সর্বত্র মেয়েদের জন্য বিদ্যালয়ের দ্বার খুলে দাও

এ মুহূর্তে সারাবিশ্বে বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া মেয়েদের সংখ্যা ৬ কোটি ২০ লাখেরও বেশি। নিজেদের ভেতরে থাকা সম্ভাবনার বিকাশ ঘটানোর সুযোগ থেকে ওই মেয়েদের বঞ্চিত রাখার এক অবিচার এটি। প্রায়ই মেয়েরা বিদ্যালয়ে যেতে অনতিক্রম্য বাধার মুখোমুখি হয়। যেমন: সামর্থ্যরে বাইরে বিদ্যালয়ের বেতন, জবরদস্তিমূলক বাল্যবিয়ে ও গর্ভধারণ, ছেলেদের মতো মেয়েদের এত লেখাপড়া করা উচিত নয়Ñ এমন সামাজিক ধারণা ইত্যাদি।
যেসব মেয়ের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার পর বিয়ে হয় ও সন্তানের জন্ম হয়, তাদের মাতৃত্বকালীন ও সন্তান মৃত্যুর হার তুলনামূলকভাবে কম। তাদের শিশুদের এইচআইভি/এইডসে-আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও কম। এর অর্থ, নারী শিক্ষার বিষয়টি কেবল একটি নৈতিক ইস্যুই নয়। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্যবিষয়ক ইস্যু। সহিংস সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য আমাদের হাতে থাকা সেরা অস্ত্রটি হলো শিক্ষা। তাই এ ইস্যুটি জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গেও সম্পর্কিত। নারী শিক্ষার বিষয়টি একই সঙ্গে জরুরি অর্থনৈতিক ইস্যুও বটে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, একটি মেয়ের বিদ্যালয়ে অংশগ্রহণের বয়স অতিরিক্ত এক বছর বাড়ার অর্থ তার আয় করার সক্ষমতা ১০-২০ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়া। সুতরাং আরও বেশি মেয়েকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পাঠানোর মাধ্যমে একটি দেশের পুরো অর্থনীতিরই অগ্রগতি হতে পারে।
কিন্তু আমার কাছে বিষয়টি শুধুই নীতি বা অর্থনীতির ব্যাপার নয়। এটি একান্তই ব্যক্তিগত। কেননা, আমি এ ইস্যুটি নিয়ে একজন ফার্স্টলেডি হিসেবে লড়ছি না। লড়ছি একজন মা হিসেবে।
আমি যখন বিদেশ সফরে যাই, তখন আমি ওই মেয়েদের দেখি। প্রতিবারই আমি তাদের প্রচ- আবেগ, বুদ্ধিমত্তা ও জানার অপরিসীম আগ্রহ দেখে অভিভূত হই। আমি তাদের মধ্যে আমার নিজের মেয়েদের দেখতে পাই। আমার নিজের মেয়েদের মতো, ওই মেয়েদের প্রত্যেকের মধ্যেই অসাধারণ কিছুর স্ফুলিঙ্গ বিদ্যমান। কিন্তু একমাত্র পার্থক্য হচ্ছে, আমার মেয়েরা নিজেদের মধ্যকার লুকায়িত সম্ভাবনাগুলো বিকাশের সুযোগ পেয়েছে আর তারা পায়নি। তাই আমরা যারা পিতা-মাতা ও দাদা-দাদি, তাদের উচিত আত্মজিজ্ঞাসা করা যে, আমরা আমাদের নিজেদের মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়া মানতে পারবো কিনা। আমরা তাদের ১২ বছর বয়সে পূর্ণবয়স্ক এক পুরুষের সঙ্গে বিয়ে, ১৩ বছর বয়সে গর্ভবতী হতে দিতে পারবো কিনা। আমরা আমাদের মেয়েদের পরনির্ভরশীল, প্রকৃতপক্ষে ভয় ও নির্যাতনের এক জীবনে বন্দি করে রাখতে পারবো কিনা।
