২৫-২৬ জুন মধ্যরাতে ভারতে জরুরি অবস্থার ৪০ বছর পূর্তি হবে। ৪০ বছর পর প্রায় ৯০ ছুঁই ছুঁই প্রবীণ বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি কেন এই দিনটির কথা উসকে দিলেন? যাদের ৪০ বা ৫০ বছর বয়স তাদেরও স্মরণে থাকার কথা নয় জরুরি অবস্থার দিনগুলো। ৪০ বছর আগে জরুরি অবস্থা জারির সিদ্ধান্ত কেন নেওয়া হয়েছিল?
সেদিন কী ঘটেছিল তার নেপথ্যটা একটু দেখা দরকার। আগের প্রায় তিন মাস ধরে জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতত্বে সারা দেশে ইন্দিরা-সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন এমন পরিস্থিতি তৈরি করে যাতে বাধ্য হয়ে ইন্দিরা গান্ধী মধ্যরাতে রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়ে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আলি আহমেদকে দিয়ে সই করিয়ে আনেন। সেদিন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন থেকে রাষ্ট্রপতি ভবন পর্যন্ত গাড়ি চালকের ভূমিকা নিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়।
‘৭০-৭১ সালের নির্বাচনে রায়বেরিলি কেন্দ্রে ইন্দিরার প্রচারসঙ্গী ছিলেন একজন অতিরিক্ত ব্যক্তিগত সচিব। তিনি একজন সরকারি কর্মচারী। তারই প্রতিবাদে তার প্রতিদ্বন্দ্বী রাজ নারায়ণ এলাহাবাদ হাইকোর্টে একটি মামলা করেন। জরুরি অবস্থা জারির চার মাস আগে ওই মামলায় হেরে যান ইন্দিরা। তখন তার পরামর্শদাতা কংগ্রেস সভাপতি দেবকান্ত বরুয়া পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় এবং তামিলনাড়ুর নেতা মোহন কুমার মঙ্গলম তাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার পরামর্শ নেন। ইন্দিরার হয়ে মামলা পরিচালনা করছিলেন সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়। ওই তিন নেতা গোপনে ষড়যন্ত্র করেন ইন্দিরাকে সরিয়ে তাদের মধ্যে কেউ প্রধানমন্ত্রী হবেন। জয় প্রকাশ নারায়ণ বিহার এবং গুজরাটে বিধানসভা ঘেরাও করে তা ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করেন।
সোশালিস্ট পার্টির জর্জ ফার্নান্ডেজ রেল-শ্রমিকদের নির্দেশ দেন রেলের সব লাইন তুলে দাও আর কম্পার্টমেন্টগুলোয় আগুন জ্বালিয়ে দাও। এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য ইন্দিরার নিজের ভাষায় জরুরি অবস্থা জারি করতে বাধ্য হন। জরুরি অবস্থার ফায়দা তুলতে গিয়ে সিদ্ধার্থ শঙ্করের পরামর্শে দেশে সেন্সরশিপ চালু করা হয়।
এই জরুরি অবস্থার আমিও একজন শিকার তা বিস্তারিত বলার আগে ২৬ জুনের কয়েকটি ঘটনা এখানে বলছি। কলকাতার সাংবাদিকরা সেদিন বিধান সভায় সিদ্ধার্থ বাবুর ঘরের সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। হঠাৎ সিদ্ধার্থ বাবু আমাদের দেখে বললেন, তোমরা এখানে? আমি তো সেন্সরশিপ জারি করে দিয়েছি। তোমাদের সেই পাইপ-খাওয়া রিপোর্টার কোথায়? তাকে আজই গ্রেফতার করব। আর তোমাদের রাইটার্সের আড্ডাখানা ‘প্রেম কর্নার’ বন্ধ করে দিয়েছি।
জরুরি অবস্থার কিছুদিন আগে সিদ্ধার্থ ঘনিষ্ঠ প্রিয়রঞ্জন দাশ মুন্সিকে সর্বভারতীয় যুব কংগ্রেসের সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তার জায়গায় আনা হয় অম্বিকা সোনিকে। সে সময় কংগ্রেসের বহু নেতাকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল। আনন্দবাজারের আমার দুই সহকর্মী বরুণ সেনগুপ্ত এবং সাংবাদিক-সাহিত্যিক গৌরকিশোর ঘোষকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল। বিরোধীরা অভিযোগ করতেন, ইন্দিরা গান্ধী নাকি ‘নামবন্দী’ করাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে। ইন্দিরার ছোট ছেলে সঞ্জয় গান্ধী ছোট পরিবারের পক্ষে সওয়াল করতে গিয়ে বলেছিলেন- হাম দো, হামারা দো। কিন্তু সেই সুযোগ নিয়ে বিরোধীরা বলতে শুরু করে গ্রামেগঞ্জে জোর করে পুরুষ-মহিলাদের নির্বিচারে প্রজনন-ক্ষমতা অকার্যকর করে দেওয়া হচ্ছে। সঞ্জয় গাছ লাগানোর কথা বলেছিলেন। তা নিয়েও বিরোধীরা সরব হয়ে ওঠেন। বৃক্ষরোপণও সেদিন ইন্দিরা-সঞ্জয়ের অপরাধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
