর্তৃপক্ষ জানায়, গত বর্ষা মৌসুমে মহাসড়কের ১৪৩.৪ কিলোমিটার এলাকার ডিভাইডারে লাগানো হয় নানা রঙের ফুল আর নানা জাতের শোভাবর্ধন গাছের চারা ও সবুজ ঘাস।

প্রকল্পের চট্টগ্রাম অঞ্চলের অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক অরুণ আলো চাকমা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম অঞ্চলে মোট চারটি আলাদা প্যাকেজে ফুল গাছের চারা, কাঠ গাছের চারা ও সবুজ ঘাস লাগানোর কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়। এসব চারা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রাখা হয়েছে আলাদা বিভাগ। প্যাকেজগুলো বাস্তবায়ন করছে সাগর বিল্ডার্স নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। আগামী জুলাই পর্যন্ত তারা এগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করবে। এরপর এটি দেখভাল করবে সরকারের সড়ক বিভাগ। ’

মাত্র দুই বছর আগেও চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যেতে লাগতো সাত থেকে আট ঘণ্টা। এছাড়া পথে যানজট নাগাল পেলে সময় আরো দীর্ঘ এমনকি যাত্রাও অনিশ্চিত হয়ে পড়ত। ওই পথে নিয়মিত চলাচল করে এমন বাস সার্ভিস সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চট্টগ্রাম সিটি গেট থেকে ঢাকার যাত্রাবাড়ি যেতে একসময় অন্তত আট ঘণ্টা সময় লাগত। বর্তমানে তা পাঁচ ঘণ্টায় নেমে এসেছে। রাতে আরো সময় কম লাগে। এছাড়া চট্টগ্রাম সিটি গেট থেকে মিরসরাই পর্যন্ত যেতে আগে তিন ঘণ্টারও বেশি লাগলেও এখন লাগে মাত্র ৫৫ থেকে ৬০ মিনিট। ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে চলাচলকারী সৌদিয়া চেয়ারকোচ বাস সার্ভিসের মিরসরাইয়ের মিঠাছড়া টিকিট কাউন্টারের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ সুজন বলেন, ‘একসময় যাত্রীদের বাসে তুলে দেওয়ার পর অপেক্ষা করতাম বাসটি ঢাকায় পৌঁছেছে কিনা। এখন যাত্রীরা খুব আরামে সময় মতো গন্তব্যে পৌঁছে যায়। এতে আমরাও লাভবান হচ্ছি। ’

চট্টগ্রাম নগরীর মাদারবাড়ি বাসস্ট্যান্ড থেকে মিরসরাইয়ের বারইয়ারহাট রুটে চলাচলকারী চয়েস বাসের চালক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আগে শুধু সময় বেশি লাগত তা নয়। সড়কে বড় বড় গর্তে পড়ে বাস নষ্ট হয়ে যেত। এখন আগের মতো সমস্যা নেই। আমরা ৫৫ থেকে ৬০ মিনিটের মধ্যে সিটি গেট থেকে বারইয়ারহাট পৌঁছে যাই। ’

মিরসরাই উপজেলার মিঠানালা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান খায়রুল আলম পরিবার নিয়ে থাকেন চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহর এলাকায়। প্রতিদিন তিনি নগরীর বড়পোল এলাকা থেকে স্টারলাইন বাসে যান মিরসরাই। সন্ধ্যায় ইউনিয়ন পরিষদের কাজকর্ম সেরে পুনরায় ফেরেন নগরীতে। আগের মহাসড়ক আর এখনকার মহাসড়কে আসমান-জমিন পার্থক্য খুঁজে পান স্থানীয় এই জনপ্রতিনিধি। তাঁর কথায়, ‘আগের অবস্থা থাকলে শহর থেকে যাতায়াত দূরের কথা কল্পনাও করা যেত না। একসময় চট্টগ্রামের বড়পোল থেকে মিরসরাইয়ের সুফিয়া রোড এলাকা পর্যন্ত যেতে কখনো তিন ঘণ্টা, কখনো আরো বেশি সময় লাগতো। বর্তমানে ৫০ থেকে ৫৫ মিনিট সময় লাগে। এছাড়া ঠিক সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানোর ব্যাপারে নিশ্চিত থাকা যায়। ’

