‘নীতিনৈতিকতা ও আইনকানুনের তোয়াক্কা করে না কমিটি। নিজেদের খেয়ালখুশি মতো কাজ করে। কে পরীক্ষায় প্রথম হলো, না হলো, সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়, তাদের পছন্দের প্রার্থীকেই চাকরি দেবে তারা। আর বিদ্যালয়ের নিয়োগ পরীক্ষা, তামাশা ছাড়া কিছুই না!’ কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার আলহাজ আমির উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির কাজকর্ম সম্পর্কে স্থানীয় লোকজনের মূল্যায়ন মোটামুটি এমনই।
অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে নিয়োগ পরীক্ষা দিয়ে প্রথম হয়েছিলেন শাম্মী জামাল মুন্নি। কিন্তু তিনি নারী হওয়ার কারণে তাঁকে নিয়োগ দেয়নি কমিটি। কমিটির বক্তব্য, ‘এ মেয়ে এসব দাপ্তরিক কাজ পারবে না!’ এসব নিয়ে শাম্মী বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগ দিলেও কাজ হয়নি। বরং মুন্নির এ তৎপরতার কারণে ওই নিয়োগই বাতিল করে দেয় কমিটি।
নিয়োগ না পেয়ে গত ২২ জানুয়ারি জেলা প্রাশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন শাম্মী জামাল মুন্নি। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে গত ৭ মে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আব্দুছ ছামাদ স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে নিয়োগ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করায় মুন্নিকে ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু এরপরও মুন্নিকে নিয়োগ দেয়নি কমিটি। প্রধান শিক্ষক হুমায়ুন কবির জানান, নতুন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আরো ‘যোগ্য’ কোনো প্রার্থীকে এ পদে নিয়োগ দেওয়া হবে।
গত ২০ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জ শহরের এসভি সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত নিয়োগ পরীক্ষায় ১১ জন পরীক্ষা দিয়েছিলেন। এ পরীক্ষায় মুন্নির প্রথম হওয়ার খবর শুনে পরিবারের লোকজন খুব খুশি হয়। তারা ভেবেছিল, এবার তাদের দারিদ্র্র্য ঘুচবে। কিন্তু বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটি তাঁকে নিয়োগ দেবে না বলে জানিয়ে দিলে হতাশ হয়ে পড়ে পরিবারটি।
মুন্নি বলেন, ‘নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে যদি উল্লেখ থাকত, নারীদের আবেদনের প্রয়োজন নেই, তাহলে আমি আবেদনই করতাম না। এরা (কমিটি) যে এত নারী বিদ্বেষী, জানা ছিল না আমার। জেন্ডার ইস্যুতে এ বিদ্যালয়ে কী পড়ানো হয়, সরকারের উচিত তা খতিয়ে দেখা।’
জানা গেছে, শাম্মী জামাল মুন্নির বাবা মৃত জামালউদ্দিন ১৯৯৯ সালে আলহাজ আমির উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের সহসভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাবা মারা যাওয়ার পর মুন্নির পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে চার ভাই পৃথক হয়ে যান। ছোট এক ভাই, এক বোন ও মাকে নিয়ে মুন্নিদের সংসার আর্থিক অনটনের মধ্য দিয়ে চলছিল। মুন্নি স্থানীয় একটি কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করেন। এ থেকে পাওয়া সম্মানী দিয়েই কোনো রকমে চলছে তাঁদের জীবন।
মুন্নি অভিযোগ করেন, নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফলের পরপরই বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি তাঁকে জানান, অফিস সহকারী পদে অনেক সময় দিনরাত বিদ্যালয়ে থেকে কাজ করতে হয়। মাঝেমধ্যে ঢাকায় দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। কাজেই এ কাজ তাঁকে (মুন্নি) দিয়ে হবে না। এ কারণে কমিটি একজন পুরুষ অফিস সহকারী খুঁজছে।
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুছ ছামাদ জানান, তদন্তে নিয়োগ পরীক্ষায় মুন্নির প্রথম হওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কালক্ষেপণ বা নিয়োগ বাতিল অনিয়মের পর্যায়ে পড়ে। জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, ‘সরকার চাচ্ছে মেয়েরা এগিয়ে আসুক। অথচ মেয়ে বলে তাঁকে (মুন্নি) চাকরি দেওয়া হচ্ছে না। এটা দুঃখজনক।’
বিদ্যালয়ের সভাপতি আব্দুল হাশিম বলেন, ‘এ নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন। কিন্তু ওই মেয়ে প্রথম হলেও তাকে আমরা নিতে পারব না।’ কমিটির পছন্দের বিশেষ কোনো প্রার্থী আছে কি না, জিজ্ঞেস করলে নীরব থাকেন সভাপতি।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হুমায়ুন কবির বলেন, ‘এ পদে আরো যোগ্য একজন প্রার্থী আমাদের প্রয়োজন।’ জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার নির্দেশনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি কমিটির এখতিয়ার। কমিটির সিদ্ধান্তই এ ক্ষেত্রে চূড়ান্ত।