পৃথিবীর সব দেশেই কম বেশি নানা বিধ আচার প্রথা স্মরনাতীত কাল থেকেই চলে আসছে। রয়েছে বহু বিচিত্র বোধ,বিশ্বাস।সংস্কার-কুসংস্কার দৈনন্দিনতায় এমন ভাবেই শেকড় বাকরে ছড়িয়ে জড়িয়ে আছে যে, সেসব একেবারে লঙ্ঘন বা এড়িয়ে যাওয়া সকল ক্ষেত্রে অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়।হয়তোবা সে সবের রয়েছে কোন-আপাত স্বস্তি পরশ কিংবা নিছক বিশ্বাস। প্রচলিত সেসব লোকাচারের অনেকগুলির ব্যাপারে বৈজ্ঞানিকি ভিত্তি কিংবা নিছক বিশ্বাস।
প্রচলিত সেসব লোকাচারের অনেক গুলোর ব্যাপারে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি কিংবা যৌক্তিকতা খুঁজতে যাওয়া অনেক ক্ষেত্রে ভস্মে ঘি ঢালার মতই বেকার। কারণ লোকে তা বিশ্বাস করে, শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে। শুধু যে বিশ্বাস করে তাই নয়, সেগুলোর কোনও কোনটার যে বৈজ্ঞানিক বা যৌক্তিক ব্যাখ্যা একেবারেই নেই, তা কি একদম হলফ করে বলা যায়? কোন কোন ক্ষেত্রে যায় আর যায় না সেগুলো পর্যায়ক্রমে খুঁজে দেখার চেষ্টা করা হবে।
লোকজ ঐতিহ্য, প্রথা আচার, পার্বিকতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এক অন্যন্য দেশ। এসব বিষয় নানামাত্রিক বোধ, বিশ্বাস ধর্ম, প্রার্থনা, পরিবার সমাজ, চাষবাস, রোগ ব্যাধির নিরাময়ে, জুটী বন্ধন, সৎকার, প্রকৃতি, আবাহাওয়া প্রায় সকল বিষয়ে সুবিস্তৃত। লোকায়িত বাংলার এসব লোকাচার চলে আসছে হাজার হাজার বছর ধরে। প্রকৃতির স্নেহ সান্নিদ্ধে অথবা বৈরিতায় মানুষ যখন নানা মিশ্র-সংকটে জীবন নির্বাহ করছে সম্ভবত তখন থেকেই মানুষ মমত্ত্বের আশ্রয় খুঁজেছে, নানা লৌকিক –অথবা স্ব-সৃষ্ট নানা কল্প অস্বত্বিতের কাছে।
অযুত কাল পূর্ব লৌকিক বাংলার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ছোট্ট একটি মানচিত্র, কিশোরগঞ্জের দৃশ্যপটে সামগ্রিক লোকাচারের বহুবিধ বৈচিত্রিক প্রথাবদ্ধতা এখনো পরি-দৃশ্যমান। যদিও উন্নতত্র জীবনযাপনের সহজতর হাতছানি, রঙিন আধুনিকতার অপ্রতিরোধ্য গতিবেগ, নবায়িত শিক্ষার প্রায়োগিক আলোক, যুক্তিবুদ্ধির সুক্ষ্মতর বিশ্লেষনী যোগ্যতার বিকাশ। সেসব-লোকজ কর্মকান্ডের অনেকাংকাশেই বিলুপ্ত বা বিলুপ্তপ্রায়।
তদুপরি তার যেসব অবশিষ্ট রয়েছে সেগুলি নিয়ে খানিক আলোকপাত করা যেতে পারে।পারে এজন্য যে,ঐতিহ্যের ইতিহাস বিনির্মাণে আমাদের বিবর্তন, বিকাশের ক্রমধারা জানতে পারবে, আমাদের প্রিয় প্রজন্ম। জানবে শেকরের সততা আগামীর মৃত্তিকায়। অবশ্য-প্রয়োজন-অপ্রয়োজন নির্ধারণ করার পূর্ণ স্বাধীনতা তাদের নিজস্ব। অগ্রজ সমাজের বোধ বিশ্বাস উত্তর প্রজন্ম কতটুকু গ্রহন বর্জন করবে সেটা নির্ধারিত হবে আগামীর সমাজ পটে।