এদিকে কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে চট্টগ্রাম সিটিগেট পর্যন্ত ১৯২ কিলোমিটার মহাসড়ক চারলেনে রূপ নেওয়ার পর নগরীর অনেক চাকরিজীবী পরিবার পরিজন নিয়ে গ্রামে বসবাস শুরু করেছেন। বিশেষ করে চট্টগ্রামের মিরসরাই-সীতাকুণ্ড এলাকায় বাড়ি এমন চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ীর অনেকে প্রতিদিন সকাল-বিকেল আসা-যাওয়া করছেন।

দৈনিক জনকণ্ঠের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক হাসান নাসিরের কর্মক্ষেত্র চট্টগ্রামের লাভলেন এলাকায়। সাংবাদিকতা জীবনের অনেক বছর তিনি কাটিয়েছেন নগরীতে। গত বছর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চারলেন যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার পর তিনি প্রতিদিন গ্রামের বাড়ি মিরসরাইয়ের হাদিফকির হাট থেকে নগরীতে আসা-যাওয়া করছেন।

সাংবাদিক হাসান নাসির বলেন, ‘চারলেন প্রকল্প চালু হওয়ার পর থেকে বাড়ি থেকে প্রতিদিন আসা-যাওয়া করছি। আগে কোনো সময় রাত আটটায় বাসে উঠলে সেই বাস গন্তব্যে (মিরসরাই) পৌঁছাত সকাল আটটায়! এখন যাতায়াত অনেক সহজ হয়েছে। মাত্র এক ঘণ্টায় বাড়ি থেকে অফিসে যাওয়া যায়। রাতে ফিরতেও তেমন ঝামেলা হয় না। এতে অন্তত নগরজীবনের কোলাহল থেকে মুক্ত পরিবেশে নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ হয়েছে। ’

ফিরে দেখা

সময়ের সঙ্গে সমান্তরাল গতিতে মহাকালের গর্ভে হারিয়ে যায় অনেক যন্ত্রণা। কিন্তু খানিকটা বিরতি দিয়ে বছরজুড়ে ফিরে ফিরে আসত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের দুর্ভোগ। এছাড়া তীব্র যানজট ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। সেই সময় চট্টগ্রাম অঞ্চলের অন্তত সাত পয়েন্টে বছর ঘুরতেই দেখা দিত খানাখন্দ। এসব স্পটে বিকল হয়ে আটকা পড়ত যানবাহন। সৃষ্টি হত তীব্র যানজট। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কখনো দিনরাত সচল হতো না যান চলাচল। পরদিন যানজটের ঘটনা শিরোনাম হতো দৈনিকগুলোতে।

যে কটি স্থানে খানাখন্দের কারণে যানজট তীব্র হতো সেগুলো হল সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী, বাড়বকুণ্ড, সীতাকুণ্ড সদর, বড়দারোগারহাট ওভারলোডিং স্কেল, মিরসরাইয়ের হাদিফকিরহাট, মিরসরাই পৌরসদর, মিঠাছড়া ও বারইয়ারহাট পৌরসদর। এসব স্থানে একটু বৃষ্টি হলেই সৃষ্টি হত শত শত খনাখন্দ। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দফায় দফায় মেরামতের চেষ্টা করলেও পরের বৃষ্টিতে আবারও আগের অবস্থা ফিরে আসত। বড় ধরনের মেরামতও বেশিদিন টিকতো না। ফলে সৃষ্টি হতো যানজট। মাইলের পর মাইল চোখে পড়তো যাত্রাপথে মানুষের হাহাকার।

ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের লরিচালক জসিম উদ্দিন সেই সময়কার তিক্ত স্মৃতি ভুলে থাকতে চান। বলেন, ‘ভাইরে আগের দিনের ওইসব কথা এখন বইলা লাভ নাই। এখন আরামে গাড়ি চালাই। সময় মতো মাল ডেলিভারি দিই। শুধু এখন রাস্তায় পুলিশ একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করে!’

