ঢাকা ০১:৫৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১১ জানুয়ারী ২০২৫, ২৭ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মা বলে দিতেন একটু বড় মাছ না দেখলে ডাকবি না

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৭:১৮:০১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৭ জুলাই ২০১৫
  • ৪০৫ বার

স্কুলের ছুটির সময় জলপাইগুড়ি থেকে চা বাগানের বাড়িতে গেলে মনে হতো আমার মতো সুখী আর ক’জন আছে? সাধারণত পরীক্ষার পরে যেতাম বলে পড়ার চাপ থাকত না। ভরবিকালে মা একটা দায়িত্ব দিতেন। কোয়ার্টার্সের বারান্দায় বসে সামনের হাইওয়ের ওপর নজর রাখতে হবে। বিকালের ছায়া ঘনালেই ডুডুয়া থেকে মাছ ধরে হাইওয়েতে হেঁটে বাজারের দিকে যায় যারা তাদের ধরতে হবে। সাধারণত বুধ থেকে শুক্রবার এভাবে মাছ কেনা হয়। কোয়ার্টার্সের সামনে মাঠ, মাঠের পরেই হাইওয়ে। দু’পাশে লম্বা লম্বা প্রাচীন গাছের সারি। মাঝেমধ্যে কোনো গাড়ি বা বাস হুস করে বেরিয়ে যায় হাইওয়ে দিয়ে। পাখির চিৎকার ছাড়া কোনো শব্দ নেই। মানুষ দেখা যায় কদাচিৎ। হঠাৎ দূরে জাল কাঁধে হাতে ব্যাগ ঝুলিয়ে কাউকে আসতে দেখলেই ছুটে যেতাম হাইওয়েতে। মা বলে দিতেন একটু বড় মাছ না দেখলে ডাকবি না। বড় মাছ বলতে পাথরঠোকা, যাকে ঝিলা বলত কেউ কেউ, পুঁটি, বান মাছ। আর থাকত অজস কুঁচো চিংড়ি। মাছের আকৃতি দেখে ডেকে নিয়ে আসতাম লোকটাকে। ঘুমভাঙা চোখে মা মাছ দেখে খুশি হলে দর করতেন। সেই দরাদরি চলত বেশ কিছুক্ষণ। দুই সের মাছ আড়াই টাকায় কিনতেন মা। তখন ভালো চাল আড়াই টাকায় পাঁচ সের পাওয়া যেত।

এখন ফিরে দেখলে মনে হয়, সে বড় সুখের সময় ছিল। অথচ বাড়িতে ফ্রিজ ছিল না যে রেখে ক’দিন ধরে খাওয়া যাবে! সে সময় বিদ্যুতের আলোর বদলে হ্যারিকেন ছিল। নানান সাইজের হ্যারিকেন। তাতে জোরালো আলো ঘরে ছড়াত কিন্তু জানালার বাইরেটা রহস্যময় অন্ধকারে ডুবে থাকত। সে এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি। এখন ভাবী, গরমকালে বিদ্যুৎ না থাকার কারণে পাখার হাওয়া পাওয়ার কথা ভাবতামই না। কিন্তু তার জন্য কোনো কষ্ট হতো না। এটাই বোধহয় জীবনের ধর্ম। আমার সামনে কিছু একটা আছে যা আমাকে আনন্দিত করতে পারে কিন্তু সেটা আমি যখন পাচ্ছি না তখন তীব্র কষ্ট হয়, পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে সাধ্যের বাইরেও চলে যাই কখনো কখনো। অথচ সেইরকম কিছুর অস্তিত্ব যদি আমার জানা না থাকে, কেউ যদি সেসবের প্রলোভন না দেখায় তাহলে আমি যা নিয়ে আছি তাতেই সুখে থাকব, অভাববোধ তৈরি হবে না। অতএব ফ্রিজ বা পাখা ছাড়াই দিব্যি চলে যেত আমাদের।

