এমপিরা নিজেরা নিজের বেতন বাড়ানো অশোভন

বারবার সামরিক প্রভাবে পড়া দেশ পাকিস্তানের সুপ্রিমকোর্ট, বেশ কবছর ধরে দেখেছি, অবাধ ও গণতান্ত্রিক পরিবেশে থাকা ভারতের সুপ্রিমকোর্টের চেয়ে বেশি প্রগতিশীল। জিয়াউল হক ও পারভেজ মোশাররফের মতো সেনাপ্রধানরা প্রধান বিচারপতির ওপর যে জুলুম চালিয়েছেন তার বিরুদ্ধে পাকিস্তানের আইনজীবীরা লড়াই করেছেন। বেশি দিন আগের কথা নয়। প্রধান বিচারপতির মর্যাদা ফিরিয়ে আনার সেই যুদ্ধে তারা জিতেছেনও।

আবার এটাও বলতে হয় যে, আয়নায় নিজের চেহারা দেখতে আমাদের বাধ্য করেছে পাকিস্তান সুপ্রিমকোর্ট। যুগান্তকারী এক রায়ে এই কোর্ট জানায় যে, প্রাসাদোপম প্রেসিডেন্ট ভবন, প্রধানমন্ত্রী ভবন, বিভিন্ন গভর্নরের বাসভবন ও এসব ভবনের বাসিন্দাদের এবং উচ্চপদের সরকারি কর্মকর্তাদের বিলাসী জীবনযাপন পদ্ধতি জিইয়ে রাখার পেছনে ‘বিপুল ব্যয়’ জনগণের জন্য ক্ষতিকর। ‘রাজনৈতিক প্রশ্ন’ জড়িত থাকায় ‘সরকার যে নীতি গ্রহণ করে’ তারই পরিণামে এটা ঘটে চলেছে।

ভারতে যে ধরনের রায় ঘোষিত হয় তার তুলনায় এই রায় অনেক অনেক তাৎপর্যবাহী। পাকিস্তান সুপ্রিমকোর্ট বলেছে, ‘বিদেশি ঋণের ভারে কাতর এই দেশ, এর জনগণের বিরাট একটি অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা আর শিক্ষা তারা পায় না। এমন দেশে এরকম লাগামহীন ব্যয় মহানবীর অনাড়ম্বর জীবনযাত্রার ঐতিহ্যের পরিপন্থীই শুধু নয়, এতে করে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারও লঙ্ঘিত হচ্ছে।’

রায়ের এই ভাষায় স্বাধীন ভারতে ক্ষমতার বিভিন্ন স্তরে নির্বাচিতদের উদ্দেশে মহাত্দা গান্ধীর দেওয়া উপদেশের প্রতিধ্বনি রয়েছে। তিনি বলেছিলেন, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের আচরণ হতে হবে তত্ত্বাবধায়কের মতো, প্রভুর মতো নয়। তাদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা যেন সাধারণ মানুষের গড়পড়তা আয়ের চাইতে অত্যধিক না হয়- গান্ধী এটাই চেয়েছেন। সংসদ সদস্যরা, বিধানসভার সদস্যরা আর যারা পৌরসভার উচ্চপদে নির্বাচিত হন, তারা এই উপদেশের পরোয়া খুব একটা করেন না। পাকিস্তান সুপ্রিমকোর্টের রায়ে আছে- ‘সরকারি সম্পদ হচ্ছে জনসেবকের হাতে অর্পিত জনআস্থা।’ এই বাস্তবতা অস্বীকার করা যাবে না।

নির্বাচিত সংসদ ও বিধানসভা সদস্যদের বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর যে দাবি উঠানো হয়, আশা করেছিলাম তার ওপর আদালত মন্তব্য করবে। কিন্তু আদালত তা করল না এই যুক্তিতে যে ব্যাপারটির সঙ্গে রাজনৈতিক প্রশ্ন জড়িয়ে যাবে। তত্ত্বগতভাবে আদালত ঠিকই ভেবেছে। তবে বিচারকদের পর্যবেক্ষণ জনস্বার্থ সংরক্ষণে সহায়ক হতে পারত। কারণ বিচারবিভাগ এখনো শ্রদ্ধেয়। কিন্তু রাজনৈতিক নেতারা আর তাদের সহযোগীরা যেরকম লাগামহীন ব্যয় করেন, বিচারকদের অভিমতের পর, তার বিরুদ্ধে জনমত সোচ্চার হতে শুরু করত।

তাদের বিলাসী জীবনযাপন রীতি উন্নত ও ধনী পশ্চিমা দেশগুলোর রাজনীতিকদের জীবনরীতির সঙ্গে খাপ খায় না। ভারতের রাজনীতিক জনপ্রতিনিধিরা যে ইতিমধ্যেই উচ্চ উপার্জনকারীদের পঙ্ক্তিভুক্ত হয়ে আছেন- সে কথা তাদের কে দেখিয়ে দেবে? একদা এই কাজটা গণমাধ্যম করেছে। কিন্তু এখন মালিকরা, তাদের লোকরা আর করপোরেট সেক্টরের তদারককারীরা পত্রিকা কী ছাপবে বা ছাপবে না, তা নির্দেশ তো করছেই, এমনকি প্রতিবেদনের শিরোনামও বলে দিচ্ছে। তাদের ব্যক্তিগত গোঁড়ামি আর জেদ গণমাধ্যমকে বিপর্যস্ত করছে। এই পরিস্থিতি বেদনাদায়ক অবশ্যই। কিন্তু এর চাইতে উন্নততর পদ্ধতি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি, আমাদের এ অঞ্চলের সংবাদপত্রের পরিবেশের চাইতে অনেক উন্নত পরিবেশসমৃদ্ধ পাশ্চাত্যেও একই দশা।

সাংবাদিকতার উচ্চমান বাতলানোর লক্ষ্যে স্থাপিত প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের কী করা উচিত, কী উচিত নয় বলে দেওয়ার ব্যাপারে এক নম্বর প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেকে জাহির করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। একদা এই কাউন্সিলের সদস্য ছিলাম আমি। ওই সময় সেন্সরশিপ চলছিল। কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলেন সুপ্রিমকোর্টের অবসরভোগী এক বিচারক। সরকারের আনুকূল্য লাভের জন্য তিনি কী রকম তোষণ করেছিলেন মনে পড়ে। তদানীন্তন তথ্যমন্ত্রী বিদ্যাচরণ শুক্লার কাছে তিনি লিখলেন যে, প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি কাউন্সিল সদস্যদের এমনভাবে বাগে এনেছেন যে, তারা সেন্সরশিপের সমালোচনা করে কোনো প্রস্তাব পাস করবেন না।

জরুরি অবস্থার সময়কার প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আচরণ ও মনোভঙ্গি তুলে ধরে শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছিল জনতা সরকার। কিন্তু ‘১৯৮০ সালে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী আবার ক্ষমতায় ফিরে এসে সেই একই আচরণ করতে থাকলেন, তখন গণমাধ্যমে বা প্রেস কাউন্সিলে কাউকেই তার বিরুদ্ধে আঙ্গুল উঁচিয়ে কিছু বলতে দেখা গেল না। সম্পাদক ও পেশাদার সাংবাদিকদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য ইদানীং প্রেস কাউন্সিল পুনর্গঠন করা হয়েছে। কিন্তু আজও অবস্থার খুব একটা হেরফের হয়নি।

প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার জায়গায় সম্ভবত আরেকটি প্রতিনিধিত্বশীল সংস্থা গড়ে তুলতে হবে, যেমনটি হয়েছে যুক্তরাজ্যে। ওই দেশেও দেখা গেছে যে প্রেস কাউন্সিল গতিহীন হয়ে পড়েছে। আশির দশকে যুক্তরাজ্য প্রেস কাউন্সিলের বদলে গড়ে উঠল প্রেস কমপ্লেইনটস কাউন্সিল (পিসিসি)। ওই দেশে গণমাধ্যমের অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। তবুও সরকার বা গণমাধ্যম কেউই ফলপ্রদ অন্য কিছু উদ্ভাবন করছে না। ওভাবেই চলছে। স্বীকার করি, ভারতে পুনর্বার সেন্সরশিপ চালু হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তা সত্ত্বেও প্রেস কাউন্সিল আরও অর্থবহ করে তোলা প্রয়োজন। নইলে প্রতিষ্ঠানটি শুধু একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।

লোকসভার সাবেক স্পিকার সোমনাথ চ্যাটার্জি সংসদ সদস্যদের বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা ইত্যাদি নির্ধারণের জন্য স্বতন্ত্র পে-কমিশন গঠনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছিলেন। তার সঙ্গে আমি সহমত পোষণ করি। জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয় মেটানোর জন্য সংসদ সদস্যদের আরও বরাদ্দ দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে, এতে সন্দেহ নেই। তবে কতটা বাড়ানো শোভন তা যথাযথভাবে যাচাই করা চাই। সোমনাথ চ্যাটার্জির বক্তব্যের একটি দিক খুবই তাৎপর্যময়। তিনি বলেছেন, ‘নিজেদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত এমপিরা নিজেরা নিতে পারেন না।’

বিভিন্ন রাজ্যের বিধান সভার সদস্যদের বেতন-ভাতা গ্রহণের মধ্যেও সমতা রক্ষা করা দরকার। বর্তমানে কেরালা বিধান সভার সদস্যরা মাসে ২১,৩০০ রুপি করে বেতন-ভাতা নিচ্ছেন। দিলি্ল বিধানসভার সদস্যরা নেন মাসে ৫০,০০০ রুপি। পাঞ্জাব বিধান সভার সদস্যের বেতন-ভাতা ৫৪,০০০ রুপি। কেরালা বিধান সভার সদস্যরা প্রত্যেকে মাসে পাচ্ছেন বেতন ৩০০ রুপি; বাকি ২১ হাজার রুপি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের বিল ও ভাতা। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে এমন একটা অংক দেওয়া উচিত যার মধ্যে যাবতীয় খরচের রুপি একই সঙ্গে থাকবে। সাকুল্য অংক দেখলে জনগণ বুঝতে পারবে একেকজন প্রতিনিধি পুষতে গিয়ে তাদের ট্যাঙ্ থেকে মাসে মাসে কত বেরিয়ে যাচ্ছে। নানা ধরনের খাত উল্লেখ করে পারিতোষিকের বর্ণনা দেওয়া হলে চট করে বোঝা যায় না, গোটা বিষয় বিভ্রান্তকর হয়ে ওঠে। রাজ্য আর কেন্দ্রের জন্য একটা মাপকাঠি রাখা ভালো। তাহলেই গান্ধীজীর উপদেশ অনুসরণ করে তদারককারীর ব্যবস্থাটা কতদূর এগিয়েছে জাতি তা অনুভব করবে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর