দেশে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি, বিএনপিতে ফের যোগ দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ, বর্তমান সরকারের প্রতি বিষেদগার বক্তব্য, স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির খোঁজে দুদকের অনুসন্ধানসহ নানা বিষয় নিয়ে বারবারই রাজনীতির মাঠের আলোচনায় এসেছেন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) চেয়ারম্যান ড.কর্নেল (অব) অলি আহমেদ বীরবিক্রম।
কর্নেল (অব.) অলি আহমেদ দেশের প্রথম সারির মুক্তিযোদ্ধা ও বিএনপি সরকারের মন্ত্রী। ১৯৭১ সালে তিনি চট্টগ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহে অংশ নেন। স্বাধীনতাযুদ্ধে সাহসিকতার জন্য বঙ্গবন্ধু সরকার তাকে বীর বিক্রম খেতাব দেন। জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করবার পর তিনি সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে রাজনীতিতে যোগ দেন। অলি আহমেদের পৈতৃক বাড়ি চট্টগ্রাম জেলার চন্দনাইশ উপজেলার চন্দনাইশে। তার বাবার নাম আমানত ছাফা এবং মায়েরর নাম বদরুননেছা। তার স্ত্রীর নাম মমতাজ বেগম। তাদের দুই মেয়ে ও দুই ছেলে।
তার কর্মজীবন সম্পর্কে জানা যায়, ১৯৭১ সালে অলি আহমদ কর্মরত ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। এর অবস্থান ছিল নগরের ষোলশহরে। সেই ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে পুনরায় সংগঠিত হওয়ারর পর নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর জেড ফোর্সেও অধীনে যুদ্ধ করেন। স্বাধীনতার পর তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্নেল পদে উন্নীত হয়ে অবসর নেন। পরে রাজনীতিতে যোগ দেন।
জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠন করলে সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে তিনি রাজনীতিতে যোগ দেন। তখন তার আরো ৯ বছর চাকরির মেয়াদ ছিল। এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবেভাবে অংশ নেন। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠন করলে তিনি যোগাযোগ মন্ত্রী হন। যমুনা সেতুর কাজ তার সময়েই শুরু। দীর্ঘকাল বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত থাকার পর ২০০৬ সালের ২৬ অক্টোবর তিনি সাবেক রাষ্ট্রপতি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সঙ্গে লিবারেল ডেমোক্রাটিক পার্টি গঠন করেন। পরে তিনি এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর সঙ্গে মতবিরোধের পর সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন।
এদিকে গত বছর নানা আলোচনাতেই রাজনীতির মাঠে এলডিপি সভাপতি অলি আহমেদ সরব ছিলেন। গত বছরের জানুয়ারিতে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত বছরের ১ জানুয়ারি সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন সংস্থার উপপরিচালক রাম মোহন নাথ।
দুদক সূত্র জানায়, বিলুপ্ত দুর্নীতি দমন ব্যুরো ১৯৯৬ সালে অলি আহমদকে একটি নোটিশ দেয়। সেই নোটিশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে তিনি রিট আবেদন করেন। দীর্ঘ শুনানির পর ২০০৭ সালে আদালত দুদকের পক্ষে রায় দেন।
ওই রায়ে বলা হয়, দুদকের নোটিশটি কার্যকর করতে কোনো সমস্যা নেই। এরই ধারাবাহিকতায় অলিকে সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়ার নোটিশ দেওয়া হয়। দুদকের কর্মকর্তা গোলাম ফারুক গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর হিসাব বিবরণী দেওয়ার জন্য অলি আহমদকে নোটিশ পাঠিয়েছিলেন। ২৫ সেপ্টেম্বর দুদকে এসে তার সম্পদের হিসাব জমা দেন অলি আহমদ।