আর সিদ্ধার্থ শঙ্করের পরামর্শে মেইনটেন্যান্স অব ইন্টারনাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট (মিসা)। এ আইনে বামপন্থী, ডানপন্থী বহু নেতাকর্মীসহ কংগ্রেসেরও ১৪ হাজার কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। আন্দোলনরত মেধাবী ছাত্রদের আইন রক্ষার নামে গুলি করে হত্যা করা হয়। সেদিনের হত্যালীলার হিসাব আজো পাওয়া যায়নি।
জরুরি অবস্থার দিনই সিদ্ধার্থ শঙ্করের কথা শুনে আমরা চলে গেলাম রাইটার্স বিল্ডিংয়ে। সেখানে ততক্ষণে চারটা বড় বড় তালা দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে প্রেম কর্নার। আমরা তখন বারান্দায় ঘোরাফেরা করছি। সে সময় টাইমস অব ইন্ডিয়ার ব্যুরো চিফ শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, যুগান্তরের শ্যাম মল্লিক আর আমি বরকত গনি খান চৌধুরীর ঘরে গেলাম। উনি আমাদের দেখে বললেন, আমি আপনাদের চিনি না। তারপর গলা নামিয়ে আমাদের বললেন, আমিও এখন মালদহ চলে যাচ্ছি।
দোতলায় নামতেই দেখা হলো যুগান্তর পত্রিকার মালিক তথা মন্ত্রী প্রফুল্লকান্তি ঘোষের সঙ্গে। তিনি বললেন, তোরা আমার ঘরে চলে আয়। খবর রটে যেতেই রাইটার্সের কর্মীরা টেবিল ছেড়ে আমাদের দিকে উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করেন। অফিসে ফিরে দেখি চারদিকে পুলিশ দিয়ে অফিস ঘিরে রাখা হয়েছে। তারা অফিস তল্লাশি করছে। আমাদের ঢুকতে দেওয়া হলো না। আমি আর আমার সহকর্মী চলে গেলাম সম্পাদকের বাড়ি। আমাদের সান্ধ্য একটি পত্রিকা বের হবে কিনা জানতে। সম্পাদক বলে দিলেন, আপনারা কাগজ বের করুন। সিদ্ধার্থ শঙ্করের সঙ্গে আমি বুঝে নেব। আবার ফিরে এলাম। তখন আমাদের সব কপি আগে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে গিয়ে দেখিয়ে আনতে হতো। সেখানে তথ্য দফতরের করনিকরা সাংবাদিকদের রিপোর্ট কাটছাঁট করতেন।
জরুরি অবস্থার সপ্তাহখানেক আগে ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে একটি সভায় যোগ দিতে এসেছিলেন সোশালিস্ট পার্টির জয়প্রকাশ নারায়ণ। তার সভা ভঙ্গ করার জন্য সেদিন তার গাড়িতে উঠে নৃত্য করেছিলেন আজকের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রিপোর্টারদের সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য পুলিশ সেদিন লাঠিচার্জও করেছিল।
জুলাইয়ের ১-২ তারিখ নাগাদ গভীর রাতে আমার বাড়িতে তল্লাশি চালাতে পুলিশ এলো। অবশ্য পুলিশ আসার কয়েক মিনিট আগে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা প্রধান অর্চিষ্মান ঘটক ফোন করে জানিয়েছিলেন, পুলিশ যাচ্ছে, তবে আপনাদের গ্রেফতার করবে না। পরদিন প্রেসনোট দিয়ে সরকার জানিয়েছিল তিনজন সাংবাদিকের বাড়িতে তল্লাশি হয়েছে। আমি ছাড়াও বরুণ সেনগুপ্ত এবং তুষার পণ্ডিতের বাড়িতেও সেদিন পুলিশ গিয়েছিল।
ইতিমধ্যে আনন্দবাজার পত্রিকা ও স্টেটসম্যান জাতীয়করণের জন্য সুপারিশ করেন সিদ্ধার্থ শঙ্কর। দিল্লির ইন্ডিয়ান এঙ্প্রেসকে জাতীয়করণ করা হয় আগেই। বরুণের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। বরুণ পালিয়ে দিল্লি চলে যায় তৎকালীন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের আশ্রয়ে। তিনি বরুণকে একটি গেস্ট হাউসে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। তৎকালীন গোয়েন্দা প্রধান অর্চিষ্মান ঘটক ছিলেন আবার বরুণ সেনগুপ্তের সহপাঠী। তিনিই বরুণকে দিল্লি থেকে নিয়ে আসেন। বরুণকে পাঠানো হয় পুরুলিয়া জেলে।
