লম্বা সময় ধরে বেড়ে ওঠা আমাদের দেশে একটা রাজনীতি বিমুখ প্রজন্ম তৈরি হয়েছে। তারা রাজনীতিকে ঘৃণা করে, কথায় কথায় নেতাদের নাম ধরে গালি দেয়, ফেসবুকের প্রোফাইলে খুব গর্বের সাথে লিখে রাখে “আই হেট পলিটিকস”। সোহেল তাজ খুব সম্ভবত সেই প্রজন্মের সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণ।
২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে ভাগে সোহেল তাজকে সামনে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। কিছু মানুষকে দেখলে বুকে বল পাওয়া যায়, কিছু মানুষের আশে পাশে থাকলে ভরসা জাগে মনে। সোহেল তাজকে দেখে আমার মনে হয়েছিল এ মানুষটার উপর ভরসা করে দেশের দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে, এ ভরসা করার মতই মানুষ। আমি জানি, আমি একই নই, আমার মতই আরো অনেকের মাঝেই প্রায় একইরকম একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল সোহেল তাজকে নিয়ে।
খুব সম্ভবত সেবার আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যে কটা ব্যাতিক্রমী চেষ্টার দেখা পেয়েছিলাম, রাজনীতির সনাতন ধারার সেই থোড়বড়ি খাড়া থেকে বের হবার যে চেষ্টা দেখেছিলাম সে সময়, তার মধ্যে সোহেল তাজের মতন একজন তরুণ, নির্লোভ এবং সৎ রাজনীতিবিদকে সামনের সারিতে রেখে কেবিনেট বানানোর চেষ্টা ছিলো অন্যতম।
কিন্তু সোহেল তাজ অত্যন্ত যত্নের সাথে বার বার প্রমাণ করে দিয়েছেন আমরা কতটা ভুল ভেবেছিলাম। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হবার ৫ মাসের মাথায়, ২০১০ সালে মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দিয়ে দেন তিনি। আর ২০১২ তে সংসদ সদস্যের পদ থেকে সরে দাড়িয়ে সোহেল তাজ বুঝিয়ে দিয়েছেন আসলে তিনিও অন্যদের মতই, এসকেপিস্ট। সাম্প্রতিক সময়ে আবারও তার রাজনীতিতে ফিরে আসার সব জল্পনা কল্পনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বক্তব্য দিলেন সোহেল তাজ।
আসলে উনি বার বার চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের দেখিয়ে দিলেন দিন শেষে উনিও আসলে রাজনীতির ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে পালিয়ে যাওয়াদেরই একজন। বাকি সবার মতই তিনিও রাজনীতির নোংরা গর্তে নেমে তাকে সাফ করার মতন ইচ্ছা শক্তি রাখেন না। রাজনীতিকে গালি দিয়ে হাত মুছে সোহেল তাজ চলে গেলেন স্বেচ্ছা নির্বাসনে।
সোহেল তাজ তার বিদায়ী চিঠিতে লিখেছিলেন ‘২০০৮ সালের নির্বাচনে দলের যুগোপযোগী নির্বাচনী ইশতেহার আমাকে রাজনীতিতে আরও বেশি উৎসাহিত করে। যে ইশতেহারটি ছিল প্রগতিশীল ও দিনবদলের একটি ঐতিহাসিক অঙ্গীকার। আশাবাদী হই, একটি সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতির। যে সংস্কৃতির মাধ্যমে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। জনগণ পাবে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার। যুদ্ধাপরাধী, বঙ্গবন্ধু হত্যা, জাতীয় চার নেতা, উদীচী ও একুশে আগস্ট হত্যা, সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া ও আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যা এবং ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলাসহ সব হত্যার বিচার হবে। বাংলাদেশ হবে সন্ত্রাস ও জঙ্গিমুক্ত একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা—- সব মিলিয়ে একটি সুন্দর সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছিলাম।’
সোহেল তাজ, স্বপ্ন পূরণ হয়নি বলে আপনি লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে এভাবে পালালেন? স্বপ্ন পূরণ হয়নি বলে আপনি দেশ ছেড়ে চলে গেলেন? একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেনওনা, দেশটা কেমন থাকলো, কেমন থাকলো দেশের মানুষ? সোহেল তাজ, স্বপ্ন শুধু দেখলেই হয় না, সেটা পূরণ করার জন্য গোয়ারের মতন তার পেছনে লেগে থাকতে হয়। মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে হয়। ফেলে চলে গেলে, স্বপ্নরা ধুলোয় গড়াগড়ি খায়। পূরণ আর হয় না।
সোহেল তাজ, আমাদের পরম সৌভাগ্য আপনার আব্বা আপনার মতন চিন্তা করতেন না।
উনি ওরকম চিন্তা করলে খুব সম্ভবত ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হতো না।
আমাদের সৌভাগ্য তাজউদ্দীন আহমেদ স্বপ্ন দেখার পাশাপাশি সেটাকে সত্যি করতে একদল
অনভিজ্ঞ তরুন যোদ্ধাকে পাশে নিয়ে মুক্তির সংগ্রামে নয় মাস লড়ে গেছিলেন।
তিনি হার মানেননি, তিনি দেশ স্বাধীন করে দেশের মাটিতে ফিরে এসছিলেন।
দূর থেকে দেশকে ভালোবাসি বলে চুপ চাপ বসে থাকেননি।
থাকলে খুব বিপদ ছিল আমাদের।
লেখক: জনসংযোগ বিশেষজ্ঞ