ছোট্ট একটি জেলা আমাদের এই কিশোরগঞ্জ। বাংলাদেশের মৃত্তিকার অবিছেদ্দ্য অংশ হিসেবে এরও রয়েছে নিখিল বঙ্গজ ঐতিহ্যিক বহু বিচিত্র লোকজপ্রথা। সে গুলোর কোনও কোনটার সাথে যেমন অন্যান্য অঞ্চলের রয়েছে প্রচুর মিল, তেমনি অনেক গুলোর রয়েছে একান্তই নিজস্বতা এবং স্বাতন্ত্রিক বৈশিষ্ট্য। সূদুর অতীতকাল থেকেই এই জেলার রয়েছে-সাহিত্য সংস্কৃতির অতি উদ্ভাসিত প্রোজ্জ্বল ধারাবাহিকতা, যা জাতীয় পরিচয় নির্ধারণে বিপুল ভূমিকা রেখেছে। তার সিংভাগই লোকজ-কথা, গাঁথা প্রথা নির্ভর।
কিশোরগঞ্জের নিরক্ষর বা নিরক্ষর প্রায় প্রাকৃতজ মানুষজন কৃষক, দিন মজুর, গাতক(গায়ক), জারি সারিওয়ালা, মাঝিমাল্লা গ্রামীন বুড়োবুড়ি, কর্মক্লান্ত-ঘর্মক্লান্ত গৃহবধূ কৃষানী কন্যাদের নিয়ে যে জীবন ধারা চলে আসছে আবহমান কাল ধরে তাদের মুখে মুখে, আচার আনুষ্ঠানিকতার ভিতর দিয়েই পরিচয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে অদ্যাবধি। সেসব ভালো কি মন্দ, যৌক্তিক বা অযৌক্তিক তা কি অনগ্রসরতা বা পশ্চাদপদতা-এসব প্রশ্নের জবাব খোঁজার প্রয়োজনীয়তা এখনকার ব্রাত্যজনদের কাচ্ছে একান্তই গৌণ।তারা তাদের দাদা-পরদাদাদের দেখে বংশ পরস্পরায় সেসব দেখে দেখে, শিখে শিখে অভ্যস্ত হয়েছে। সেগুলা তাদের সুখ দঃখের সাথী, আনন্দ বেদনার সহযাত্রী হয়ে রয়েছে।কালের ধোপে টিকে থাকতে না পেরে সেগুলোর অনেকগুলো গতায়ুও হয়েছে।বাকি গুলো ভবিষ্যতে থাকবে কিনা বলা কঠিন।
গৃহস্থালী, সমাজ প্রথা য় জ্বীন ভূতে বিশ্বাসঃ
কিশোরগঞ্জের সমকালীন সমাজ পটে যেসব ঐতিহ্যিক প্রথা টিকে আছে তার মধ্যে কতগুলো পারিবারিক প্রথ লক্ষ্য করা যায়।সেগুলোর মাঝে অন্যতম,সন্তান ভুমিষ্ট হবার পর বাশেঁর ‘নেইল’ (কাঁচা বাশেঁর গাঁ থেকে কেটে আনা ধারালো বাকল)দিয়ে সদ্যজাত শিশুর নার কাটা হয়।কিশোর গঞ্জের আঞ্চলিক ভাষায় আঁতুর ঘর কে বলা হয় ‘ছডিঘর’এই ছডিঘরকে-নানাবিধ আপদ বিপদ থেকে সুরক্ষিত রাখার জন্য সেই ঘরের দরজার মুখে সর্ষে ধূপ দিয়ে ‘চোঁহল’(তুষ)জ্বালিয়ে রাখা হয়।দরজার উপরে দু-একটা নিমের ডাল গঁজে রাখা হয়।
নবজাতকের উপরে যাতে বদ প্রকৃতির জ্বীন ভূতের আছর পরতে না পারে সে জন্য ছডিঘরের চৌকাঠের উপরে বা তরজার বেড়ার খাপে চামড়ার ছেঁড়া জুতো, গরুর হাড্ডি, ছেঁড়া জাল প্রভৃতি টাঙিয়ে রাখা হয়।যখন তখন যাকে তাঁকে আঁতুর ঘরে ঢুকতে দেয়া হয়না, এতে শিশুর অমঙ্গল হয়।এমনকি জন্মদাতা বাবাকেও ক্ষেত খামার থেকে চাষবাস করে এলে তৎক্ষনাৎ তাঁকে সে ঘরে ঢুকতে দেয়া হয় না। প্রথমে ভালো করে হাত মুখ ধুয়ে নিতে হয়।