আমাদের নিজেদের বেলায় মেয়েদের এ ধরনের জীবন চিন্তাও করতে পারি না। তাহলে আমরা কেন এ গ্রহেরই অন্য কোন মেয়ের এ ভাগ্য বরণ করাটা মেনে নিচ্ছি? আমি এ সপ্তাহে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের সঙ্গে লন্ডনে সাক্ষাৎ করেছি এ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য। আমরা সাক্ষাৎ করেছি বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর কিশোরী মেয়েদের শিক্ষিত করতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বেশ কয়েকটি নতুন আংশীদারিত্বের ঘোষণা দিতে। বিশ্বব্যাপী কিশোরী মেয়েদের শিক্ষার পেছনে যুক্তরাজ্য বহু বছর ধরে বৈশ্বিক নেতৃত্ব দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রও বিনিয়োগ করেছে। এ বছরের শুরুর দিকে দেশটি লেট গার্লস লার্ন (মেয়েদের শিখতে দাও) নামের একটি কর্মসূচি শুরু করা হয়েছে। এ কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর বিভিন্ন সম্প্রদায়কে নিজেদের সমাধান নিজেরাই খুঁজে বের করতে ইউএস পিস কর্পসের স্বেচ্ছাসেবীদের প্রচেষ্টা।
আমাদের নতুন অংশীদারিত্ব এসব প্রচেষ্টার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এতে বিশ্বব্যাপী আরও বেশি কিশোরী মেয়েকে শিক্ষিত করার প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে। আমাদের অংশীদারিত্বের আওতায় আমরা কঙ্গোতে পাঁচ বছরে নারী শিক্ষার পেছনে ১৮ কোটি ডলার ব্যয় করবো। এর মাধ্যমে উপকৃত হবে সাড়ে ৭ লাখ মেয়ে।
পাশাপাশি আমাদের বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা ও শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয় একত্রে কিশোরী মেয়েদের শিক্ষিত করার সেরা উপায় খুঁজে বের করতে প্রমাণভিত্তিক গবেষণা চালাবে। বৃটিশ ও আমেরিকান অংশীদাররা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শিক্ষক প্রশিক্ষণ, মেয়ে নেতৃত্ববিষয়ক ক্যাম্প ও অন্যান্য সাম্প্রদায়ভিত্তিক প্রকল্পে সহায়তা দেবে। আমাদের সম্মিলিত লক্ষ্যমাত্রা ২০ কোটি ডলার। কিন্তু এ চ্যালেঞ্জে জয়ী হওয়ার সংকীর্ণ সুযোগ বিবেচনায় নিলে এ অর্থ কোনভাবেই পর্যাপ্ত নয়। মেয়েদের শিক্ষার বিষয়টি একটি বৈশ্বিক বিষয়। এজন্যই মার্চে আমি জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের স্ত্রী আকি আবের পাশে দাঁড়াতে দেশটি সফর করেছিলাম। বিশ্বব্যাপী মেয়েদের বিদ্যালয়ে অংশগ্রহণ করাতে আমরা একই ধরনের অংশীদারিত্বের ঘোষণা দিয়েছিলাম।
আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি ফার্স্টলেডি থাকাকালে ও তার পরের সময় এ প্রচেষ্টায় বিশ্বনেতাদের অংশগ্রহণ করানোর পেছনে ব্যয় করবো। কারণ, প্রতিটি মেয়েরই তার ভেতরে থাকা সম্ভাবনার বিকাশ ঘটানোর সুযোগ প্রাপ্য। সে কোথায় বসবাস করে, সেটি কোন বিবেচ্য বিষয় নয়।
——————————————————————————————————————
[মিশেল ওবামা যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার স্ত্রী, অর্থাৎ মার্কিন ফার্স্টলেডি। এ লেখাটি লন্ডনের ফিন্যান্সিয়াল টাইমসে প্রকাশিত তার নিবন্ধের অনুবাদ।]

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর