আপনি যদি বাংলাদেশের মানুষকে জিজ্ঞাসা করেন রোজা কী অথবা রোজা শব্দের অর্থ কী, তাহলে তারা প্রথমে ভারী আশ্চর্য হয়ে আপনার দিকে তাকাবে এবং বলবে এটা কি কোনো প্রশ্ন হলো! জন্মের পর থেকে রোজার সঙ্গে এ দেশের মানুষ নানাভাবে পরিচিত। কেউ কেউ সারা বছর রোজা রাখেন, কেউ বা রাখেন সপ্তাহের সোমবার অথবা বৃহস্পতিবার। অনেকে আবার আরবি মাসের ১৩ ও ১৪ তারিখ নিয়মিত রোজা রাখেন। তারা বলেন, বাবা আদম (আ.) ক্ষমাপ্রাপ্ত হওয়ার পর ওই তারিখে রোজা রেখে বেহেশতি সুরত ফিরে পেয়েছিলেন। কাজেই বনি আদম হিসেবে আমরাও প্রতি মাসে আমাদের আদি পিতার মতো রোজা রাখব এবং দুনিয়ায় বসে জান্নাতি চেহারার অধিকারী হব। সারা বছর বিভিন্ন অসিলায় নফল রোজার পর মুসলমানরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন মাহে রমাদান অর্থাৎ রমজান মাসের ফরজ রোজার জন্য। কাজেই সেই রোজার মানে নিয়ে প্রশ্ন করলে লোকজন একটু-আধটু রাগ করতেই পারে। আপনি ওসব রাগে কিন্তু একদম কান দেবেন না বরং রোজা সম্পর্কে নিজে যা জানেন তা সাধারণ মানুষকে বুঝিয়ে বলুন- এতে দুনিয়া ও আখিরাত- উভয়ের কল্যাণ আশা করতে পারেন ইনশা আল্লাহ।
আলেমরা বলেন, সওম মানুষকে খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত তর্কবিতর্কে না গিয়ে আমরা সওমের মৌসুম অর্থাৎ মাহে রমজান সম্পর্কে কিছু বলার চেষ্টা করি-
রোজার মাসকে আমরা সাধারণত রমজান বলি। আরবিতে এর বিশুদ্ধ উচ্চারণ হলো- রমাদান। হিজরি বর্ষপঞ্জিতে এটি নবম মাস। ইসলামের পাঁচটি মৌলিক ভিত্তির অন্যতম রোজা বা সওমের নির্দেশ আল্লাহ এই মাসে পালন করার কথা বলেছেন। পবিত্র কোরআনে সুরা বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘রমজান হলো সেই মাস যখন কোরআন নাজিল করা হয়েছে যা মানুষের জন্য হেদায়েত ও সত্য পথযাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথনির্দেশ এবং ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে সে এ মাসের রোজা রাখবে। আর যে লোক অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে, সে অন্য দিনে গণনা পূর্ণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান। তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেন না। যাতে তোমরা গণনা পূর্ণ কর এবং তোমাদের হেদায়েত দান করার দরুন আল্লাহর মহত্ত্ব বর্ণনা কর, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর।’
রোজার প্রসঙ্গ এলেই আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে জাকাত এবং সদকার কথা। আমাদের মনে পড়ে যায় তারাবি এবং শবেকদরের কথা। ঈদুল ফিতর ও ঈদের জামাতের আগে নতুন জামাকাপড় কেনার ধুমের কথা নতুন করে বলার দরকার নেই। সেহরি এবং ইফতার সম্পর্কেও আমরা মোটামুটি জানি। বেশি বেশি নফল নামাজ, দরুদ পাঠ, কোরআন তিলাওয়াত এবং দ্বন্দ্ব-ফাসাদে না জড়ানোর পরামর্শও শুনে আসছি ছোটবেলা থেকে। তার পরও যদি কেউ প্রশ্ন করেন, কেন রোজা রাখব? সে ক্ষেত্রে আপনি বলতে পারেন- মানুষ হিসেবে রোজা পালনে আমরা পেতে পারি সুবিশাল দৈহিক এবং মানসিক উপকার। রোজার রয়েছে শরিয়তি এবং মারফতি কুদরত। রয়েছে জমিনি এবং আসমানি ফায়দা। এর বাইরে দুনিয়া ও আখিরাতের মহাকল্যাণ তো আছেই। ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের বাইরে জাগতিক ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্পকলা, রাজনীতি, সামাজিকতা এবং পারিবারিক কল্যাণও নিহিত রয়েছে রোজার মধ্যে। এতসব বলতে গেলে বিরাট এক মহাকাব্য রচিত হয়ে যাবে। রোজার উপকারগুলো একদিকে যেমন সাধারণ দিব্যদৃষ্টিতে ধরা পড়ে তেমনি বান্দা যদি মহব্বতের দৃষ্টি নিয়ে তার মালিকের সৃষ্টিকুলের দিকে তাকায় তবে সর্বত্র রোজার ফায়দাগুলো দেখতে পাবে। এ ব্যাপার আলোচনায় যাওয়ার আগে সংক্ষেপে বলে নেওয়া ভালো যে আধুনিক বিজ্ঞানও কিন্তু রোজা সম্পর্কে তাদের সাম্প্রতিক গবেষণা প্রকাশ করেছে। বিজ্ঞান বলছে- রোজার কল্যাণে মানুষের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ; ভয়, বিপদ কিংবা প্রেম-ভালোবাসায় অতি দ্রুত সাড়া দেওয়ার অসাধারণ গুণাবলি মানুষের মস্তিষ্ক লাভ করে থাকে রোজার মাধ্যমে। রোজা অবস্থায় মানুষের মস্তিষ্কের কোষগুলো বাড়তে থাকে। ফলে চিন্তার বিশালতা এবং চিন্তা করার সক্ষমতা লাভ হয়। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমতে থাকে এবং ক্ষতিকর এলডিএল কোলেস্টেরল কমে যায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে। অন্যদিকে এইচডিএল কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায়। শরীরের অভ্যন্তরে জমাটবাঁধা চর্বি ঝরে যায়। ফলে একদিকে যেমন ওজন কমে অন্যদিকে দেহের পেশিগুলোর কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। কোমর সুগঠিত হয়, শরীরে ভারসাম্য চলে আসে এবং রক্তে সুগার বা শর্করার পরিমাণ কমে যায়। ফলে ডায়াবেটিস, ব্লাডপ্রেসার নিয়ন্ত্রণে থাকে। সবচেয়ে উপকারী বিষয় হলো- রোজার সময় শরীরের যাবতীয় বিষাক্ত পদার্থ বের হয়ে যায় অতি সহজে।
বিজ্ঞান ছেড়ে এবার আমরা সামাজিক জীবনে ফিরে আসি। রমজান মাসে সমাজে অপরাধ বহুলাংশে কমে যায়। বৃদ্ধি পায় সামাজিক সম্প্রীতি। একে অন্যকে সহযোগিতা, উপহার প্রদান এবং একসঙ্গে ইফতার করার কারণে সামাজিক, পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত সম্পর্কের চমৎকার উন্নতি হয়। নিয়মিত দোয়া দরুদ এবং নামাজ কালামের বাইরে তারাবির নামাজ ও কোরআন তিলাওয়াত মানুষকে ভাবজগতের ঊর্ধ্বস্তরে নিয়ে যায়। মানুষ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে অভ্যস্ত হয়, ধৈর্য ধারণ করতে শিখে এবং নিজেকে নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ করে সুশৃঙ্খলা হতে অনুপ্রেরণা লাভ করে। রোজার কারণে মানুষ অন্য সময়ের তুলনায় নীরব এবং একাকী থাকার সুযোগ লাভ করে এবং নিজেকে নিয়ে ভাবার সময় পেয়ে যায়। রোজা মানুষকে মিতব্যয়ী হতে শিক্ষা দেয় এবং অন্যের মর্মবেদনা অনুভব করার সুযোগ সৃষ্টি করে।