তারপর পাটশোলার আগুনে হালকা সেঁকে নিতে হয়, মাছ শুঁটকি দিয়ে ভাত খেলেও একি সাবধানতা অবলম্বন করা হয়।ভূঁত প্রেতের হাত থেকে রক্ষা পেতে শিশুর গলায় চউক্কা গোটা, কাইতান দিয়ে বেঁধে রাখা হয়।কোমরে বাঁজুতে থাকে কোন পীর ফকির বা মাজারের খাদেমের অথবা বড় হুজুরের দেওয়া তাবিজ বা মাদুলি।সেগুলি নির্দিষ্ট স্থানে বেধে রাখা হয় তাগা বা বাইট্টা দিয়ে।
অনেক সময় মায়ের গর্ভকালীন অপুষ্টি বা অযত্নের কারণে প্রসূত সন্তানও অপুষ্টির স্বীকার হয়। তার শারীরিক জটিলতার কারনে অনেক সময় তার খিঁচুনী হয়। শিশু কাঁদে চিৎকার করে।কান্নার চোটে শিশুর পাতলা ফর্সা ত্বকে সাময়িক ভাবে রক্তের রেষ দেখা যায় কিংবা রক্ত জমে যাওয়ার মতন দেখায়। শিশুর এই অবস্থাকে গ্রামের মহিলারা লাল নীল হয়ে যাওয়া বলে ব্যাখ্যা করে। এ ধরনের অসুস্থতস্কে অনেকে বাঁহড়া বলে। এ পরিস্থিতি থেকে তারা শিশুটিকে বাঁচাতে ঝাঁড়পুক, পানি পড়া খাওয়ায়। গলায়, কোমরে বাজুতে নানা রঙ বেরঙের তাবিজ বা মাদুলি ঝুলায়। এসব টোটকা ফাটকায় শিশু আদৌ ভাল হয় কিনা আল্লাহ মালুম। তবে শিশুর যে বারোটা বাজে তার কোণ সন্দেহ নেই। অবশ্য আজকাল সরকারের ইপিআই প্রোগ্রামের (ছয়টি বিশেষ রোগের টীকা দান কর্মসূচি)বদৌলতে ‘বাঁহড়া দেব’ যে একপ্রকার পালিয়েছে এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই।
এই নবজাত শিশু যখন কিছুটা বড় হয়, হামাগুড়ি দিতে শুরু করে তখনো এসব ধম্বন্তরীর আকাল পড়েনা। শারিরিক দূর্বলতা বা অন্য কোণ দূর্বলতার কারণে শিশুর হাঁটার উপযুক্ত সময়েও হাঁটতে অসমর্থ হলে ‘হাতুসা’ বা ‘গড়গইড়্যা’ দেওয়া হয়।গড়গইড়্যা মানে আল্লোয়া চাল(আতপচাল) দিয়ে ‘গুলিপিঠা’(চালের গুঁড়া দিয়ে পানির বাষ্পে সিঁধিয়ে বানানো একপ্রকার পিঠা) বানিয়ে টিনের চালে ছুঁড়ে মারা হয়।সেই পিঠা গড়োগড়িয়ে মাটিতে পড়লে –পাড়া প্রতিবেশির ছোট ছোত ছেলেমেয়েরা সেসব ধরে খেতে হুড়োহূড়ি লুটোপুটি খেয়ে লেগে যায়। এ ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে শিশু নাকি হাঁটতে শিখে। হন্টন সার্মথ অর্জিত হোক বা না হোক এ ধরনের লোক বিশ্বাস, আচার এখনো এ এলাকায় অনেকাংশে বিদ্যমান।
এই অঞ্চলে তুমুল বিস্বাস ছিল-বড় বড় গাব গাছ, শিমুল গাছ, বট গাছ, শ্যাওড়া গাছে নাকি যতসব খবীস্ জ্বীন ভূতের বাস।জ্ঞাতে অজ্ঞাতে তাদের এই সব আস্তানায় কোনরুপ অমর্যাদা করলে অপরাধী ব্যাক্তিকে ভয়ানক শাস্তি দেয়, এমনকি ঘাঁড় মটতে মেরে ফেলা পর্যন্ত।এসব বিশ্বাসী লোকদের বিশ্বাস জ্বীন পরী অদৃশ্য থাকে, এদের দেখা যায়না।
