‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না/একলা জেগে রই’ কবির এ কথার সঙ্গে তাল মেলাতে না পারলেও ফুলের সঙ্গেই বছরজুড়ে সম্মিলিতভাবে জেগে থাকে ফুলের গ্রামের ফুল কন্যারা। গ্রামের বৌ-ঝি থেকে শুরু করে স্কুলপড়ুয়া ছোট মেয়েরা অবধি সুই-সুতোতে অহরহ নির্মাণ করে যাচ্ছেন পুষ্পিত কবিতা। এতে করে পুরুষদের পাশাপাশি সংসারে বড় একটা ভূমিকা পালন করতে পারছেন নারীরা। অভাবকে পুরোপুরি বিদায় দিয়ে ফুলের সঙ্গে বেঁচে থাকা এই গ্রামের মানুষগুলোও আছেন ভালোই। স্কুল কলেজ পড়ুয়া মেয়েরা নিজেদের বই-খাতা থেকে শুরু করে প্রয়োজন মেটাতে পারছেন নিজেদের উপার্জনে। সুই-সুতোর অদ্ভুত বন্ধনের গল্পকারদের গল্প শুনতে এই প্রতিবেদকের গন্তব্য নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার ভুলতা ইউনিয়নের ফুলের গ্রাম হিসেবে খ্যাত মাসুমাবাদে।
উপজেলার ফুলের গ্রাম হিসেবে পরিচিত মাসুমাবাদ ছাড়াও আশেপাশের দিঘীরপাড়, ভায়েলা, মিয়াবাড়ি, মুইরাবো, পোরাব তারাব পৌরসভার দেবৈ, বংশীনগর, নামাপাড়া, বোচারবাগ ও মুড়াপাড়া এলাকার নার্সিংগল, সদর ইউনিয়নের পিতলগঞ্জ সরকারবাড়ির টেকে বছরজুড়ে ফুলের চাষ হয়। এসব গ্রামগুলোর প্রায় ৪শ’ একরের অধিক জমিতে মৌসুমী ফুলের চাষাবাদের কারণে বিভিন্ন দিবসে রাজধানীসহ সারা দেশে কয়েক কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়। এসব ফুল তুলে দেয়া, পরিচর্যাসহ মালা গাথুঁনীতে চাষিদের বাইরে অগ্রণী ভূমিকায় থাকেন গ্রামগুলোর নারীরা। সংসারের যাবতীয় কাজ শেষ করে ফুলের কাজে বাড়তি উপার্জন করছেন গ্রামের প্রায় সত্তুর শতাংশ নারী। কোনো কোনো পরিবারের জীবিকার প্রধান উৎস মেয়েদের ফুল তোলা আর মালা গাথুঁনীর কাজ। এতে করে প্রত্যন্ত গ্রামে কর্মহীনতার যন্ত্রণা যেমন নেই, তেমনি যৌথকাজের মেলবন্ধনে সংসারেও কমে গেছে অভাবের যাতায়াত।
বেশ ভালো জায়গাতেই বিয়ে হয়েছিল মাসুমাবাদের কুলসুম বেগমের। স্বামীকে দোকান করে দেয়ার কথা ছিল কিন্তু দরিদ্র পিতা সেটা করার আগেই একদিন টুক করে মরে যায়। এরপর শ্বশুরবাড়ির লোকজনের যন্ত্রণা তাকে আত্মহত্যার জন্য বহুবার উসকানি দিতো। হাতের মারের চেয়ে কথার মার কুলসুমের কলিজাটা প্রতিদিন রক্তাক্ত করতো। একমাত্র শিশু সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে আত্মহত্যার লোভ সামলে কুলসুম চলে আসেন বাপের ভিটের ভাঙা ঘরে। শুরু হয় ফুলের সঙ্গে কুলসুমের কর্মময় জীবন। সংগ্রামী কুলসুম যে ফুল আকড়ে বেঁচে ছিলেন সেই ফুলের বদৌলতে আজ ২০ বছর পর ফুলের মতোই সুন্দর জীবন কুলসুমের। ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করেছেন। ভালো চাকরি করছে ছেলে। রুগ্ন ভিটেতে ডুপ্লেক্স বাড়ি তার।
একই গ্রামের ‘ছালেহা বেগম’ দুই সন্তানের জননী। স্বামী রিকশাচালক। তার সামান্য আয় দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। একটু ভালোভাবে থাকার জন্য তিনি এ কাজ করছেন। তার আয় দিয়ে ছেলেটাকে পড়াশোনা করাতে পারছেন। এটাই তার বড় সান্ত্বনা। ভায়েলা গ্রামের সুমা আক্তার জানান, ‘স্বামীর উপার্জনে সংসারের বাজার সদাই করাটাই কঠিন ছিল। অভাবের কারণে একমাত্র ছেলেকে স্কুলে পড়াতে পারছিলাম না। তাই ফুলের কাজ শুরু করি। ‘ভোর ৫টায় বাগানে যাই। ১১টা-১২টা পর্যন্ত ফুল তুলি। রোদে থাকতে থাকতে চেহারা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সারাদিন পরিশ্রম করার পর যখন টাকা হাতে পাই, মনে শান্তি লাগে।’ তার একটাই স্বপ্ন, ছেলেকে পড়াশোনা শিখিয়ে মানুষ করা। ছেলেটা শিক্ষিত হলেই তার সব কষ্ট সার্থক হবে। একই ভাবে রুমা অভাবের কারণে ক্লাস ফাইভের বেশি পড়তে পারেনি। এখন সারাদিন অফুরন্ত অবসর সময়টাকে কাজে লাগায় ফুল তুলে ও মালা গেঁথে। ফুলের মৌসুমে ভোর ৫টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ফুল নিয়েই থাকতে হয়। সে সারাদিন ২০০টির মতো মালা গাঁথতে পারে। ওর কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে পারছে, ছোট বোনটির বই-খাতা কিনতে পারছে, এ-ইবা কম কী। রুমা বলেন, ‘সারাদিন বসে মালা গাঁথতে খুব কষ্ট হয়, পিঠ ব্যথা করে। কিন্তু কী করবো? কিছু তো করতে হবে? আমাদের গ্রামে তো কোনো কাজ নেই। মেয়ে হয়েছি বলে কি বাবাকে একটু সাহায্য করতে পারবো না।’ রুমার দিনমজুর মা মেয়ের ওপর নির্ভর করতে পারছে।
তার মতোই এ গ্রামের শেফালী, সাথী, নাজমা, ছালেহা, নাসরিন ও শারমিনসহ অনেক মেয়েরা পড়াশোনার পাশাপাশি পরিবারকে সাহায্য করতে পারছে শুধু ফুল আর সুই-সুতোর জীবনে জড়িয়ে।
সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ফুল চাষিরা পরিচর্যা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। মাসুমাবাদ গ্রামের বাড়ি বাড়ি এখন গন্ধরাজ, কাঠ বেলী ও চেরী, আলমেন্দা, বেলি ফুলের বাগান। ভোর ৬টার মধ্যে বাগানে যেতে হয়। ১১টা পর্যন্ত চলে ফুল তোলা। এরপর ঘরে বসে সুই-সুতোর সঙ্গে ফুলের বন্ধন…। ফুলের গ্রাম মাসুমাবাদ ভায়েলা মিয়াবাড়ী এলাকার সবচেয়ে বড় ফুলচাষি নাঈম মিয়া জানান, বহু বছর ধরে তিনি ফুলচাষের সঙ্গে জড়িত। তার ২০ বিঘা ফুলের বাগানে রয়েছে কাঠ বেলী, চেরী ফুল। এছাড়াও রয়েছে গন্ধরাজ ফুলের বিশাল বাগান। তার ফুল বাগানে ৭০ থেকে ৭৫ জন বিভিন্ন বয়সের নারী আসেন ফুল তুলতে। ফুল চাষ তাকে স্বাবলম্বী করার পাশাপাশি আয়ের পথ দেখিয়েছে অনেক অসহায় নারীকে। তিনি আরো বলেন, শীতের মৌসুম এলে খুশিতে মনটা ভরে ওঠে আমাদের গ্রামের বৌ-ঝিদের। কেননা সেটাই ফুল ফোটার প্রধান মৌসুম। এ সময় অজস্র সাদা, আর হলুদ ফুলে ছেয়ে যায় বাগান। তারা প্রতিদিন ২০০ থেকে ২৫০টির মতো মালা গাঁথতে পারে। অন্য সময় ফুল কম থাকায় ৪০ থেকে ৫০টির বেশি মালা হয় না। তাই তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে শীত মৌসুমের জন্য। আর বর্তমানে কাঠ বেলীর সিজন রয়েছে। এটা বছরে ১১ মাসই থাকে। ফুল তোলা থেকে মালা গাথা অবধি একটি মালার জন্য ২ থেকে ৩ কখনো ৪ টাকা অবধি মজুরি নির্ধারণ করা হয়। সব মিলিয়ে মেয়েদের উপার্জনও কম নয়।
পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও যদি সংসারের প্রয়োজনে এগিয়ে আসে তাহলেই হেসে উঠে আমাদের সংসার। কর্মময় হয় সমাজ। সমৃদ্ধ হয় আমাদের বাংলাদেশ।
সংবাদ শিরোনাম
ফুলকন্যাদের গল্প…
- Reporter Name
- আপডেট টাইম : ০১:৩৯:৫১ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২০ মার্চ ২০১৭
- ২৪০ বার
Tag :
জনপ্রিয় সংবাদ