ঢাকা ১২:০৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

‘পয়সা’ দোহানে চলে না বাবা, কাগজের ট্যাকা দেন

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:৫১:৫৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৬
  • ৩৮৭ বার

নাম নূর মোহাম্মদ। বয়স ৬০ বছর। পেশায় তিনি একজন ভিক্ষুক। তবে নূর মোহাম্মদ আগে ভিক্ষুক ছিলেন না। সমাজের আট-দশটা মানুষের মত তারও সংসার ছিলো। ছিলো জীবিকা নির্বাহের জন্য একটি কর্ম। তিনি কাজ করতেন নিজ এলাকার একটি রাইস মিলে। থাকেন ধামরাইয়ের কুশুরা এলাকায়। তিন ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে দুবেলা খেয়ে দিন ভালোই কেটে যাচ্ছিলো নূর মোহাম্মদের।

একদিন দুপুর বেলা রাইস মিলে কাজ করা অবস্থায় অজানা এক শব্দে আঁধার নেমে আসে তার দু’চোখে। নূর মোহাম্মদ জানান, রাইস মিলের যন্ত্রটির বেল্ট ছিড়ে গিয়ে সজোরে আঘাত হানে তার দুই পায়ে। মুহুর্তের মধ্যেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে হাসপাতালের বিছানায় পড়ে থাকতে দেখেন। সেই দিনের পর থেকে নূর মোহাম্মদকে চলতে হয় দুটি লাঠিতে ভর দিয়ে। দুই পা অচল হওয়ায় বাধ্য হয়ে তিনি বেছে নেন ভিক্ষাবৃত্তি।

সাভারের নবীনগর এলাকার স্মৃতিসৌধের অদূরে রাস্তার পাশে বসে প্লাস্টিকের মাদুর পেতে বসে নূর মোহাম্মদ কথাগুলো বলছিলেন। তিনি বলেন, মাঝে মধ্যেই তিনি এখানে বসে ভিক্ষা করেন। তবে ধামরাই থেকে বাসযোগে এতদূর আসতে ভীষণ কষ্ট হয়। কিন্তু পেটের ক্ষুধা তো আর এসব মানে না। তাই বিশ বছর ধরে এভাবেই ভিক্ষা করে চলেছেন তিনি।

দিনভর ‘একটা ট্যাকা দ্যান গো আব্বা’ এই বুলি আওড়িয়ে দু’হাত পেতে ভিক্ষা চান নূর মোহাম্মদ। কারো মনে দয়া হলে সাহায্য করে যান তাকে। আবার কেউ নাচ কুঁচকিয়ে চলে যান পাশ কেটে। আর এদের মধ্যে যদি কেউ সাহায্য হিসেবে ‘পয়সা’ দিতে চান তখনই ঘটে বিপত্তি। নূর মোহাম্মদ চিৎকার করে তাকে পয়সা ফেরত নিতে ডাকেন।

ওই সময় নূর মোহাম্মদকে ব্যাঙ্গাত্মক স্বরে বলতে শোনা যায়, ‘এই যে বাপ নিয়া যান তো আপনার পয়সা। কাছে ট্যাকা থাকলে দুইডা দিয়া যান। আর না থাকলে কিছুই লাগবো না।’ কেন পয়সা নিবেন না? এমন প্রশ্নে নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘দোকানে এক ট্যাকা আর দুই ট্যাকার পয়সা নেয় না। কিন্তু পাঁচ টাকার পয়সা নেয়।’

ভিক্ষার টাকায় এতবড় সংসার কিভাবে চলে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হারাটা দিন চিল্লাচিল্লি করে কোনোদিন একশ ট্যাকা আবার কোনোদিন দুইশ ট্যাকা পাই। আর পোলা-মাইয়া গার্মেন্ট খাটে। কিন্তু আমাগো আর এহন দ্যাহে না। খাইতে তো অইবো। ভিক্ষা না কইরা করুম কি বাবা?’

শরীর খারাপ হলে কি করেন? জানতে চাইলে নূর মোহাম্মদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘কি আর করমু বাবা। তহন শুইয়া শুইয়া আল্লাহ্রে ডাকি। আর ধার দ্যানা কইরা চলি। হেই সময় খুব কষ্ট হয়। কি করমু বুইঝা হারা পারি না’।

নূর মোহাম্মদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে অনেকটা সময় পেরিয়ে যায়। হঠাৎ লোকজনের আনাগোনা বেড়ে যাওয়ায় আর কথা বলতে চান না তিনি। সেখান থেকে যাওয়ার পর আবার ‘একটা ট্যাকা দ্যান গো আব্বা’ বলে দুই হাত পেতে ভিক্ষা করতে থাকেন নূর মোহাম্মদ।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