লোকে এসব বিষয় যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে বিচার বিবেচনা করতে খুব বেশি আগ্রহী নয়। কে যায় জ্বীন ভূঁতের বিপাদপদ দাওয়াত দিয়ে আনতে।কেউ যদি ভুলে বা বেশি সাহসের বাহাদুরি ফলাতে যায় বা কোন জরুরি প্রয়োজনে সেখান দিয়ে যেতে হয় তাহলে অনেকের কপালেই ভয়ংকর কিছু ঘটে যেতে পারে।অনেকেই নাকি এভাবে মারা গেছে। দুষ্ট জ্বীন ভূঁত ‘থাবা’ দিলে নাকি গলায় রক্ত উঠে মানুষ মারা যায়।অনেকের পিঠে নাকি আবার সেই খবিস্ জ্বীনের বড়ো আকারের পাঁচ আঙ্গুলের স্পষ্ট ছাপ্ প্রায়ই দেখা যায়।
এসব জ্বীন ভূঁতের হাত থেকে বাঁচতে ঠিক দুপুর বেলা কিংবা আন্ধার রাতে অথবা অমাবস্যার রাতে তাদের আস্তানার নিচ দিয়ে পারতপক্ষে কেউ পা মাড়ায়না। বিশেষত মাছ বা শুঁটকির তরকারী দিয়ে ভাত খাওয়ার পর দাদা, চাচী, জেঠীরা বাম হাত দিয়ে মুখ মুছে বাইরে বের হতে উপদেশ দেন।রাতের বেলা হলে হাতে মোটা নলের ভম্বল(কেরোসিন তেলযুক্ত জ্বালানো লন্ঠন বিশেষ) নিয়ে বাইরে বেরোতে বা বাজারে যেতে নসিহত খয়রাত করেন।গিঠ্টুবাজ জ্বীন কেবল যে বহির্গামী পুরুষদেরই ধরে তাই নয়, নারীদের উপরও নাকি আছর করে। বিশেষত সুন্দরী নারী, কুমারীদের। কুশ্রী নারীদের প্রতি একেবারে আসক্ত হয়না এমনও নয়। কত রুচির জ্বীন আছে না! ঠিক মানুষের পছন্দ-অপছন্দের মত।ভালো জ্বীনেরা নাকি টাট্কা মিষ্টি এনে খাওয়ায়, হিমালয় পর্বত বা অন্য দেশ থেকে কাঁচা এলাচি এনে দেয়।
লোকজনও এমন এমন সব চাহিদা করে বসে যা সচরাচর বাংলাদেশে পাওয়া যায় না । মানুষের নানা প্রকার রোগ-ব্যাধি বালা মুসিবতের জন্য তাবিজ কবজ-ভালো জ্বীনে ধরা মহিলাদের কাছ থেকে পাওয়া যায়।এসব পাওয়া যায় বর্তি বসানোর সময়। বর্তির বিশেষত্ব হচ্ছে-প্রথমে একটি নতুন শীতল পাটির উপর জায়নামাজ বিছিয়ে নেওয়া হয়। তারপর অজু, গোসল করে তাতে বস ধ্যান মগ্ন হয় জ্বীনাশ্রীত নারী।‘নফি –এসবাত জিকির’ অথবা লোকজ মন্ত্র জপ কয়রা হতে থাকে-সেই সাথে বেদম মাথা ঝাঁকানি।
ঝাঁকানির চোটে আর হেঁকু হেঁকু জিকিরের ঠেলায় ক্লান্তি ও মুখে ফেনা তুলে ফেলার মত অবস্থার মত হয়। এক সময় পালা জ্বীন ধ্যান মগ্ন ঘরটিকে প্রবল এক ঝাঁকুনি দিয়ে এসে হাজির হয়।তখন লোকদের চাহিদা জানতে চাওয়া হয় এবং চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন জিনিস দান করা হয়। জ্বীণ চলে গেলে জ্বীন রমনী জ্ঞান হারিয়ে ধপাস করে জায়নামাজ বিছানার উপর ধপাস করে পড়ে যান। এবং কতক্ষন নির্জীব পড়ে থাকেন।পরে এই অবস্থা থেকে উত্তরনের জন্য পূর্বেই বাত্লে দেয়া দোয়া ও পড়া পানি ছিটিয়ে দিলে তিনি ধাতস্থ হন।