হাট বসত রবিবারে। হাট না বলে উৎসব বলাই ভালো। বেলা ১০টার মধ্যে দূর দূর থেকে লরিতে ব্যাপারীরা মালপত্র নিয়ে এসে হাটে দোকান সাজাত। আশপাশের চা বাগানগুলো থেকে মানুষ আসতেন কেনাকাটা করতে। বাবা কাজের লোককে নিয়ে একপ্রস্থ বাজার করে এসে আবার যেতেন মাছ কিনতে। এই পর্ব শেষ হতো দুপুর দেড়টায়। আড়াইটা-তিনটার সময় হাটের চেহারা বদলে যেত। শাকসবজি বা মাছের ব্যাপারীরা তাদের বিক্রি না হওয়া জিনিসপত্র লরিতে চাপাত। আর তাদের জায়গাগুলো দখল করত শৌখিন জিনিসের দোকানগুলো। হিমালয় পাউডার, আফগান স্নো, রঙিন সুদৃশ্য মোড়কের সাবানের পাশে অগুরু সেন্ট যেমন থাকত, তেমনি মেয়েদের জন্য নানান সাজগোজের জিনিসও সাজানো হতো। এই হাটের ক্রেতা ছিল মূলত মদেশিয়া বা নেপালি মেয়েরা। ওরা দল বেঁধে আসত, পছন্দের সময় বিস্তর হাসাহাসি করত। আমার মনে পড়ে না, কোনো বাঙালি পরিবারের মেয়েকে রবিবারের বিকালের হাটে কেনাকাটা করতে দেখেছি বলে। পরে জেনেছি, ওই পাউডার, স্নো, সাবান বা সেন্ট যতই লোভনীয় হোক না কেন, তাদের মান নিয়ে অনেকের সন্দেহ ছিল। কিন্তু সেই বালক বয়সে ওই বস্তুগুলো আমার খুব পছন্দ হতো। বিশেষ করে অগুরু সেন্ট। খোকনদের বাড়ির কাজের লোক সেই সেন্ট কিনে মেখেছিল বলে খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বয়স বাড়লে দেখলাম মৃতদেহ দাহ করতে শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার সময় অগুরু সেন্ট ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। হোক, তবু একটা রেক্সোনা সাবান কেনার আনন্দ যে তখন অপরিসীম ছিল। আমাদের চা বাগানের এবং পাশের গঞ্জ এলাকায় তখন কোনো সেলুন ছিল না। স্কুল বলতে ভবানী মাস্টারমশাইয়ের পাঠশালা ছিল। চা বাগানে একমাত্র আমাদের বাড়িতে ব্যাটারিচালিত বিশাল মার্ফি রেডিও ছিল। সকাল, দুপুর, সন্ধে নিয়ম করে খবর শোনা হতো। শুক্রবার রাত্রে নাটক শুরু হওয়ার আগে বাড়িতে ভিড় জমত। আশপাশের সব বাড়ির মেয়েরা এসে ভিতরের ঘরে বসতেন, পুরুষরা বাইরের ঘরে। তখন অল ইন্ডিয়া রেডিওর কলকাতা কেন্দ্রের বাংলা নাটক সবাই শুনতেন নিঃশব্দে। আমাদের বাড়িটা তখন সবার বাড়ি হয়ে যেত। ভরত হাজাম আসত শনিবারে। উঠানের এক পাশে মোড়ায় বসিয়ে সর্বাঙ্গ কাপড়ে মুড়ে দিয়ে মাথা নামিয়ে চুল কাটত। বহু বছর ধরে সে সময় ভরতকে একটাই গান গাইতে শুনেছি। কাঁচি চালাতে চালাতে সে গাইত, ‘নাচ বুড়িয়া নাচ, কান্ধে পর নাচ।’ কেন কোনো বুড়ি কারও কাঁধে উঠে নাচবে এই প্রশ্ন সে সময় মাথায় আসত না। কিন্তু শুনে মজা লাগত। আমার পড়াশোনা শুরু হয়েছিল ওই পাঠশালায়। যার একমাত্র শিক্ষক ছিলেন ভবানী মাস্টার। পূর্ববঙ্গের ভাষায় কথা বলতেন। খুব নস্যি নিতেন। একবার আমাকে জড়িয়ে ধরতেই আমার হাঁচি শুরু হয়ে গিয়েছিল। এখনো নস্যি শব্দটি শুনলেই ভবানী মাস্টারের মুখ মনে পড়ে। ধীরে ধীরে সব বদলে গেল। পাঠশালা উঠে গেছে কবে। এখন ওখানে হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল। চা বাগনের প্রান্ত থেকে চৌমাথা পর্যন্ত চোখ ধাঁধানো দোকানের সারি। ঝকমকে সেলুনগুলোয় এফএম বাজছে। এসে গেছে টিভি, ফ্রিজের দোকান। শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি শহরে যা যা পাওয়া যায় তা চাইলেই দোকানে না থাকলে পরদিনই জোগান দেন দোকানদার। আগে, সেই সময়ে চৌমাথায় পেট্রল পাম্পের পিছনে একটি ভাটিখানা ছিল। দেশি মদ এবং হাঁড়িয়া খেতে যেত শ্রমজীবী মানুষগুলো। সপ্তাহের মাইনে পেলে তো কথাই নেই। তাদের ধরে বাড়ি ফিরিয়ে নিতে খুব কষ্ট করতে হতো বাড়ির স্ত্রী-কন্যার। এখনো সেই ভাটিখানা রয়ে গেছে কিন্তু দু’দুটো মদের দোকান চালু হয়েছে, যা অর্থবানদের অভাব পূর্ণ করছে। ব্যাপারটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। আধুনিক জীবনে যা যা প্রয়োজন তার আয়োজন তো আপনাআপনি হয়ে যায়। তবু, এখনো মাঝরাতে কুলি লাইন থেকে ভেসে আসা মাদলের আওয়াজ, শীতের হিমরাতে কুয়াশায় মোড়া আসাম রোডে নানা রহস্যের কল্পনা করে যে মুখ মনে তৈরি হয় তার কোনো তুলনা হয় না। যারা একবার এসব পেয়েছে তাদের মন থেকে তা সময় কিছুতেই কেড়ে নিতে পারবে না।