দুনিয়ার জমিন ছেড়ে আমরা যদি আসমান, নক্ষত্রমণ্ডলী এবং আরশে আজিমের কথা চিন্তা করি তবে দেখতে পাব সেখানেও রয়েছে রোজাদারের জন্য অপরিমিত সুসংবাদ। এই সময় শয়তানকে বন্দী করে রাখা হয়। আসমানি ফেরেশতারা রোজাদারদের জন্য দোয়া করতে থাকেন। অন্যদিকে সাতটি আসমানের সব রহমত ও বরকতের দরজা রোজাদারদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। মহাজাগতিক বালামুসিবত, উল্কাপিণ্ডের আক্রমণ, বজ্রপাত, ক্ষতিকর রশ্মিসমূহ, শনিসহ অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহ এবং নক্ষত্রের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে জমিনের রোজাদাররা মুক্ত থাকেন। শবেকদরের অসিলায় মানুষ গুনা মাফ, অধিক রিজিকপ্রাপ্তি এবং জান্নাতের পথে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ লাভ করে। দুনিয়ার অর্থাৎ ইহলৌকিক কল্যাণ ছাড়াও পারলৌকিক জীবনে রোজাদারদের জন্য রয়েছে বিশেষ সম্মান, প্রাপ্তি এবং পুরস্কার। জান্নাতে ঢোকার জন্য রাইয়ান নামের একটি সম্মানিত দরজা থাকবে যেখান দিয়ে কেবল রোজাদাররাই প্রবেশ করতে পারবেন। রোজাদারদের পুরস্কার এবং প্রতিদান বেশুমার। আল্লাহ বলেন, রোজা আমার জন্য সুতরাং রোজাদারদের আমি নিজের মতো পুরস্কৃত করব। আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য এত বড় সুসংবাদ অন্য কোনো এবাদত-বন্দেগি কিংবা সুকর্মের জন্য ঘোষিত হয়নি। রমজানকে বলা হয় আল্লাহর মেহমান, অন্যদিকে আল্লাহর মেহমানকে তাজিমকারীরা সরাসরি আল্লাহর জিম্মায় চলে যাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন।
আমি যে সময়টার কথা বলব তা ছিল মনসুর হাল্লাজের জেলে যাওয়ার কিছুকাল আগের ঘটনা। রোজার মাস। কিন্তু মনসুর হাল্লাজ রোজা রাখেন না। রাস্তায় পাগলামো করেন এবং উল্টাপাল্টা কথা বলেন। নগরবাসী মনসুরকে বলল, এই পাগল তুমি রোজা রাখ না কেন? মনসুর বললেন, কাল রাখব। তোমরা আমাকে সেহরির সময় খাওয়ার জন্য একটি বাতাসা দাও। উৎসুক জনতা তাই-ই করল। মনসুর সেহরির সময় মসজিদের সামনে চলে গেলেন। তারপর পূর্বমুখী হয়ে এক পায়ের ওপর দাঁড়ালেন। এক হাত দিয়ে অন্য পা-টি পেছন দিক থেকে টেনে ধরলেন অনেকটা মোরগযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার ভঙ্গিমায়। এরপর জিহ্বা বের করে জিহ্বার অগ্রভাগে বাতাসাটি রাখলেন।
শহরে খবর হয়ে গেল মনসুর হাল্লাজ রোজা নিয়ে পাগলামো করছেন। শত শত উৎসুক দর্শক দেখার জন্য মসজিদের সামনে এলো। জিহ্বার অগ্রভাগে বাতাসা রেখে মনসুর এক পায়ে দাঁড়িয়ে জিহ্বা বের করে সূর্যের দিকে তাকিয়ে রইলেন। সূর্য পূর্ব দিগন্ত থেকে মাথার ওপর উঠল, তারপর পশ্চিম দিগন্তে হেলে পড়ল। মনসুর তার চোখ সূর্যের দিকে নিবদ্ধ রাখলেন সারাটি দিন, বের করা জিহ্বার অগ্রভাগে বাতাসা রেখে এক পায়ে দাঁড়িয়ে সূর্যের সঙ্গে তাল রেখে মাথা শরীর ও চোখ পূর্ব থেকে পশ্চিমে ঘোরালেন। তারপর সূর্য অস্ত গেলে জিহ্বার অগ্রভাগ থেকে বাতাসাটি হাতে নিয়ে লোকজনকে দিয়ে বললেন, আজ আমি রোজা রেখেছি। লোকজন দেখল সারা দিনে বাতাসাটি একটুও ভেজেনি!
লেখক : কলামিস্ট