আর ত্যাঁদড় জ্বীন কাউকে ধরলে সহজে যেতে চায় না।বিশেষ করে মাদারের জ্বীন। এই জ্বীন তাড়াতেও মাদারের দোহায় দেয়া হয়।সকল প্রকার খারাপ জ্বীন তাড়ানোর জন্য অবশেষে ডাক পড়ে জ্বীন তাড়ানিয়া কোণ হুজুর, মুন্সী বা মোল্লা মৌলবীর।তাদের কোন একজন এসে রোগীকে প্রথমে শুইয়ে সমগ্র মুখের উপর একটি পরিস্কার কাপড়ের টুকরা বিছিয়ে দেন।
তারপর পড়া পানি কতক্ষন পর পর রোগীর মুখের উপর ছিটিয়ে দেন, আর বার বার জিজ্ঞেস করেন-তুই যাবি কিনা বল-গেলে কখন যাবি? যাওয়া নিয়ে কিছুটা গাঁই গুঁই করলে করলে জিজ্ঞেস করেন-কি দিলে তুই যাবি? জ্বীন হয়তো বললো-সোয়া পাঁচ সের চাউল,সোয়া পাঁচ আনা পয়সা বা একটই কালো রঙা মুরগি অমুক দিন দুপুর বেলা বা দুপুর রাতে অমুক বট গাছ তলায় রেখে আসতে হবে।কেউ পিছন দিক দিয়ে ডদাকলে কোন ক্রমে পিছনে তাকানো যাবেনা।তাকালে ঠিক মারা পড়বে।
এ ধরনের সন্ধি চুক্তিতে জ্বীনের সাথে আপোস রফা হয়।যদি উচ্চ পর্যায়ের কোন ঘাড় মোটা জ্বীন এসব ভোগ ভেটেও জেতে আগ্রহী না হয়, তাহলে জ্বীন হুজুর আরো কড়া ব্যবস্থা গ্রহন করেন। তখন শুকনো মরিচ পোড়া দিয়ে রোগীনির মুখে ধোঁইয়া দেন জ্বীন কে তাড়ানোর জন্য।এতেও জ্বীন যেতে রাজী না হলে , আরো কঠিন দোয়া বা মন্ত্র বলে তাকে জোর পূর্বক পেটমোটা বতোলে ভরা হয় এবং সেই বোতলকে অনেক দূরের জঙ্গলে পুঁতে রেখে আসা হয়।
জ্বীন ভূত তাড়ানোর পর ‘জ্বীন তাড়ানো হুজুর’ নানা দোয়া কালাম পড়ে চারটী পেরেক ফুঁকে দোয়া পড়তে পড়তে বাড়ীর চারি সীমানা প্রদক্ষিন করে এক এক কোণে একটী করে পেরেক পুঁতে রাখেন।যাতে খারাপ জ্বীন ভবিষ্যতে ঐ বাড়ীতে কিংবা বাড়ীর লোকজনের উপর হানা দিতে না পারে।একে বলে বাড়ী বান্ধা বা বাড়ি বন্ধ।
এই এলাকায় নানা রকম ভূত প্রেত, জ্বীন পরীর নানা রকম কীর্তিকলাপের কথা শোনা যায়। কিশোরগঞ্জ অঞ্চল এসব অশরীরিদের অতিপ্রিয়তায় ধন্য কেন? তা গবেষনার বিষয় বটে।এর গুঢ়তত্ত্ব যাই হোক না কেন, লোককথনের উৎপাদন উর্বরতা রীতিমত ঈর্ষনীয় বটে।
ভূত প্রেত জনিত দিবাতঙ্কের চেয়ে নিশিভীতির নানা কল্পকাহিনী এতদঞ্চলে বহুল প্রচলিত। এর মাঝে ‘আন্ধাগোলা’ অন্যতম। কোন ব্যক্তি রাতের বেলা দূরেও কোণ বাজার বা গন্তব্য থেকে একাকী বাড়ী ফেরার রাস্তা ধরলে,অনেক সময় পথ ভুল করে ফেলে। ফলে নিজ লক্ষপথ ছেড়ে ভিন্ন-পথ বিভ্রান্তিতে জড়ীয়ে পড়ে।লোকে এটাকে ‘আন্ধাগোলায়’ ধরা বলে।এটা নাকি ভূত প্রেতের কারবার। পথ ভুলিয়ে নিয়ে অনেক দূরে নিয়ে গিয়ে নাকি ঘাড় মটকায়। ভাগ্য ভাল হলে বেঁচে যায়।
