নানা অনিয়ম, অভিযোগ ও অব্যবস্থাপনার দায়ে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেডকে (বিটিসিএল) দেওয়া ঋণের টাকা ফেরত নিল জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। অব্যবস্থাপনা বিষয়ে দফায় দফায় সতর্ক করেও কোনো কূলকিনারা না পেয়ে এ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে বাংলাদেশের উন্নয়ন-সহযোগী বিদেশি এই সংস্থাটি। একই সঙ্গে জাইকার পক্ষ থেকে ভবিষ্যতে যাতে এর পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে জন্য ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং বিটিসিএলকে এ ঘটনা থেকে ‘শিক্ষা’ নিতে বলা হয়েছে। বিটিসিএলের আধুনিকায়নে ‘লট-বি’ প্রকল্পের আওতায় দেশের ভিতর এবং আন্তর্জাতিক প্রবেশপথগুলোর মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ স্থাপনের জন্য ২০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছিল জাইকা।
বিটিসিএলের প্রকল্প পরিচালক অশোক কুমার মণ্ডল বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে জাইকার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত-সংক্রান্ত চিঠিটি হাতে পাওয়ার কথা গতকাল স্বীকার করেন। তিনি জানান, সোমবার অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) পক্ষ থেকেও তিনি একটি চিঠি পেয়েছেন, যেখানে বলা হয়েছে, ‘লট-বির জন্য বরাদ্দকৃত সব ঋণ তুলে নেওয়া হলো।’ বিটিসিএলকে যুগের সঙ্গে টিকিয়ে রাখার প্রশ্নে অপরিহার্য এই উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে এখন কী করবেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, অন্য প্রকল্পের তহবিল থেকে টাকা বাঁচিয়ে বা নিজস্ব অর্থায়নে এ কাজ সম্পন্ন করা হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ৭ মে ইআরডির সিনিয়র সচিবকে দেওয়া এক চিঠিতে বাংলাদেশে নিযুক্ত জাইকার প্রধান মিকিও হাতাইদা জানান, বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও বিটিসিএল লট-বি বাস্তবায়নে ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় জাপান সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রকল্পের ঋণের টাকা ফেরতের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ওই চিঠিতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে জন্য এ সিদ্ধান্ত থেকে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং বিটিসিএলকে শিক্ষা নিতেও বলা হয়। অপর একটি সূত্র বলছে, জাইকার এই চিঠি পাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়। সূত্র বলছে, ওই প্রতিবেদনেও বিটিসিএলের অব্যবস্থাপনার বিষয়টি উঠে আসে। বিটিসিএল সূত্রে জানা গেছে, ২০০৬ সালের জুনে বাংলাদেশ সরকার ও জাইকার মধ্যে ৮.০৪ বিলিয়ন ইয়েনের ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। শর্তানুযায়ী বিটিটিবি রূপান্তরিত হয় বিটিসিএলে এবং ২০০৮ সালের জুলাই তা কার্যকর হয়। সম্পূর্ণ জাইকার অর্থায়নে বিটিসিএলকে ‘টেলিকমিউনিকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প’ বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই প্রকল্পের দুটি অংশ। প্রথমটি এঙ্চেঞ্জ, আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি ইত্যাদি স্থাপন (লট-এ) এবং অপরটি সারা বাংলাদেশে ট্রান্সমিশন ব্যাকবোন তৈরি (লট-বি)। জাইকার সঙ্গে ২ জুন লট-বি প্রকল্পের ঋণ চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। এরই মধ্যে ঊধর্্বতন কর্মকর্তাদের একটি সিন্ডিকেট নিজেদের প্রতিষ্ঠানকে প্রকল্পের কাজ পাইয়ে দিতে টেন্ডারের কাগজ পরিবর্তন, সরকার স্বাক্ষরিত ঋণচুক্তি এবং জাইকার নির্দেশনা ভঙ্গ, জাইকাকে মিথ্যা তথ্য প্রদান, চুক্তি স্বাক্ষরে জালিয়াতিসহ নানা অভিযোগে দুষ্ট হয়। এসব নিয়ে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হওয়ায় পাঁচ মাস ধরে অনানুষ্ঠানিকভাবে তাগাদা দিয়ে আসছিল ক্ষুব্ধ জাইকা। এ নিয়ে ১৮ জানুয়ারি বিটিসিএল, ২২ জানুয়ারি ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং ১৬ ফেব্রুয়ারি ইআরডির সচিবকে চিঠি দেয় জাইকা। কিন্তু এতেও টনক নড়েনি বিটিসিএল কর্মকর্তাদের। অভিযোগ উঠেছে, নিজেদের খুশিমতো চলতে না পেরে বিটিসিএল