চকরিয়ায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে মাতামুহুরী নদী এবং চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক লাগোয়া সবকটি ইউনিয়নে। তবে এসব এলাকায় বানের পানি নামছে ধীরগতিতে। আর নতুন করে বন্যা দেখা দিয়েছে উপকূলীয় ৭ ইউনিয়নে।
উপকূলীয় সাহারবিল, পশ্চিম বড় ভেওলা, পূর্ব বড় ভেওলা, ভেওলা মানিকচর, কোনাখালী, ঢেমুশিয়া ও বদরখালী ইউনিয়নের বন্যাদুর্গত গ্রাম পরিদর্শনে দেখা যায়, বদরখালীর কিছু অংশ ছাড়া অন্যসব ইউনিয়নের প্রতিটি বাড়ি এখনো ৫-৬ ফুট বানের পানিতে তলিয়ে রয়েছে। যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম গ্রামীণ অবকাঠামো ও অভ্যন্তরীণ সড়কগুলোও পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় নৌকায় যাতায়াত করছে বাসিন্দারা।
এদিকে টানা বর্ষণ ও মাতামুহুরী নদীতে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানি ভাটির দিকে নামছে একেবারে শ্লথগতিতে। সরেজমিন পরিদর্শন এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এর কারণ হিসেবে জানা গেছে, মাতামুহুরী নদীর রামপুর-পালাকাটা পয়েন্টে নির্মিত রাবার ড্যামটির চার পয়েন্টের মধ্যে মাত্র দুই পয়েন্টের রাবারের ভেতরের হাওয়া ছেড়ে দেওয়া হলেও অন্য দুই পয়েন্টের রাবার এখনো ফোলানো অবস্থায় রয়েছে। চিরিঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. জসীম উদ্দিন গত কয়েকদিন ধরে বিষয়টি নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নজরে আনলেও প্রশাসন এ ব্যাপারে গতকাল সোমবার পর্যন্ত কোনো কিনারা করতে পারেনি। এতে একেবারে শ্লথগতিতেই ভাটির দিকে নামছে বানের পানি। আর এরই মধ্যে বারোটা বেজে গেছে চকরিয়া উপজেলার ১৮ ইউনিয়ন ও এক পৌরসভার প্রায় তিন লাখ মানুষের।
গত দুই যুগে সংঘটিত কয়েকটি ভয়াবহ বন্যার উদ্ধৃতি দিয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ অনেক ব্যক্তি কালের কণ্ঠকে জানান, প্রতিবার বন্যার সময় মাতামুহুরী নদী দিয়ে উজান থেকে নেমে আসে পাহাড়ি ঢলের পানি। বিপদসীমা অতিক্রম করে ৫-১০ ফুট পর্যন্ত নদীর দুইকূল উপচে ঢলের পানি প্রবাহিত হলেও খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ঢলের পানি ভাটির দিকে নেমে যেত। কিন্তু এবারের বন্যায় মাতামুহুরী নদীতে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল এবং ভারি বর্ষণের পানি নামছে খুব শ্লথগতিতে। এতে তাঁদের মনে হচ্ছে কোথাও যেন একটা কিছু হয়েছে। তা না হলে যতই টানা বর্ষণ এবং ঢলের পানি নদীতে নামুক এতদিন আটকে থাকার কথা না।
মাতামুহুরী নদীতীর লাগোয়া কাকারা ইউনিয়নের বাসিন্দা সাংবাদিক মাহমুদুর রহমান মাহমুদ বলেন, ‘আমার এই পরিণত বয়সে অনেক বন্যার ধকল সহ্য করেছি। কোন কোনবার একদিন বা তদূর্ধ দুদিন পানিবন্দি থাকলেও একনাগাড়ে ৪-৫ দিন ধরে পানিবন্দি ছিলাম না।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমার সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতায় ধরে নিলাম নদীর কিছু কিছু অংশে তলদেশ ভরাট হয়ে গেলেও এভাবে দীর্ঘদিন পানি আটকে থাকার কথা নয়। এক্ষেত্রে নদীর রামপুর-পালাকাটা পয়েন্টে নির্মিত রাবার ড্যামের ফোলানো রাবারের দুই পয়েন্টের ভেতরের হাওয়া ছেড়ে না দেওয়ায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টির দিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আগে থেকে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় এতদিন ধরে বানের পানিতে ভাসতে হচ্ছে উপজেলার লাখ লাখ মানুষকে। আশা করি প্রশাসন এবং পানি ঊন্নয়ন বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ঘুম ভাঙবে। আর বানের পানির অভিশাপ থেকে সহসা মুক্ত হবে দুর্গত মানুষগুলো।’
সরেজমিন পরিদর্শনে গেলে ঘটনার সত্যতাও পাওয়া যায়। এ সময় ত্রাণ তৎপরতা চালাতে আসা চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) শংকর রঞ্জন সাহা, চকরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আলম, ভাইস চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম আজাদ, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সাহেদুল ইসলাম, চিরিঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. জসীম উদ্দিনও ড্যামের ফোলানো রাবার প্রত্যক্ষ করেন।
এ ব্যাপারে চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সাহেদুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাকে বিষয়টি চিরিঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জানানোর পর পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলি একাধিকবার। কিন্তু তারা বিষয়টি একেবারে উড়িয়ে দিলেও সরজমিন প্রত্যক্ষ করে নিশ্চিত হয়েছি, ড্যামের ফোলানো রাবারের হাওয়া ছেড়ে না দেওয়ায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসক মহোদয়কে অবহিত করেছি। পাশাপাশি পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জোরালোভাবে জানিয়েছি ফোলানো রাবারের হাওয়া ছেড়ে দিতে।’
বক্তব্য জানতে একাধিকবার ফোন করা হয় পানি উন্নয়ন বোর্ড কক্সবাজারের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আজিজ মোহাম্মদ চৌধুরীর সঙ্গে। কিন্তু তিনি ফোন না ধরায় তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
এখনো ভাসছে উপকূলীয় সাত ইউনিয়ন
পশ্চিম বড় ভেওলা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. সাহাব উদ্দিন, কোনাখালীর চেয়ারম্যান দিদারুল হক সিকদার, পূর্ব বড় ভেওলার ইব্রাহিম খলিল, বিএমচরের বদিউল আলম, ঢেমুশিয়ার রুস্তম আলী, সাহারবিলের আবদুল হাকিম ও বদরখালীর চেয়ারম্যান নূরে হোছাইন আরিফ কালের কণ্ঠকে জানান, ভারি বর্ষণ ও মাতামুহুরী নদীতে উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে এখনো একাকার ইউনিয়নগুলো। এতে কম করে হলেও এসব ইউনিয়নের প্রায় দেড় লাখ মানুষ বানের পানিতে ভাসছে। বসতবাড়িগুলো ৫-৬ ফুট পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় মাথা গোঁজারও ঠাঁই হচ্ছে না। এতে পিএবিসি আঞ্চলিক মহাসড়কের চকরিয়া অংশের দুই পাশে এবং উঁচু সড়ক ও ব্রিজের ওপর গাদাগাদি করে গবাদি পশুর সঙ্গে বসবাস করছে বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষ। টিউবওয়েলগুলোও পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। দুর্গতদের মাঝে বিতরণের জন্য সরকারিভাবে বরাদ্দ দেওয়া ত্রাণ একেবারে অপ্রতুল হওয়ায় অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছেন তাঁরা।
কোনাখালী ইউনিয়নের একটি বিদ্যালয়ের শিক্ষক মেহেদী হাসান বলেন, ‘শুধু আমাদের ইউনিয়ন নয়, উপকূলীয় সবকটি ইউনিয়নের এক ইঞ্চি জায়গাও অবশিষ্ট নেই, যেখানে বানের পানিতে তলিয়ে যায়নি। এতে দুবির্ষহ অবস্থায় পরিবার সদস্যদের নিয়ে অন্যদের মতো আঞ্চলিক মহাসড়কে ঝুপড়ি ঘরে বেঁধে আশ্রয় নিয়েছি। সাথে গবাদি পশু রয়েছে।’
চকরিয়ার বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শন এবং ত্রাণ বিতরণে আসা চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) শংকর রঞ্জন সাহা বলেন, ‘কক্সবাজারে এবারের বন্যা যে এত ভয়াবহ রূপ নিয়েছে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। চকরিয়ার দুর্গম ইউনিয়ন চিরিঙ্গার চরণদ্বীপ গিয়ে বন্যাদুর্গত মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখে আমাকেও পীড়া দিয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘সরকারের ত্রাণ ভাণ্ডারে যথেষ্ট ত্রাণ মজুদ রয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি পরিবার যাতে ত্রাণ সহায়তা পায় এবং বিলীন হয়ে যাওয়া বসতবাড়ি নির্মাণ করতে পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সহায়তাও দেওয়া হবে। ইতোমধ্যে আমি কক্সবাজারের সবকটি উপজেলার মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছি, ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আমার কাছে প্রেরণ করতে।’
চকরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আলম বলেন, ‘উপজেলার উঁচু ইউনিয়নগুলো থেকে ইতিমধ্যে নেমে গেছে বানের পানি। এসব ইউনিয়নে কম করে হলেও প্রায় ১২ হাজার বসতবাড়ি সম্পূর্ণভাবে বিলীন এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানি নামার সাথে সাথে দুর্ভোগে একাকার রয়েছে প্রায় তিন লাখ মানুষ। এখন বানের পানিতে ভাসছে উপকূলীয় ইউনিয়নের মানুষগুলো। এখান থেকে পানি নেমে যাওয়ার পর নিশ্চিত করে বলা যাবে আসলে পুরো উপজেলার ক্ষয়ক্ষতির চিত্র।
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সাহেদুল ইসলাম বলেন, ‘অপেক্ষাকৃত উঁচু ইউনিয়নগুলোতে বন্যা পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। তবে উপকূলীয় ইউনিয়নের প্রায় দেড় লাখ মানুষ এখনো বানের পানিতে ভাসছে। পানি নেমে যাওয়ার পর ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তালিকা করে পুনরায় যাতে বসতবাড়ি নির্মাণ করতে পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে।’