 

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

মা বলে দিতেন একটু বড় মাছ না দেখলে ডাকবি না

আপডেট টাইম : ০৭:১৮:০১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৭ জুলাই ২০১৫

স্কুলের ছুটির সময় জলপাইগুড়ি থেকে চা বাগানের বাড়িতে গেলে মনে হতো আমার মতো সুখী আর ক’জন আছে? সাধারণত পরীক্ষার পরে যেতাম বলে পড়ার চাপ থাকত না। ভরবিকালে মা একটা দায়িত্ব দিতেন। কোয়ার্টার্সের বারান্দায় বসে সামনের হাইওয়ের ওপর নজর রাখতে হবে। বিকালের ছায়া ঘনালেই ডুডুয়া থেকে মাছ ধরে হাইওয়েতে হেঁটে বাজারের দিকে যায় যারা তাদের ধরতে হবে। সাধারণত বুধ থেকে শুক্রবার এভাবে মাছ কেনা হয়। কোয়ার্টার্সের সামনে মাঠ, মাঠের পরেই হাইওয়ে। দু’পাশে লম্বা লম্বা প্রাচীন গাছের সারি। মাঝেমধ্যে কোনো গাড়ি বা বাস হুস করে বেরিয়ে যায় হাইওয়ে দিয়ে। পাখির চিৎকার ছাড়া কোনো শব্দ নেই। মানুষ দেখা যায় কদাচিৎ। হঠাৎ দূরে জাল কাঁধে হাতে ব্যাগ ঝুলিয়ে কাউকে আসতে দেখলেই ছুটে যেতাম হাইওয়েতে। মা বলে দিতেন একটু বড় মাছ না দেখলে ডাকবি না। বড় মাছ বলতে পাথরঠোকা, যাকে ঝিলা বলত কেউ কেউ, পুঁটি, বান মাছ। আর থাকত অজস কুঁচো চিংড়ি। মাছের আকৃতি দেখে ডেকে নিয়ে আসতাম লোকটাকে। ঘুমভাঙা চোখে মা মাছ দেখে খুশি হলে দর করতেন। সেই দরাদরি চলত বেশ কিছুক্ষণ। দুই সের মাছ আড়াই টাকায় কিনতেন মা। তখন ভালো চাল আড়াই টাকায় পাঁচ সের পাওয়া যেত।

