বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা করেন। তাঁর রাজনীতি স্বাধীনতা-উত্তরকালে জনগণের ক্রমবর্ধমান আকাক্সক্ষার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিল। ক্ষমতায় তাঁর উত্থান কেবল রাজনৈতিক অস্থিরতার ফসল ছিল না, বরং মুক্তিযুদ্ধের ট্রমা থেকে সেরে ওঠা একটি জাতির দিকনির্দেশনা, শৃঙ্খলা এবং একটি নতুন রাজনৈতিক পরিচয়ের জন্য সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে গভীর আকাক্সক্ষার ফলও ছিল। রাষ্ট্র গঠন, অর্থনৈতিক উদারীকরণ এবং রাজনৈতিক পুনর্গঠনে তাঁর অবদান সর্বজনস্বীকৃত। বাংলাদেশের প্রাথমিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠন এবং এর বহুদলীয় গণতন্ত্রের বিবর্তন ¯পষ্ট হওয়ার জন্য তাঁর ভূমিকা বোঝা দরকার।
ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে স্থিত শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নেতৃত্ব মুজিবের একদলীয় শাসনের পতনের পর বাংলাদেশের শাসনের গতিপথকে পুনর্নির্ধারণ করে। একটি নতুন জাতীয়তাবাদের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা এবং বেসামরিক-সামরিক ইন্টারফেসের পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান গণতন্ত্রের একটি প্রতিযোগিতামূলক রূপের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। জিয়াউর রহমান ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় সাহসিকতার জন্য প্রথম খ্যাতি অর্জন করেন। চট্টগ্রামের কালুরঘাট থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তাঁর পথচলা জাতির গতিপথে রূপান্তরমূলক প্রভাব ফেলেছিল। তখন তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন তরুণ মেজর ছিলেন। তাঁর সাহসী ঘোষণা অনেকের চোখে জিয়াউর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধের বীর হিসেবে মর্যাদাকে সুদৃঢ় কর
জাতীয় রাজনীতিতে জিয়াউর রহমানের প্রবেশ অপ্রত্যাশিত কিন্তু সময়োপযোগী ছিল, ছিল রাইপ মোমেন্ট। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের পর, দেশ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে ডুবে যায়। যুদ্ধ ও বিশৃঙ্খলায় ক্লান্ত এবং অর্থনৈতিক দুর্দশার মুখোমুখী জনসাধারণ স্থিতিশীলতার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। সৎ জিয়াউর রহমান, তার সুশৃঙ্খল সামরিক অভিজ্ঞতা এবং মুক্তিযুদ্ধের বীর হিসেবে তার খ্যাতি, সাহস এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতার পরিচয় প্রকাশ করেন। দেশের প্রাথমিক সংকট থেকে বেঁচে থাকার জন্য দৃঢ় নেতৃত্বের প্রয়োজন ছিল। তা তিনি পূরণ করতে সক্ষম হন। বলাবাহুল্য, বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে জেনারেল জিয়াউর রহমানের উত্থান ১৯৭৫ সাল পরবর্তী সংকটের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে স¤পর্কিত। তাঁর শাসনকাল (১৯৭৭-১৯৮১) একটি অনন্য মডেল হিসেবে গণ্য হয়, যা জনপ্রিয় গণতান্ত্রিক শাসনের কাঠামো।
২. জিয়াউর রহমানের মোডাস অপারেন্ডির মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল জাতীয় পরিচয়ের পুনর্গঠন। সেসময় বাঙালি জাতীয়তাবাদকে দূরে সরিয়ে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ ধারণাকে এগিয়ে নিয়ে একটি আঞ্চলিক, ইসলাম-প্রভাবিত পরিচয়ের দিকে পুনর্গঠন করার চেষ্টা করেছিলেন, যা সার্বভৌমত্ব, সাংস্কৃতিক পার্থক্য এবং ধর্মীয় ঐতিহ্যের উপর জোর দেয়। এই আদর্শিক পটভূমির বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল। যেমন, মুক্তিযুদ্ধের ন্যারেটিভসের উপর আওয়ামী লীগের একচেটিয়া অবস্থানকে স্থানচ্যুত করা; রাষ্ট্রের আদর্শিক আবেদনকে আরও বেগবান করে গ্রামীণ নির্বাচনী এলাকায় প্রসারিত করা। এসব রাষ্ট্র ও নাগরিকের মধ্যে স¤পর্ক পুনর্গঠন করেছিল। তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে দূরে সরে গিয়ে রাজনৈতিক আলোচনায় ইসলামী মূল্যবোধকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