একপর্যায়ে নিজেরাই আর জাইকার সঙ্গে কাজ করতে চাইছিল না। নিজস্ব তহবিল ব্যবহার করে পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিয়ে প্রকল্প সম্পন্ন করতেই বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছিল তারা। জানা গেছে, মাত্র শূন্য দশমিক ১ শতাংশ সুদে ৩০ বছরে পরিশোধযোগ্য ঋণের মাধ্যমে এ প্রকল্প বাস্তবায়নে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল জাইকা। এর ভিত্তিতে ২০১১ সালের মাঝামাঝি সময়ে লট-বি প্রকল্পের প্রাক-যোগ্যতার দরপত্র আহ্বান করা হয়। পছন্দের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে উচ্চমূল্যে কাজ দিতে প্রাক-যোগ্য দরপত্রে নেটাস নামে তুরস্কের একটি প্রতিষ্ঠানকে যাচাই পর্যায়ে বাদ দেয় বিটিসিএল। এর পর থেকেই সমস্যা শুরু হয়। প্রাক-যোগ্যতায় বাদ পড়ার পর নেটাস সরকার-গঠিত রিভিউ প্যানেলের কাছে এর প্রতিকার চায়। বিচারে রিভিউ প্যানেল নেটাসকে প্রাক-যোগ্য ঘোষণা করে আদেশ দেয়। এর পরও বিটিসিএল নমনীয় হয়নি। প্রাক-যোগ্য ঘোষণা করেনি নেটাসকে। এরই মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করে। দুদকের হাত থেকে বাঁচতে বিটিসিএল রিভিউ প্যানেলের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট এবং পরে আপিল বিভাগে আপিল করে। বিচারে হাইকোর্ট রিভিউ প্যানেলের সিদ্ধান্ত সঠিক বলে নেটাসের পক্ষে রায় দেন। পরে আপিল বিভাগ বিটিসিএলের আপিল খারিজ করে দিয়ে নেটাসকে প্রাক-যোগ্য ঘোষণা করে পুনঃ দরপত্রের নির্দেশ দেন। এভাবে পুনঃ দরপত্র আহ্বানের নামে সময় পেরিয়ে যায় তিন বছর। এরপর আপিল বিভাগের আদেশ আমলে না নিয়ে কার্যাদেশ না দেওয়ার চেষ্টায় কেটে যায় আরও এক বছর। সব মিলিয়ে ঋণ চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে এলেও শুরু হয় না কাজ। টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, শুরুতে এ প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ঠিক করা হয়েছিল ১ কোটি ৩৫ লাখ ৩০ হাজার ডলার বা ১১১ কোটি টাকা। নেটাসকে প্রাক-যোগ্যতায় বাদ দিয়েই তড়িঘড়ি করে প্রকল্পের ব্যয় ১ কোটি ১১ লাখ ৭ হাজার ডলার বাড়িয়ে ২ কোটি ৪৭ লাখ ৩০ হাজার ডলার বা ২০০ কোটি ৯৯ লাখ টাকা করে বিটিসিএল। এরপর জাপানের এনইসি এবং কোরিয়ান কেটির মধ্যে দরপত্র ডাকে বিটিসিএল। ততক্ষণে এ প্রকল্পের সঙ্গে না থাকার সিদ্ধান্ত নেয় জাইকা। ফলে চার বছর অতিবাহিত হলেও শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখেনি। এদিকে লট-বি প্রকল্পের কাজ ভেস্তে যাওয়ায় লট-এ অংশের কাজও কোনো কাজে আসবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। লট-এ অংশের কাজ শেষ হলেও দৃশ্যত সব কাজ হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে প্রকল্প পরিচালক অশোক মণ্ডল এ বিষয়ে বলেন, তিনি আরও ছয় মাস সময় নিয়েছেন। এর আগে মার্চ মাসে এ অংশের ৯৬ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে বলে বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে দাবি করেছিলেন তিনি।
লোকসান অব্যাহত : প্রকল্প বাস্তবায়ন ছাড়াও কর্মকর্তাদের অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা, অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা, বিল চুরিসহ নানা অভিযোগে বছরের পর বছর লোকসান গুনছে সরকারের এই প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিবছরই কমছে এর গ্রাহকসংখ্যা। সংস্থার সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ১৪ লাখ ৫৫ হাজার সংযোগক্ষমতার বিপরীতে সংযোগ রয়েছে মাত্র ৮ লাখ তিন হাজার। সংযোগক্ষমতা পুরোপুরি ব্যবহার না হওয়ায় সংস্থাটির আয়েও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল এক হাজার ৩০৬ কোটি টাকা, যার বিপরীতে এক হাজার পাঁচ কোটি টাকা আয় করতে পেরেছিল সংস্থাটি। ওই বছর সংস্থাটির ব্যয় হয়েছিল এক হাজার ৩৮৪ কোটি টাকা। সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ৩৬৮ কোটি টাকা আয়ের বিপরীতে ব্যয় হয়েছে ৪০১ কোটি টাকা। এভাবে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ধারাবাহিক লোকসানে ধুঁকছে বিটিসিএল। বরাবরই প্রতিষ্ঠানটির আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হচ্ছে।