ওই দিন অলি আহমদ সংবাদিকদের বলেন, মহাজোট সরকারের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ না করার ‘খেসারত’ হিসেবে তাকে দুদকে আসতে হয়েছে। হিসাব বিবরণী পর্যালোচনা করার জন্য দুদক অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ করে। ওই কর্মকর্তা হিসাবটি সঠিক ও যথার্থ কিনা তা যাচাই-বাছাই করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুদকে তলব করেন অলি আহমদকে।
এদিকে গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের চন্দনাইশ পৌরসভা গনতান্ত্রিক যুব ও ছাত্র দলের দ্বি-বার্ষিক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) চেয়ারম্যান ড. কর্নেল (অব) অলি আহমেদ বীরবিক্রম বলেন, এ সরকারের সময়েই তিন বছরের মধ্যে দেশের হাজার কোটি টাকা লুট করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। দেশের দুর্নীতি দমনের একমাত্র সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানটি আজ বিশেষভাবে প্রভাবিত বলে মনে হচ্ছে। কারণ এ দুদক তাদের খোঁজে না, খোঁজে শুধু আমাদের। বাপ-দাদার সহায় সম্পতি মিলে সর্বসাকুল্যে দেড় কোটি টাকার মালিক আমি। আমাকে দুদুক নোটিস দেয়। আমাকে তলব করে। অথচ এনবিআরে যারা সম্পদের হিসাব জমা দিয়েছে, তাদের পরিসংখ্যান ঘাটলে দেখা যাবে গত ৯ বছরে সরকারি কর্মচারী থেকে শুরু করে সরকারের সুবিধাভোগী লোকেরা অগাধ টাকার মালিক হয়েছে। এটাকে শাসন বলে না। চরম স্বেচ্ছাচারিতার এক নগ্ন দৃষ্টান্ত দেখাচ্ছে বর্তমান সরকার।
দেশের গনতন্ত্র উন্নয়ন ও আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠায় নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের কোনো বিকল্প নেই উল্লেখ করে প্রবীন এ নেতা বলেন, সরকারকে অবশ্যই একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। তিনি আরো বলেন, বর্তমানে সরকারকে টিকিয়ে রেখেছে আইনশৃঙ্খলার সঙ্গে জড়িত কিছু সদস্য এবং কিছু অসাধু আমলা। আমি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য অনুরোধ করেছি এবং বলেছি আপনার করার কিছু নেই। তার কারণ আমরা কেউ আপনাকে সেই সুযোগ করে দেইনি।
অলি বলেন, দেশে একের পর এক খুন হচ্ছে। তার কোনো বিচার হচ্ছে না। এজন্য একদিন প্রধানমন্ত্রীকে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। আমরা দেশে রাজনীতি করি দেশে আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য। কিন্তু দেশে সে ধারা সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ নেই। আগে যাদের পকেট শূন্য ছিল আজ তারা কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। আমি ৪৫ বছর ধরে রাজনীতি করছি। অবৈধ উপায়ে সম্পদ অর্জন করিনি।
জানা যায়, ২০০৫ সালে অলি আহমদ বিএনপি ছেড়ে নতুন দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) গঠন করার পর থেকে অনেকে দলে নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকতে পারেননি বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। দল গঠনের পর ২০০৬ সালের নির্বাচন সামনে রেখে দলের অনেকে ভিড়ে যান মহাজোটে। ২০০৬ সালে সম্ভাব্য নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ২৯টি আসনে নির্বাচন করার সুযোগ করে দেন এলডিপিকে। কিন্তু ২০০৮ সালে মহাজোটের সঙ্গে জোটবদ্ধ নির্বাচন করতে পারেননি অলি আহমদ। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আবার ২০ দলীয় জোটে অন্তর্ভুক্ত হয় অলির এলডিপি। এভাবে জোট বদল ও এক জায়গায় স্থির হতে না পারাকে এলডিপির পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। তবে এ নিয়ে অলি আহমেদের বক্তব্য আশাবাদী।
তিনি বলেন, দেশের পঞ্চম বৃহত্তম রাজনৈতিক দল এলডিপি। রাজনৈতিক দল হিসেবে এলডিপিরও সবসময় এক রকম যাবে এটা ঠিক নয়। চট্টগ্রামসহ সারাদেশে বিভিন্ন পর্যায়ে আমাদের কমিটি রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ভয়-ভীতিকে তোয়াক্কা না করে যে দলগুলো কথা বলছে এলডিপি তাদের অন্যতম।
