ঢাকা ০৫:৩৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৮ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সভ্যতা নারী ও নোবেলজয়ীর অমর্যাদাকর উক্তি

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৩:৫৫:০৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ জুন ২০১৫
  • ৩৩৪ বার

“ছুন্নত দিলে হয় মুসলমান,
নারীলোকের কী হয় বিধান?
বামন চিনি পৈতে প্রমাণ,
বামনী চিনি কিসে রে?
সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে।”

মহান সঙ্গীতসাধক লালন ফকির (১৭৭৪-১৮৯০) তার জীবনের এক কঠিন সংগ্রামী সময়ে নারী-পুরুষের বৈষম্যের কথা প্রকাশ করেছেন এই সঙ্গীত দিয়ে।

সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই নারী-পুরুষ একে অন্যের জন্য পরিপূরক— এই ধ্রুব সত্যটি জেনেও নানা সময়ে বিভিন্ন আঙ্গিকে এই লিঙ্গবৈষম্যের দ্বৈরথ প্রোথিত করেছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা।

যদি বিশ্লেষণ করি বিজ্ঞানের ইতিহাসের আলোকে, সেখানে প্রারম্ভিক সময়টাতে নারীকে তুলনা করা হয়েছে কারিগর বা উদ্ভাবক হিসেবে। কারণ, ধারণা করা হয় নারীরা আগুনের আবিষ্কারসহ কৃষিকাজ, সুতার যন্ত্র এবং মৃৎপাত্র তৈরিসহ অনেক যুগান্তকারী ঘটনার সূচনা করেছিলেন।

তখন ছিল মাতৃতান্ত্রিক পরিবারব্যবস্থা। কিন্তু যখন থেকে শুরু হয়েছিল সম্পদ আর সম্পত্তির হিসাব-নিকাশ, তখন ধীরে ধীরে নারীরা কোণঠাসা হয়ে মুক্ত জীবন থেকে অন্তরিত হল মহলে। যেমন- বাংলায় তাদের বলা হল মহিলা (মহলে থাকে যে; জানা যায় মহল থেকে মহিলা শব্দের বুৎপুত্তি!)।

 

যদিও নিজস্ব সত্তা ও স্বকীয়তা তুলে ধরার জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রের পাশাপাশি বিজ্ঞানে নারীর সংগ্রাম চলমান ছিল আর এখনো চলছে।

সেই থিয়ানো, হাইপেশিয়া, লরা বেসি, সোফিয়া কোভালেভস্কিয়া, লিস মিটনার, ক্যারলিন হারসেল, মেরি এনিং, রোজালিন ফ্রাঙ্কলিন, সোফি জার্মেইন, এ্যাডা বায়রন, রোজসা স্মিথ, মেরি করি, এমি নোয়েথার, হেলেন সয়ার হগ, মেরি স্টোপস, মিলেভা আইনস্টাইন, ভারতবর্ষের খনা, বাংলাদেশের ফজিলাতুন্নেসা ও শান্তিসুধা ঘোষ পর্যন্ত এমন অনেক নাম ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে।

এছাড়াও মহাকাশ বিজ্ঞান এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানে বর্তমান সাফল্যের যুগে রয়েছে আরও অনেক নাম যারা তাদের পুরুষ সহযোগীদের সঙ্গে একই প্লাটফর্মে কাজ করেছেন, কাজ করেছেন গবেষণাগারে।

তাদের প্রায় সবারই চলার পথ ছিল পুরুষশাসিত সমাজের বৈষম্যতার পাশাপাশি নানা পারিবারিক এবং প্রতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতার শিকার।

তাদের কাউকে অপরূপা হওয়ার জন্য গবেষণাগারে প্রথমে ঢুকতে দেয়া হয়নি, কাউকে পুরুষের নাম নিয়ে ছদ্মনামে গবেষণাপত্র জমা দিতে হয়েছে, কেউ নামমাত্র সম্মানী বা বিনা বেতনে পুরুষ সহযোগীদের সঙ্গে কাজ করেছেন আর কেউ ৩০ বছর টানা এক পুরুষ সহযোগীর সঙ্গে কাজ করে সম অবদান রাখা সত্ত্বেও নোবেল পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন সেই সহযোগীর ষড়যন্ত্রের রোষানলে পড়ে!

 

সম্প্রতি কোষ বিভাজন নিয়ে গবেষণা করে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী স্যার টিম হান্ট নারী বিজ্ঞান গবেষক ও বিজ্ঞানকর্মীদের অবমাননা করে সমালোচনার ঝড় তুলেছেন। একবিংশ শতাব্দীতে এসে যখন লিঙ্গবৈষম্য দূর করার জন্য সব ক্ষেত্রে চলছে প্রাণান্ত সাধনা, তখন এমন বিয়োগান্তক মন্তব্য সামাজিক প্রভাব ফেলে বৈকি।

৯ জুন ২০১৫ দক্ষিণ কোরিয়ার এক ‘বিজ্ঞান সাংবাদিকদের বিশ্ব সম্মেলন’-এ হান্ট বলেছেন, ‘যখন নারীরা গবেষণাগারে থাকে তখন মূলত তিনটি সমস্যার সৃষ্টি হয়-

১. আপনি তাদের প্রেমে পড়তে পারেন,
২. তারা আপনার প্রেমে পড়তে পারেন এবং
৩. আপনি যখন তাদের সমালোচনা করবেন তারা কেঁদে ফেলবেন।’

এ ধরনের বিজ্ঞান বিষয়ক মুক্ত ফোরামে বসে পাশ্চাত্যের একজন প্রোথিতযশা নোবেল বিজয়ীর কাছ থেকে এমন খেলো এবং তাচ্ছিল্যকর মন্তব্য শুধু নারীজাতির জন্যই নয়, বৃহৎ স্বার্থে মানবজাতির জন্য অবমাননাকর।
বিষয়টি নিয়ে ওঠে সমালোচনার ঝড় এবং সর্বশেষ ২০০১ সালের এই নোবেলজয়ী তার ভুল স্বীকার করে নিয়ে ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনের (ইউসিএল) জীববিজ্ঞান অনুষদ থেকে পদত্যাগ করেন। যদিও তিনি পরে বলেছেন, তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে।

আমাদের মতো বিজ্ঞানকর্মীদের জন্য এটা আশার বাণী যে, হান্ট অনুতপ্ত হয়েই হোক বা বিজ্ঞানুরাগীদের চাপে পড়েই হোক, নিজের ভুলটি বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু আমরা মনে করি, এতবড় প্লাটফর্মে বসে যখন কেউ এমন কথা বলবেন, তখনই তার তাৎক্ষণিক সমাধান করা উচিত এবং এমন দৃষ্টান্ত রাখা উচিত, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এর পুনরাবৃত্তি করতে না পারেন।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

সভ্যতা নারী ও নোবেলজয়ীর অমর্যাদাকর উক্তি

আপডেট টাইম : ০৩:৫৫:০৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৬ জুন ২০১৫

“ছুন্নত দিলে হয় মুসলমান,
নারীলোকের কী হয় বিধান?
বামন চিনি পৈতে প্রমাণ,
বামনী চিনি কিসে রে?
সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে।”

মহান সঙ্গীতসাধক লালন ফকির (১৭৭৪-১৮৯০) তার জীবনের এক কঠিন সংগ্রামী সময়ে নারী-পুরুষের বৈষম্যের কথা প্রকাশ করেছেন এই সঙ্গীত দিয়ে।

সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই নারী-পুরুষ একে অন্যের জন্য পরিপূরক— এই ধ্রুব সত্যটি জেনেও নানা সময়ে বিভিন্ন আঙ্গিকে এই লিঙ্গবৈষম্যের দ্বৈরথ প্রোথিত করেছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা।

যদি বিশ্লেষণ করি বিজ্ঞানের ইতিহাসের আলোকে, সেখানে প্রারম্ভিক সময়টাতে নারীকে তুলনা করা হয়েছে কারিগর বা উদ্ভাবক হিসেবে। কারণ, ধারণা করা হয় নারীরা আগুনের আবিষ্কারসহ কৃষিকাজ, সুতার যন্ত্র এবং মৃৎপাত্র তৈরিসহ অনেক যুগান্তকারী ঘটনার সূচনা করেছিলেন।

তখন ছিল মাতৃতান্ত্রিক পরিবারব্যবস্থা। কিন্তু যখন থেকে শুরু হয়েছিল সম্পদ আর সম্পত্তির হিসাব-নিকাশ, তখন ধীরে ধীরে নারীরা কোণঠাসা হয়ে মুক্ত জীবন থেকে অন্তরিত হল মহলে। যেমন- বাংলায় তাদের বলা হল মহিলা (মহলে থাকে যে; জানা যায় মহল থেকে মহিলা শব্দের বুৎপুত্তি!)।

 

যদিও নিজস্ব সত্তা ও স্বকীয়তা তুলে ধরার জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রের পাশাপাশি বিজ্ঞানে নারীর সংগ্রাম চলমান ছিল আর এখনো চলছে।

