বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত মানুষ হিসেবে বর্ণনা করা হয় তাদের। দেশে প্রত্যাখ্যাত এবং প্রতিবেশিদের কাছে অবাঞ্ছিত, কার্যত রাষ্ট্রহীন; কয়েক দশক ধরে মিয়ানমার থেকে পালাচ্ছে।
সম্প্রতি মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে বিদ্রোহীদের দমনে দেশটির সেনাবাহিনীর ব্যাপক অভিযানে ১০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়েছে। তারা ধর্ষণ, হত্যা ও বাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার মত ভয়াবহ তথ্য জানাচ্ছে; যা মিয়ানমার সরকার মিথ্যা এবং বিকৃত তথ্য বলে দাবি করেছে।
দৃঢ় আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া দেখা না যাওয়ায় মানবাধিকার কর্মীরা নিন্দা জানিয়েছেন। অনেকেই ১৯৯৫ সালে বসনিয়া গণহত্যার সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাখাইনের পরিস্থিতিকে তুলনা করেছেন। জাতিসংঘের সুরক্ষা পাওয়ার কথাপ থাকলেও সে সময় বসনিয়ায় ৮ হাজার মুসলিমকে হত্যা করা হয়; ইউরোপের মানবাধিকারের রেকর্ডে যা একটি কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
কী ঘটছে?
যুক্তরাজ্যভিত্তিক মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের সংগঠন বার্মিজ রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশনের কর্মকর্তা তুন খিন বলেন, রাখাইন প্রদেশের উত্তরাঞ্চলের নিরাপত্তা বাহিনীর গণ নৃশংসতার শিকার হচ্ছেন রোহিঙ্গারা। গত অক্টোবরে মংডুতে নিরাপত্তা বাহিনীর চেকপোস্টে বিদ্রোহীদের হামলায় ৯ পুলিশ সদস্যের প্রাণহানির পর অভিযান শুরু করে দেশটির সেনাবাহিনী। কিন্তু রোহিঙ্গারা বলছেন, বাছ-বিচারহীনভাবে তারা লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হচ্ছেন।
রাখাইনে কড়া প্রশাসনিক ব্যবস্থার কারণে সাংবাদিকরা প্রবেশ করতে পারেন না। এসব অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে অবরুদ্ধ রাখাইনে প্রবেশ করতে পারেনি বিবিসি।
এদিকে, জাতিসংঘের কর্মকর্তারা বলছেন, বিদ্রোহী হামলার জন্য রোহিঙ্গারা সামষ্টিকভাবে শাস্তি পাচ্ছেন; যার চরম লক্ষ্য হচ্ছে, জাতিগতভাবে তাদের নিধন করা।
এই পরিস্থিতি কেন?
মিয়ানমারের অনেক সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর একটি হচ্ছে রোহিঙ্গারা। কয়েক প্রজন্ম ধরে বসবাসকারী এই রোহিঙ্গাদেরকে আরবীয় ব্যবসায়ীদের বংশধর বলা হয়। মিয়ানমার সরকার নাগরিকত্ব দেয়নি এবং তাদেরকে বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসী হিসেবে মনে করে; এটি অনেক বার্মিজের সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি।
বৌদ্ধ প্রধান দেশটিতে সাম্প্রদায়িক অবিশ্বাসের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, কয়েক দশকের সেনা শাসনের সময় দেশটিতে অল্প কিছু সুযোগ সুবিধা পেতেন রোহিঙ্গারা। প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম পশ্চিমাঞ্চলের রাখাইনে বসবাস করে; এখানে সংখ্যালঘুদের বড় একটি অংশের বসবাস।
২০১২ সালে ছড়িয়ে পড়া সহিংসতায় এক লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়ে। হাজার হাজার রোহিঙ্গা জনাকীর্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে; যেখানে তাদের স্বাধীনভাবে চলাফেরায় বিধি-নিষেধ রয়েছে। নথিভুক্ত নয় এমম কয়েক লাখ রোহিঙ্গা ইতোমধ্যে বাংলাদেশে বসবাস করছে। কয়েক দশক আগে তারা পালিয়ে এসেছে বাংলাদেশে।
অং সান সু চি কোথায়?