এর কয়েকদিন পর রাইটার্সে সিদ্ধার্থ শঙ্করের মুখোমুখি হয়েছিলাম। আমাকে দেখেই চিৎকার করে বললেন, তোমাকে রঞ্জিত (তৎকালীন পুলিশ কমিশনার) এখনো গ্রেফতার করেনি? আমি ওর মুখের ওপরই বললাম- আমি তো রাইটার্সেই দাঁড়িয়ে আছি, সাহস থাকলে গ্রেফতার করুন। উনি তড়িঘড়ি নিজের ঘরে গিয়ে ওর প্রচার সচিবকে পাঠালেন আমাকে ডাকার জন্য। আমি যাইনি। অফিসে এসে সব ঘটনা জানালাম। হ্যাঁ যেদিন রাতে পুলিশ এসেছিল তার পরদিন আমি, বরুণ বাবু আর তুষার পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে পাসপোর্ট জমা দিয়ে এসেছিলাম। ইতিমধ্যে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। পরবর্তীকালে সিদ্ধার্থর অপশাসন নিয়ে আমি একটা বই লিখেছিলাম। ‘৭৬ সালের আগস্ট মাসে ইন্দিরা গান্ধীর প্রচার উপদেষ্টা সম্পাদক অশোক সরকারকে একটি টেলেক্স পাঠান। তাতে তিনি অনুরোধ করেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল একজন সাংবাদিককে যেন রাষ্ট্রপুঞ্জে পাঠানো হয়। কারণ বাংলাদেশের সামরিক একনায়ক জিয়াউর রহমান অভিযোগ করেছেন, ফারাক্কার পানি নিয়ে ভারত বাংলাদেশকে মারার চক্রান্ত করছে। এর জবাব দিতে ইন্দিরা তার প্রতিনিধি করে পাঠান তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যুৎ ও সেচমন্ত্রী বরকত গনি খান চৌধুরীকে। অফিস থেকে অশোক সরকার আমায় ডেকে পাঠান। টেলেক্স দেখিয়ে নির্দেশ দিলেন। তোমাকেই যেতে হবে। এবার পাসপোর্ট উদ্ধার করার চেষ্টা কর।
তৎকালীন মুখ্যসচিব বিআর গুপ্তের বাড়িতে গেলাম। তিনি বললেন বিদেশ সচিব জগৎ মেহতা ফোন করেছিলেন, আপনার পাসপোর্ট ছেড়ে দিতে বলেছি। সেদিন ছিল শুক্রবার। পাসপোর্ট নিয়ে ভিসা জোগাড় করে রবিবারই রওনা হতে হয়েছিল আমেরিকা।
তবে তার আগে আমাকে গ্রেফতার করার জন্য ওয়ারেন্ট জারি করেছিল সিদ্ধার্থ শঙ্কর। সে খবরও আমাকে আগেই দিয়ে দেন অর্চিষ্মান ঘটক। আমি বাড়ি থেকে সোজা চলে যাই রাইটার্সে মুখ্যসচিব বিআর গুপ্তের ঘরে। গিয়ে বললাম, এবার আমায় গ্রেফতার করুন। তার তখন সত্যিই করুণ অবস্থা। কী করবেন বুঝতে পারছেন না।
সে সময় বরকত গনি খান চৌধুরী, আবদুস সাত্তার, গোপাল দাস নাগ এবং ভোলা সেন গিয়ে ঢুকলেন সিদ্ধার্থের ঘরে। গিয়ে বললেন, বরুণকে গ্রেফতার করেছেন। এবার একে গ্রেফতার করলে আমরা ইস্তফা দেব। সিদ্ধার্থ শঙ্কর এরপর আমার গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রত্যাহার করে নেন। একাধিক কারণে সিদ্ধার্থ শঙ্কর আমার ওপর ক্ষিপ্ত ছিলেন। বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী (শাজাহান) আমায় বলেছিলেন, আজ সকালে সানু (সিদ্ধার্থ) ফোন করেছিল অভিনন্দন জানাতে। আমি প্রশ্ন করলাম আপনি সানু বাবুকে চিনলেন কী করে? উনি বললেন, প্রেসিডেন্সিতে আমি আর সানু একসঙ্গে পড়তাম। প্রথমবার ও বিএ পরীক্ষা দেয়নি। দ্বিতীয়বার ফেল করেছিল। তৃতীয়বারের বার পাস করে লন্ডনে গিয়েছিলেন ব্যারিস্টারি পড়তে। আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম সানু তুমি বিএ পাস করেছ? এই খবরটাই আমি আনন্দবাজারে লিখে দিয়েছিলাম। হেডিং হয়েছিল- সানু তুমি বিএ পাস করেছ? : শাজাহান। সেই শুরু।
জরুরি অবস্থা প্রত্যাবর্তনের পর শান্তিনিকেতনে ভাষণ দিতে এসিছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। সেখানে প্রশ্ন করেছিলাম সেন্সরশিপ কবে উঠবে? সেখানেও সিদ্ধার্থ শঙ্কর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী জিভ কেটে বলেছিলেন, আজ বিকালেই দিল্লি গিয়ে সেন্সরশিপ তুলে দেব। তিনি তাই করেছিলেন। ৪০ বছর পর সেই জরুরি অবস্থার প্রসঙ্গ লালকৃষ্ণ আদভানি কেন উসকে দিলেন সে প্রশ্নে এখন ভারতবর্ষ তোলপাড় হচ্ছে। -লেখক : ভারতীয় প্রবীণ সাংবাদিক।