এখন ফিরে দেখলে মনে হয়, সে বড় সুখের সময় ছিল। অথচ বাড়িতে ফ্রিজ ছিল না যে রেখে ক’দিন ধরে খাওয়া যাবে! সে সময় বিদ্যুতের আলোর বদলে হ্যারিকেন ছিল। নানান সাইজের হ্যারিকেন। তাতে জোরালো আলো ঘরে ছড়াত কিন্তু জানালার বাইরেটা রহস্যময় অন্ধকারে ডুবে থাকত। সে এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি। এখন ভাবী, গরমকালে বিদ্যুৎ না থাকার কারণে পাখার হাওয়া পাওয়ার কথা ভাবতামই না। কিন্তু তার জন্য কোনো কষ্ট হতো না। এটাই বোধহয় জীবনের ধর্ম। আমার সামনে কিছু একটা আছে যা আমাকে আনন্দিত করতে পারে কিন্তু সেটা আমি যখন পাচ্ছি না তখন তীব্র কষ্ট হয়, পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে সাধ্যের বাইরেও চলে যাই কখনো কখনো। অথচ সেইরকম কিছুর অস্তিত্ব যদি আমার জানা না থাকে, কেউ যদি সেসবের প্রলোভন না দেখায় তাহলে আমি যা নিয়ে আছি তাতেই সুখে থাকব, অভাববোধ তৈরি হবে না। অতএব ফ্রিজ বা পাখা ছাড়াই দিব্যি চলে যেত আমাদের।