রোহিঙ্গাদের নাটকীয় দেশ ত্যাগের মধ্যে গত বছরে ঐতিহাসিক নির্বাচনে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ও গণতন্ত্রের প্রতীক অং সান সু চির দল দেশটির ক্ষমতায় যায়। গত ২৫ বছরের মধ্যে দেশটিতে প্রথমবারের মত গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। এর পরে রোহিঙ্গাদের ভাগ্যের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সাম্প্রতিক সহিংসতায় ব্যর্থ সু চির বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় উঠেছে।
গত শুক্রবার সিঙ্গাপুরে চ্যানেল নিউজ এশিয়াকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সু চি বলেন, আমি বলছি না, সেখানে কোনো সমস্যা নেই।
রোহিঙ্গা নেতা তুন খিন বলেন, রোহিঙ্গাদের বাঁচাতে তার ব্যর্থতা অত্যন্ত হতাশাজনক। সেনাবাহিনীর ক্ষমতার কাছে তিনি বাঁধা পড়েছেন কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। দেশটির বেশ কয়েকটি প্রভাবশালী মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব রয়েছে সেনাবাহিনীর হাতে। সেনাবাহিনীর এই নির্যাতন ঢেকে রাখছেন সু চি।
এদিকে, অন্যরা বলছেন, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম রাখাইন সমস্যা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে; যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধরাও বসবাস করছে।
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির মিয়ানমার বিষয়ক গবেষক খিন মার মার কি সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টকে বলেন, মিয়ানমারের সবচেয়ে প্রান্তিক সংখ্যালঘু হচ্ছে রাখাইন, কিন্তু পশ্চিমা গণমাধ্যমে উপেক্ষিত।
সম্প্রতি সু চি বলেন, রাখাইনে বৌদ্ধদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় তারা চিন্তিত। তিনি দুই সম্প্রদায়ের মাঝে সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করার কথা বলেন। রাখাইনে সহিংসতার ঘটনায় সু চি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করলেও এর বিশ্বাসযোগ্যতা ও নিরপেক্ষ অনুসন্ধান নিয়ে অনেকের প্রশ্ন রয়েছে। রোহিঙ্গা নেতা তুন খিন বলেন, প্রত্যেকদিন মানুষ মরছে এবং সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে।
প্রতিবেশিরা কী সহায়তা করবে?
অভ্যন্তরীন বিষয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো সাধারণত পরস্পরের সমালোচনা করে না। এটি হচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জাতিগোষ্ঠীর ১০ সদস্যের সংগঠন আসিয়ানের একটি মূলনীতি। কিন্তু সম্প্রতি প্রতিবেশি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কয়েকটি দেশ মিয়ানমারের কঠোর সমালোচনার পাশাপাশি প্রতিবাদ জানিয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার পুলিশ বলছে, সেদেশে মিয়ানমার দূতাবাসে আইএস সমর্থকদের বোমা হামলার পরিকল্পনা নস্যাৎ করা হয়েছে।
নীরব ভূমিকা পালন করায় রোববার মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক সু চির শান্তি পুরস্কার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন, গণহত্যা দেখে বসে থাকতে পারে না বিশ্ব। বিশ্ব বলছে, এটি তাদের সমস্যা নয়। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নিপীড়নের প্রতিবাদে এক সমাবেশে নাজিব বলেন, এটি আমাদের সমস্যা। সু চি এই ইস্যুতে মালয়েশিয়ার সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, এই সমস্যা সমাধানে একটি আঞ্চলিক বৈঠক জরুরি হয়ে পড়েছে। উত্তরাঞ্চলের রাখাইনের পরিস্থিতি সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে আসিয়ানে তলব করা উচিত বলে সংস্থাটির একজন কর্মকর্তা মন্তব্য করেছেন।
ব্রিটেনে নিযুক্ত ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রদূত রিজাল সুকমা বিবিসিকে বলেছেন, একটি সমন্বিত পদক্ষেপের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
কী করছে জাতিসংঘ?
২০০৯ সালে জাতিসংঘের এক মুখপাত্র বলেন, সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে বন্ধুবিহীন জাতি মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমরা। চলতি সপ্তাহে সংস্থাটির মানবাধিকার বিষয়ক কার্যালয় বলছে, রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন মানবতাবিরোধী অপরাধের শামিল। সাম্প্রতিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি। একই সঙ্গে রাখাইনে মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর অনুমতি দিতে দেশটির সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর বলছে, মিয়ানমারের প্রতিবেশি দেশগুলোর সীমান্ত খুলে দেয়া উচিত। সংস্থাটির মুখপাত্র ভিভিয়ান ট্যান বলেছেন, একটি আঞ্চলিক টার্স্ক ফোর্স গঠনের এখনই উপযুক্ত সময়। যাতে এ ধরনের যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়া যায়।