‘পয়সা’ দোহানে চলে না বাবা, কাগজের ট্যাকা দেন

আপডেট টাইম : ১২:৫১:৫৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০১৬

নাম নূর মোহাম্মদ। বয়স ৬০ বছর। পেশায় তিনি একজন ভিক্ষুক। তবে নূর মোহাম্মদ আগে ভিক্ষুক ছিলেন না। সমাজের আট-দশটা মানুষের মত তারও সংসার ছিলো। ছিলো জীবিকা নির্বাহের জন্য একটি কর্ম। তিনি কাজ করতেন নিজ এলাকার একটি রাইস মিলে। থাকেন ধামরাইয়ের কুশুরা এলাকায়। তিন ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে দুবেলা খেয়ে দিন ভালোই কেটে যাচ্ছিলো নূর মোহাম্মদের।

একদিন দুপুর বেলা রাইস মিলে কাজ করা অবস্থায় অজানা এক শব্দে আঁধার নেমে আসে তার দু’চোখে। নূর মোহাম্মদ জানান, রাইস মিলের যন্ত্রটির বেল্ট ছিড়ে গিয়ে সজোরে আঘাত হানে তার দুই পায়ে। মুহুর্তের মধ্যেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে হাসপাতালের বিছানায় পড়ে থাকতে দেখেন। সেই দিনের পর থেকে নূর মোহাম্মদকে চলতে হয় দুটি লাঠিতে ভর দিয়ে। দুই পা অচল হওয়ায় বাধ্য হয়ে তিনি বেছে নেন ভিক্ষাবৃত্তি।

সাভারের নবীনগর এলাকার স্মৃতিসৌধের অদূরে রাস্তার পাশে বসে প্লাস্টিকের মাদুর পেতে বসে নূর মোহাম্মদ কথাগুলো বলছিলেন। তিনি বলেন, মাঝে মধ্যেই তিনি এখানে বসে ভিক্ষা করেন। তবে ধামরাই থেকে বাসযোগে এতদূর আসতে ভীষণ কষ্ট হয়। কিন্তু পেটের ক্ষুধা তো আর এসব মানে না। তাই বিশ বছর ধরে এভাবেই ভিক্ষা করে চলেছেন তিনি।

দিনভর ‘একটা ট্যাকা দ্যান গো আব্বা’ এই বুলি আওড়িয়ে দু’হাত পেতে ভিক্ষা চান নূর মোহাম্মদ। কারো মনে দয়া হলে সাহায্য করে যান তাকে। আবার কেউ নাচ কুঁচকিয়ে চলে যান পাশ কেটে। আর এদের মধ্যে যদি কেউ সাহায্য হিসেবে ‘পয়সা’ দিতে চান তখনই ঘটে বিপত্তি। নূর মোহাম্মদ চিৎকার করে তাকে পয়সা ফেরত নিতে ডাকেন।

ওই সময় নূর মোহাম্মদকে ব্যাঙ্গাত্মক স্বরে বলতে শোনা যায়, ‘এই যে বাপ নিয়া যান তো আপনার পয়সা। কাছে ট্যাকা থাকলে দুইডা দিয়া যান। আর না থাকলে কিছুই লাগবো না।’ কেন পয়সা নিবেন না? এমন প্রশ্নে নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘দোকানে এক ট্যাকা আর দুই ট্যাকার পয়সা নেয় না। কিন্তু পাঁচ টাকার পয়সা নেয়।’

ভিক্ষার টাকায় এতবড় সংসার কিভাবে চলে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হারাটা দিন চিল্লাচিল্লি করে কোনোদিন একশ ট্যাকা আবার কোনোদিন দুইশ ট্যাকা পাই। আর পোলা-মাইয়া গার্মেন্ট খাটে। কিন্তু আমাগো আর এহন দ্যাহে না। খাইতে তো অইবো। ভিক্ষা না কইরা করুম কি বাবা?’

শরীর খারাপ হলে কি করেন? জানতে চাইলে নূর মোহাম্মদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘কি আর করমু বাবা। তহন শুইয়া শুইয়া আল্লাহ্রে ডাকি। আর ধার দ্যানা কইরা চলি। হেই সময় খুব কষ্ট হয়। কি করমু বুইঝা হারা পারি না’।

নূর মোহাম্মদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে অনেকটা সময় পেরিয়ে যায়। হঠাৎ লোকজনের আনাগোনা বেড়ে যাওয়ায় আর কথা বলতে চান না তিনি। সেখান থেকে যাওয়ার পর আবার ‘একটা ট্যাকা দ্যান গো আব্বা’ বলে দুই হাত পেতে ভিক্ষা করতে থাকেন নূর মোহাম্মদ।