জানা যায়, বিএনপি-জামায়াত জোটের আরেক শরিক এলডিপির চেয়ারম্যান অলি আহমেদ বিএনপিতে থাকাকালে জামায়াত নিয়ে তার আপত্তির কথা প্রকাশ্যে বলেছেন। স্বাধীনতাবিরোধী দলটির সঙ্গে জোটবদ্ধ থাকায় আপত্তি জানিয়েই তিনি বিএনপি ছেড়েছিলেন। এরপর তিনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোটে যোগ দেন। পরে ২০০৭ সালের নির্বাচন বাতিলের পর এই জোট আর টেকেনি। আর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নির্বাচনে মহাজোট অলি আহমেদকে আর নেয়নি। আর এক পর্যায়ে ‘জামায়াতের আপত্তি’ ভুলে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে ২০ দলে যোগ দেন অলি আহমেদ।
জামায়াতকে জোটে রেখে জাতীয় ঐক্য সম্ভব কিনা মুঠোফোনে অলি আহমেদের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, এ ব্যাপারে হাইকোর্টের আদেশ রয়েছে। তাই এ নিয়ে মন্তব্য করতে চান না তিনি। তবে জাতীয় ঐক্যের ওপর জোর দিয়ে কথা বলেন অলি আহমেদ।
জানা যায়, রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত হাইকোর্ট বহাল রেখেছে। স্বাধীনতাবিরোধী এই দল নিষিদ্ধ করার বিষয়ে আবেদনের শুনানিও উচ্চ আদালতে ঝুলে আছে।
জামায়াত প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে অলি আহমেদ বলেন, বিদেশি স্বার্থন্বেষী মহলের ইন্ধনে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিচ্ছে। বর্তমান সময়ে জাতীয় ঐক্য খুবই জরুরি। আর একমাত্র জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়েই এই ঐক্য হতে পারে। দেশ আজ দুর্নীতিতে ভরে গেছে। দুর্নীতিবাজদের টাকা থাকায় তাদের শাস্তি হয় না। বাংলাদেশ থেকে এক লাখ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন অলি আহমদ।
তিনি বলেন, এসবের পেছনে যারা জড়িত সরকার তাদের আশ্রয় দিচ্ছে। অনেক রাজনীতিক ও আমলার বিদেশে সেকেন্ড হোম রয়েছে। দেশের অবস্থা বেগতিক দেখলেই তারা বিদেশ পাড়ি জমাবে। সঙ্কট সমাধানের জন্য একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন প্রয়োজন। আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সেই নির্বাচনের পদ্ধতি নির্ধারণ করতে হবে। সংবিধান তো কোরআন শরীফ নয় যে পরিবর্তন করা যাবে না। সময়ের প্রয়োজনে সংবিধান সংশোধন হতে পারে। এজন্য আমাদের চেয়ার ছেড়ে দিতে হলেও দিতে হবে। এই মন মানসিকতা তৈরি করতে হবে।
জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে ২০ দলীয় জোটের এই শীর্ষ নেতা বলেন, সব সমস্যা সমাধানের জন্য জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। সকলকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি সুষ্ঠু অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে হবে। এ জন্য সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। এর মাধ্যামে দেশের সঙ্কট দূর হবে এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে।
সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘দেশে জঙ্গিবাদের কারণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকা। এ কারণে জনগণ চরম অনিশ্চয়তায় ভুগছে। ফলে, তারা জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকছে। এর দায় বেশি বর্তায় সরকারের ওপর।
বিকল্পধারাসহ সবাই বিএনপিতে ফিরে যাওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত কেন সেটি হয়নি, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, আমি বিএনপিতে যাচ্ছি, এটা আমি কখনো বলিনি। আর বিএনপিতে যাওয়ার বিষয়ে কোনো আলোচনা আমাদের ফোরামে হয়নি। এটা গুজব। কথা হচ্ছে আমরা বিশ দলে আছি, এ জোটে আমরা আমাদের সক্ষমতা দেখাতে চাই।