অনেক সময় গভীর নিশিথে পথ চললে নির্জন মাঠে বা বনের পাশে আসামাত্রই অনেক সময় দুষ্ট কোন বিড়াল পায়ের কাছে ঘুরঘুর করে অনুসারী হয়। এ ধরনের বিড়াল রুপ নাকি আসলে ভূত প্রেতের।লোকে তখন দোয়া দুরুদ পরে সাহস বজায় রাখার চেষ্টা করেন।ভয় পেলেই সর্বনাশ ভূঁতে তখন ঘাড় মটকে খাবে।রাতের বেলায় একা চলায় বিপদ আছে আরো।রাতে নির্জন পথে হাটলে সামনে পড়ে ভূঁতড়ে দৃশ্য-
ভূঁতদের অভয়ারন্য হিসেবে খ্যাত কবরস্থান বা চিতাশাল।অনেক সময় নাকি রাতের বেলা কবরে আগুন জ্বলতে দেখা যায়।অতি-ধর্মবিশ্বাসিদের অনেকে আবার এর অপার্থিব ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন।দুনিয়াতে যারা ব্যাপক পাপকাজ করেছে,তাঁ র শাস্তিস্বরুপ নাকি সেই কবরে দোজকের আগুন জ্বলছে।অবশ্য যুক্তিবাদীরা ভিন্ন কথাও বলেন।কবরের স্যাঁতস্যাঁতে মৃত্তিকায় সৃষ্ট ফসফরাস বায়ুমন্ডলের অক্সিজেনের সংস্পর্শে এলে তাতে আগুন জ্বলে উঠে এবং কিছুক্ষন স্থায়ী হয়।
শুধু কবরস্থান নয়।ভূঁতের বিচরণ নদীতেও দেখা যায়।অনেক নেশাধর সৌখিন মাছ শিকারি বড়শি দিয়ে দূরে কোথাও মাছ শিকারে যায়।ব ড়শি পেতে তীরে উঠে মাছ ধরার অপেক্ষায় থাকে। নির্জনতার চান্স পেয়ে ভূঁতেরাও সক্রিয় হয়ে উঠে। সেগুলোর কোণও কোনটা ভেঙ্গে দিয়ে আসে, আবার বড়শির টোপ গিলে মাছের রুপ ধরে।
জ্বীনদের খাবার নিয়েও আছে চালু আছে মজার কথা।কেঁচোর জমানো মাটি নাকি এদের প্রিয় খাবার। এই অতি-মহা আবিস্কার-অদ্যবধি জানা যায়নি।তবে কিছু লোক এটা বিশ্বাস করে।
আজকাল কেন জানি জ্বীন ভূঁতের আছর অনেকাংশেই কমে গেছে। পাকুন্দিয়ায় সোয়া কিলোমিটার উত্তরে কিশোরগঞ্জ মুখী রাস্তার পাশে কোশাকান্দা গ্রাম। সেখানে রয়েছে কোশা নোকার আকৃতি বিশিষ্ট এক টুকরো জায়গা।কথিত আছে একদা যখন এখান দিয়ে নদী বয়ে যেত, তখন কোন একদিন ঈসা খাঁ মসনদ-ই আলার পণ্যবাহী কোশা নৌকা ডুবে যায়। সেই ডুবে যাওয়া নৌকারই আকার বিশিষ্ট এই স্থান।সেখানে সেই পুরোনো কালের কতিপয় গাছপালাও নাকি ছিল অনেক কাল।
বর্তমানে বিদ্যমান গাছপালা গুলো অবশ্য পরবর্তীতে গজানো। ঐ এলাকার লোকদের মাঝে বংশ পরস্পরায় এক আজব বিশ্বাস চলে আসছে।আর তা হচ্ছে এই কোশাকান্দা নামীয় চিহ্নিত স্থানের গাছ কাটলে নাকি –সে লোক গলায় রক্ত উঠে মারা যায়। ঐ স্থানের কোণ গাছে কোপ দিলে নাকি আগেকার দিনে লাল রক্ত বের হতো।তা ই কেউ পারত পক্ষে সেখানকার কোন গাছে দা বা কুড়াল চালাতনা।এই বিশ্বাস সাম্প্রতিককালে অনেকটাই ফিকে হয়ে এসেছে।