হাট বসত রবিবারে। হাট না বলে উৎসব বলাই ভালো। বেলা ১০টার মধ্যে দূর দূর থেকে লরিতে ব্যাপারীরা মালপত্র নিয়ে এসে হাটে দোকান সাজাত। আশপাশের চা বাগানগুলো থেকে মানুষ আসতেন কেনাকাটা করতে। বাবা কাজের লোককে নিয়ে একপ্রস্থ বাজার করে এসে আবার যেতেন মাছ কিনতে। এই পর্ব শেষ হতো দুপুর দেড়টায়। আড়াইটা-তিনটার সময় হাটের চেহারা বদলে যেত। শাকসবজি বা মাছের ব্যাপারীরা তাদের বিক্রি না হওয়া জিনিসপত্র লরিতে চাপাত। আর তাদের জায়গাগুলো দখল করত শৌখিন জিনিসের দোকানগুলো। হিমালয় পাউডার, আফগান স্নো, রঙিন সুদৃশ্য মোড়কের সাবানের পাশে অগুরু সেন্ট যেমন থাকত, তেমনি মেয়েদের জন্য নানান সাজগোজের জিনিসও সাজানো হতো। এই হাটের ক্রেতা ছিল মূলত মদেশিয়া বা নেপালি মেয়েরা। ওরা দল বেঁধে আসত, পছন্দের সময় বিস্তর হাসাহাসি করত। আমার মনে পড়ে না, কোনো বাঙালি পরিবারের মেয়েকে রবিবারের বিকালের হাটে কেনাকাটা করতে দেখেছি বলে। পরে জেনেছি, ওই পাউডার, স্নো, সাবান বা সেন্ট যতই লোভনীয় হোক না কেন, তাদের মান নিয়ে অনেকের সন্দেহ ছিল। কিন্তু সেই বালক বয়সে ওই বস্তুগুলো আমার খুব পছন্দ হতো। বিশেষ করে অগুরু সেন্ট। খোকনদের বাড়ির কাজের লোক সেই সেন্ট কিনে মেখেছিল বলে খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বয়স বাড়লে দেখলাম মৃতদেহ দাহ করতে শ্মশানে নিয়ে যাওয়ার সময় অগুরু সেন্ট ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। হোক, তবু একটা রেক্সোনা সাবান কেনার আনন্দ যে তখন অপরিসীম ছিল। আমাদের চা বাগানের এবং পাশের গঞ্জ এলাকায় তখন কোনো সেলুন ছিল না। স্কুল বলতে ভবানী মাস্টারমশাইয়ের পাঠশালা ছিল। চা বাগানে একমাত্র আমাদের বাড়িতে ব্যাটারিচালিত বিশাল মার্ফি রেডিও ছিল। সকাল, দুপুর, সন্ধে নিয়ম করে খবর শোনা হতো। শুক্রবার রাত্রে নাটক শুরু হওয়ার আগে বাড়িতে ভিড় জমত। আশপাশের সব বাড়ির মেয়েরা এসে ভিতরের ঘরে বসতেন, পুরুষরা বাইরের ঘরে। তখন অল ইন্ডিয়া রেডিওর কলকাতা কেন্দ্রের বাংলা নাটক সবাই শুনতেন নিঃশব্দে। আমাদের বাড়িটা তখন সবার বাড়ি হয়ে যেত। ভরত হাজাম আসত শনিবারে। উঠানের এক পাশে মোড়ায় বসিয়ে সর্বাঙ্গ কাপড়ে মুড়ে দিয়ে মাথা নামিয়ে চুল কাটত। বহু বছর ধরে সে সময় ভরতকে একটাই গান গাইতে শুনেছি। কাঁচি চালাতে চালাতে সে গাইত, ‘নাচ বুড়িয়া নাচ, কান্ধে পর নাচ।’ কেন কোনো বুড়ি কারও কাঁধে উঠে নাচবে এই প্রশ্ন সে সময় মাথায় আসত না। কিন্তু শুনে মজা লাগত। আমার পড়াশোনা শুরু হয়েছিল ওই পাঠশালায়। যার একমাত্র শিক্ষক ছিলেন ভবানী মাস্টার। পূর্ববঙ্গের ভাষায় কথা বলতেন। খুব নস্যি নিতেন। একবার আমাকে জড়িয়ে ধরতেই আমার হাঁচি শুরু হয়ে গিয়েছিল। এখনো নস্যি শব্দটি শুনলেই ভবানী মাস্টারের মুখ মনে পড়ে। ধীরে ধীরে সব বদলে গেল। পাঠশালা উঠে গেছে কবে। এখন ওখানে হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল। চা বাগনের প্রান্ত থেকে চৌমাথা পর্যন্ত চোখ ধাঁধানো দোকানের সারি। ঝকমকে সেলুনগুলোয় এফএম বাজছে। এসে গেছে টিভি, ফ্রিজের দোকান। শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি শহরে যা যা পাওয়া যায় তা চাইলেই দোকানে না থাকলে পরদিনই জোগান দেন দোকানদার। আগে, সেই সময়ে চৌমাথায় পেট্রল পাম্পের পিছনে একটি ভাটিখানা ছিল। দেশি মদ এবং হাঁড়িয়া খেতে যেত শ্রমজীবী মানুষগুলো। সপ্তাহের মাইনে পেলে তো কথাই নেই। তাদের ধরে বাড়ি ফিরিয়ে নিতে খুব কষ্ট করতে হতো বাড়ির স্ত্রী-কন্যার। এখনো সেই ভাটিখানা রয়ে গেছে কিন্তু দু’দুটো মদের দোকান চালু হয়েছে, যা অর্থবানদের অভাব পূর্ণ করছে। ব্যাপারটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। আধুনিক জীবনে যা যা প্রয়োজন তার আয়োজন তো আপনাআপনি হয়ে যায়। তবু, এখনো মাঝরাতে কুলি লাইন থেকে ভেসে আসা মাদলের আওয়াজ, শীতের হিমরাতে কুয়াশায় মোড়া আসাম রোডে নানা রহস্যের কল্পনা করে যে মুখ মনে তৈরি হয় তার কোনো তুলনা হয় না। যারা একবার এসব পেয়েছে তাদের মন থেকে তা সময় কিছুতেই কেড়ে নিতে পারবে না।