ব্যবসায়ীদের চোখে সুফল

দেশের আমদানি-রপ্তানির মালামাল পরিবহনের অন্যতম মাধ্যম ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। সড়কটি চারলেনে উন্নীত করার প্রধান লক্ষ্য দেশের পণ্য পরিবহনে গতি ফিরিয়ে আনা। দেরিতে হলেও এটি বাস্তবায়ন হওয়ায় সন্তুষ্ট ব্যবসায়ীরা। তবে কেউ কেউ মহাসড়কে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা হাইওয়ে পুলিশের কর্মকাণ্ডে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

চারলেন প্রকল্পের সুফল নিয়ে তরুণ উদ্যোক্তা, জুনিয়র চেম্বার চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট নিয়াজ মোর্শেদ এলিট কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রকল্পটি চালু হওয়ার পর থেকে আমদানি-রপ্তানির পণ্য পরিবহনে বেশ সুফল পাওয়া যাচ্ছে। তবে সড়কের নিরপত্তার দায়িত্বে থাকা হাইওয়ে পুলিশ সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছে না। কিছু ক্ষেত্রে তারা পরিবহন চালকদের হয়রানি করছে। ’

চারলেন প্রকল্পের আদ্যোপান্ত

দুই হাজার ৩৮২ কোটি টাকা বরাদ্দে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাজ শুরু হয় ২০১০ সালের ডিসেম্বরে। ১৯২.৩০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সড়কটি ১০টি প্যাকেজে বাস্তবায়নের কাজ পায় দেশি-বিদেশি তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কুমিল্লার দাউদকান্দির মেঘনা-গোমতী সেতুর টোল প্লাজা থেকে চট্টগ্রাম সিটি গেট পর্যন্ত প্রকল্পটির সাত ভাগ নির্মাণের দায়িত্ব পায় চায়না ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিনে হাইড্রো, দুই ভাগ কাজ পায় দেশি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রেজা কনস্ট্রাকশন এবং সীতাকুণ্ড অংশে এক ভাগ কাজ পায় দেশি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাহের অ্যান্ড ব্রাদার্স। দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী ওই তিন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাদের কাছে ন্যস্ত কাজ শেষ করার কথা তিন বছর পর অর্থাৎ ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে। কাজের শুরু ও মাঝামাঝিতে নানা টালবাহানা করে চায়না প্রতিষ্ঠান সিনে হাইড্রো। এছাড়া পরামর্শক নিয়োগ, অর্থছাড়, পাথর আমদানি, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, মাটি সংকটসহ নানা জটিলতায় দফায় দফায় কাজের মেয়াদ বাড়ানো হয়। পরে পূর্ণাঙ্গ কাজ শেষ না করেই ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ২০১৬ সালের ২ জুলাই সড়কটি আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বর্তমানে সীতাকুণ্ডের কালুশাহ্ মাজার এলাকার রেলওয়ে ওভারপাস, মহিপালের উত্তরপাশের রেলওয়ে ওভারপাস ও ফেনীর মহিপাল উড়াল সেতু ছাড়া বাকি কাজ শেষ হয়েছে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চারলেন প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা হয়েছে ২৩ সেতু, ২৩২ কালভার্ট, তিন রেলওয়ে ওভারপাস, ১৪ বাইপাস সড়ক, স্টিল ফুট ওভারব্রিজ ৩৩, আন্ডারপাস দুটি এবং ৬১টি বাস স্টপেজ।

হাইওয়ে পুলিশের বক্তব্য

চারলেন প্রকল্প বাস্তবায়নের পর থেকে মহাসড়কের নিরাপত্তার স্বার্থে নতুন নতুন পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে হাইওয়ে পুলিশের কুমিল্লা রিজিয়নের পুলিশ সুপার (এসপি) পরিতোষ ঘোষ, রেজাউল করিম বলেন, ‘নিরাপত্তার স্বার্থে মহাসড়কের পাশের ফুয়েল স্টেশন ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা মালিকদের সিসি ক্যামেরা স্থাপনে আমরা উদ্বুদ্ধ করছি। যানবাহনের গতিরোধে অত্যাধুুনিক প্রযুক্তির ক্যামেরাযুক্ত স্পিডগান ও সড়কে অদৃশ্য রাডার স্পিডগান ব্যবহারের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। ’

চারলেন প্রকল্প চালুর পর থেকে পরিবহন সেক্টর ভালো সুফল পাচ্ছে জানিয়ে হাইওয়ে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন ‘একসময় মহাসড়কে যাত্রা মানেই ছিল ভোগান্তি। বর্তমানে আগের থেকে অর্ধেক সময়ে মানুষ তার গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে। ’

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর