‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে’- কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত শাহজাদপুরের সেই ছোটনদী (খোনকারের জোলা) শুকিয়ে মরে যাওয়ায় সেখানে আর ভাসবে না, চলবে না ‘সোনার তরী’। কবিগুরুর শাহজাদপুরের খোনকারের জোলার মতোই এক সময়ের প্রমত্তা ও স্রোতস্বিনী যমুনা, করতোয়া, বড়াল, হুড়াসাগর, নন্দকুজা, বেশানী, আত্রাই, গুমানী, গুর, ফকিরনী, শিববারনই, নাগর, ছোটযমুনা, মুসাখান, নারদ ও গদাইসহ উত্তরাঞ্চলের নদীগুলো শুকিয়ে নদীবক্ষে মাইলের পর মাইল ধু-ধু বালুচর বিরাজ করায় প্রবহমান নদীর বুক মিনি মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে।
ভারতের মেরুকরণের কুপ্রভাবে উত্তরাঞ্চলের বৃহৎ নদ-নদীগুলোতে বর্তমানে পর্যাপ্ত পানি নেই। আর শাখা নদীগুলোর অবস্থা আরো করুণ। পুরোপুরি মরে শুকিয়ে যাওয়ায় অনেক নদীর বুকে রোপণ করা হয়েছে ইরি বোরো ধান। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক নিচে নেমে গেছে। ফলে এ অঞ্চলের গভীর ও অগভীর নলকূপ দিয়ে চলতি ইরি-বোরো ধানের সেচ কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত নদ-নদীগুলোর স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ করে দেয়ায় সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে মরু অঞ্চলে পরিণত হতে চলেছে। উত্তরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে নদীগুলো অবস্থান করায় মরুকরণের কুপ্রভাব এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশকে করছে ভারসাম্যহীন। এসব কারণে এ অঞ্চলের নদীগুলোর গতি-প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটছে। আমরা হারাতে বসেছি আমাদের অনেক গ্রামীণ ঐতিহ্য।
আবহমান কাল থেকে গ্রামীণ জনপদের মানুষের প্রিয় সুস্বাদু দেশি মাছ এখন সোনার হরিণের মতো। এখন আর দেখা যায় না গ্রামীণ ঐতিহ্যের অনুষঙ্গ নৌকাবাইচ, খরা জাল, সুতি ফাঁদ, সেচের মাধ্যম দাঁড়। মৎস্যভাণ্ডার সংকুচিত বা শুকানোর ফলে অনেক মৎস্যজীবী আজ বেকার। আবার অনেকেই পেশার পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভারতের মরুকরণ প্রক্রিয়ার ফলে শুষ্ক মৌসুমে যৌবন হারিয়ে কবিগুরুর ছোটনদীসহ, পদ্মা, যমুনা করতোয়া, বড়াল, হুড়াসাগর, নন্দকুজা, বেশানী, আত্রাই, গুমানী, গুর, ফকিরনী, শিববারনই, নাগর, ছোট যমুনা, মুসাখান, নারদ ও গদাইসহ উত্তরাঞ্চলের নদীগুলো প্রায় পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর অতীতের তুলনায় ও স্বাভাবিক স্তরের চেয়ে উদ্বেগজনক হারে নিচে নেমে যাওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি শাখা নদী, খাল-বিল শুকিয়ে চারিদিকে পানির জন্য হাহাকার শুরু হয়েছে। এসব নদ-নদী তীরবর্তী অঞ্চলের গভীর-অগভীর নলকূপ থেকে পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে দেশের কৃষি অর্থনীতিতে মারাত্মক বিরূপ নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। নদীনির্ভর এ অঞ্চলে ভূ-গর্ভস্থ পানির অপরিকল্পিত ও অতিমাত্রায় ব্যবহার এবং সেচ কাজে পানির অপচয় রোধ করা না গেলে বাংলাদেশ এক মহাসংকটের মুখোমুখি হবে বলে বিশেষজ্ঞরা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। এ অঞ্চলের এক সময়ের ভয়াল, উত্তাল অনেক নদী ও শাখানদী বক্ষে এক ফোঁটাও পানি আর দেখা যাচ্ছে না। করতোয়ার পরিণতিও বর্তমানে একই পথে! নাব্য সংকট ও প্রতিকূল পরিবেশ বিরাজ করায় উত্তরাঞ্চলের নদী থেকে দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ নিশ্চিহ্নের পথে! এসব কারণে এ অঞ্চলের নদীনির্ভর কৃষক ও এলাকাবাসীর বুকভরা আশা ক্রমশ হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছে। এ ছাড়া এসব নদীগুলোতে প্রয়োজনীয় পানি না থাকায় একদিকে যেমন নৌ-চলাচল মারাত্মকভাবে বিঘিœত হচ্ছে, অন্যদিকে জাতীয় অর্থনীতিতেও এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হচ্ছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, এ অঞ্চলের স্রোতস্বিনী যমুনা, পদ্মা, করতোয়া, বড়াল, হুড়াসাগর, নন্দকুজা, বেশানী, আত্রাই, গুমানী, গুর, ফকিরনী, শিববারনই, নাগর, ছোট যমুনা, মুসাখান, নারদ ও গদাইসহ উত্তরাঞ্চলের নদীগুলো ও এর বেশকটি শাখানদীসহ খাল-বিল শুকিয়ে গেছে। ফলে নদ-নদীবিধৌত উত্তরাঞ্চলবাসীর শুরু হয়েছে দুঃখ-দুর্দশার পালা। প্রকৃতিনির্ভর কৃষিপ্রধান এ অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা হয়ে যাচ্ছে মিনি মরুভূমি। দু’চোখ যেদিকে যায় সেদিকেই দেখা যায় ধু-ধু বালুচর। কৃষিপ্রধান দেশে বিরাজিত ওই দুরবস্থা রোধে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ সরকারকেই নিতে হবে বলে বিজ্ঞ মহল মতামত ব্যক্ত করেছেন।
সংবাদ শিরোনাম
কবিগুরুর মরে যাওয়া ছোটনদীতে ভাসবে না আর ‘সোনার তরী’
- Reporter Name
- আপডেট টাইম : ০৪:৩৪:৫৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৩১ মার্চ ২০১৭
- ৩০৭ বার
Tag :
জনপ্রিয় সংবাদ