সেই থিয়ানো, হাইপেশিয়া, লরা বেসি, সোফিয়া কোভালেভস্কিয়া, লিস মিটনার, ক্যারলিন হারসেল, মেরি এনিং, রোজালিন ফ্রাঙ্কলিন, সোফি জার্মেইন, এ্যাডা বায়রন, রোজসা স্মিথ, মেরি করি, এমি নোয়েথার, হেলেন সয়ার হগ, মেরি স্টোপস, মিলেভা আইনস্টাইন, ভারতবর্ষের খনা, বাংলাদেশের ফজিলাতুন্নেসা ও শান্তিসুধা ঘোষ পর্যন্ত এমন অনেক নাম ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে।

এছাড়াও মহাকাশ বিজ্ঞান এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানে বর্তমান সাফল্যের যুগে রয়েছে আরও অনেক নাম যারা তাদের পুরুষ সহযোগীদের সঙ্গে একই প্লাটফর্মে কাজ করেছেন, কাজ করেছেন গবেষণাগারে।

তাদের প্রায় সবারই চলার পথ ছিল পুরুষশাসিত সমাজের বৈষম্যতার পাশাপাশি নানা পারিবারিক এবং প্রতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতার শিকার।

তাদের কাউকে অপরূপা হওয়ার জন্য গবেষণাগারে প্রথমে ঢুকতে দেয়া হয়নি, কাউকে পুরুষের নাম নিয়ে ছদ্মনামে গবেষণাপত্র জমা দিতে হয়েছে, কেউ নামমাত্র সম্মানী বা বিনা বেতনে পুরুষ সহযোগীদের সঙ্গে কাজ করেছেন আর কেউ ৩০ বছর টানা এক পুরুষ সহযোগীর সঙ্গে কাজ করে সম অবদান রাখা সত্ত্বেও নোবেল পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন সেই সহযোগীর ষড়যন্ত্রের রোষানলে পড়ে!

 

সম্প্রতি কোষ বিভাজন নিয়ে গবেষণা করে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী স্যার টিম হান্ট নারী বিজ্ঞান গবেষক ও বিজ্ঞানকর্মীদের অবমাননা করে সমালোচনার ঝড় তুলেছেন। একবিংশ শতাব্দীতে এসে যখন লিঙ্গবৈষম্য দূর করার জন্য সব ক্ষেত্রে চলছে প্রাণান্ত সাধনা, তখন এমন বিয়োগান্তক মন্তব্য সামাজিক প্রভাব ফেলে বৈকি।

৯ জুন ২০১৫ দক্ষিণ কোরিয়ার এক ‘বিজ্ঞান সাংবাদিকদের বিশ্ব সম্মেলন’-এ হান্ট বলেছেন, ‘যখন নারীরা গবেষণাগারে থাকে তখন মূলত তিনটি সমস্যার সৃষ্টি হয়-

১. আপনি তাদের প্রেমে পড়তে পারেন,
২. তারা আপনার প্রেমে পড়তে পারেন এবং
৩. আপনি যখন তাদের সমালোচনা করবেন তারা কেঁদে ফেলবেন।’

এ ধরনের বিজ্ঞান বিষয়ক মুক্ত ফোরামে বসে পাশ্চাত্যের একজন প্রোথিতযশা নোবেল বিজয়ীর কাছ থেকে এমন খেলো এবং তাচ্ছিল্যকর মন্তব্য শুধু নারীজাতির জন্যই নয়, বৃহৎ স্বার্থে মানবজাতির জন্য অবমাননাকর।
বিষয়টি নিয়ে ওঠে সমালোচনার ঝড় এবং সর্বশেষ ২০০১ সালের এই নোবেলজয়ী তার ভুল স্বীকার করে নিয়ে ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনের (ইউসিএল) জীববিজ্ঞান অনুষদ থেকে পদত্যাগ করেন। যদিও তিনি পরে বলেছেন, তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে।

আমাদের মতো বিজ্ঞানকর্মীদের জন্য এটা আশার বাণী যে, হান্ট অনুতপ্ত হয়েই হোক বা বিজ্ঞানুরাগীদের চাপে পড়েই হোক, নিজের ভুলটি বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু আমরা মনে করি, এতবড় প্লাটফর্মে বসে যখন কেউ এমন কথা বলবেন, তখনই তার তাৎক্ষণিক সমাধান করা উচিত এবং এমন দৃষ্টান্ত রাখা উচিত, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এর পুনরাবৃত্তি করতে না পারেন।