পোস্ট-কলোনিয়াল তত্ত্বে, এই ধরনের পরিবর্তন ন্যারেটিভস পুনর্গঠনের রাজনীতির উদাহরণ, যেখানে নতুন অলিগার্করা তাদের নিজস্ব বৈধতা প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয়তার প্রতীকী মূলধনকে পুনর্ব্যক্ত করে। অতএব, জিয়াউর রহমানের জাতীয়তাবাদ কেবল কথামালায় সীমাবদ্ধ ছিল না; এটি ছিল কাঠামোগত, টেক্সচুয়াল, রাষ্ট্রীয় মিডিয়া এবং সাংবিধানিক ভাষা গঠনকারী। বিশিষ্টজনরা এটিকে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিচয় হিসেবে দেখেছিলেন, যা জাতিগত সংখ্যালঘুদের স্বীকৃতি দেয় এবং দেশকে ভারতের প্রভাব থেকে দূরে সরায়। অর্থাৎ ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ ধারণার চারপাশে আবর্তিত হয়েছিলÑ মুক্তিযুদ্ধের আখ্যানে প্রাধান্য বিস্তারকারী বাঙালি জাতিগত জাতীয়তাবাদ থেকে কৌশলগত প্রস্থান। এটি কেবল একটি স্লোগান ছিল না; এটি ছিল বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং ভৌগোলিক স্বাতন্ত্রের সাথে জাতীয় পরিচয়কে একত্রিত করার একটি প্রচেষ্টা। কিন্তু কেবল আদর্শই জিয়াউর রহমানের রাজনীতির দিকে মানুষকে আকৃষ্ট করেনি। তিনি প্রশাসনকে বিকেন্দ্রীকরণ করেছিলেন, গ্রামীণ উন্নয়নের উপর জোর দিয়েছিলেন এবং মুজিবী শাসনব্যবস্থার নগরকেন্দ্রিক নীতি দ্বারা বিচ্ছিন্ন বোধ করা জনসংখ্যার অংশগুলিকে রাজনৈতিক কণ্ঠস্বর দিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন উদ্বেগগুলি: খাদ্য সুরক্ষা, শিক্ষা, জীবিকা নির্বাহের দিকে মনোনিবেশ করেছিলেন। এই কর্মসূচিগুলি রাজনৈতিক মনোযোগ রাজধানী থেকে সরিয়ে তৃণমূল স্তরের দিকে নিতে সহায়তা করেছিল। খাল খনন কর্মসূচি নিঃসন্দেহে বৈপ্লবিক ছিল। জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের কেন্দ্রীভূত, রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি থেকে দূরে সরে গিয়ে উদারীকরণ এবং বিকেন্দ্রীকরণকে সমর্থন করেছিলেন। তাঁর পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা কৃষি স্বনির্ভরতা, খাদ্য নিরাপত্তা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের উপর জোর দিয়েছিল, যা যুদ্ধ-পরবর্তী একটি ভঙ্গুর অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে সহায়তা করেছিল। তাঁর শাসনকালে জনশক্তি রপ্তানি ও গার্মেন্টস শিল্পকেন্দ্রিক যে সিদ্ধান্ত তার সুফল আজকের মানুষ ভোগ করছে।
জিয়াউর রহমান সশস্ত্র বাহিনীর পেশাদারীকরণকেও অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন এবং মুজিব আমলের বিশৃঙ্খলার পরে সামরিক বাহিনীকে রাজনীতিমুক্ত করার জন্য কাজ করেছিলেন। একজন সুশৃঙ্খল সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর পটভূমি তৎকালীন প্রশাসনিক শৈলীকে কেন্দ্রীভূত, শৃঙ্খলা-চালিত এবং দক্ষতার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। তাঁর সরকার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বৃদ্ধি, গোয়েন্দা সংস্থাগুলির সংস্কার এবং রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা উন্নত করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল।
৩. বাংলাদেশের রাজনীতিতে জিয়াউর রহমানের সবচেয়ে স্থায়ী অবদানগুলির মধ্যে একটি ছিল ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন। বিএনপি গঠন ছিল একটি বেসামরিক কাঠামোর মধ্যে তাঁর শাসনকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের জন্য একটি পরিকল্পিত পদক্ষেপ। আমলাতন্ত্র, সশস্ত্র বাহিনী, ইসলামপন্থী চিন্তাবিদ এবং প্রান্তিক রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বিএনপি বিচিত্র মানুষের একটি জোটের প্রতিনিধিত্বে পরিণত হয়, সেসময় এটি ছিল আওয়ামী লীগের পূর্ববর্তী আধিপত্যের বিরুদ্ধে একটি আদর্শিকভাবে বৈচিত্র্যময় কিন্তু কৌশলগতভাবে সংযুক্ত বিরোধিতার রাজনীতি। প্রকৃতপক্ষে বিএনপি আওয়ামী লীগের আধিপত্যের বিরুদ্ধে একটি বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প প্রস্তাব করে, যার ফলে দেশে প্রতিযোগিতামূলক বহুদলীয় রাজনীতির সূচনা হয়। নির্বাচনী প্রক্রিয়ার উপর জিয়াউর রহমান জোর দিয়েছিলেন গণভোট (১৯৭৭), রাষ্ট্রপতি নির্বাচন (১৯৭৮) এবং সংসদীয় নির্বাচন (১৯৭৯)Ñ একটি বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রচেষ্টার ইঙ্গিত দেয়, যেখানে বহুমতের মিলনে আনুষ্ঠানিক গণতান্ত্রিক পদ্ধতি সহাবস্থান করে।
৪. জিয়াউর রহমানের শাসন বাংলাদেশে বেসামরিক-সামরিক স¤পর্কের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের একটি গঠনমূলক অধ্যায়ের প্রতিনিধিত্ব করে। দেশের প্রয়োজনে জিয়াউর রহমান বেসামরিক-সামরিক সহাবস্থানের একটি মডেল গ্রহণ করেছিলেন। তিনি জাতীয় উন্নয়ন, অবকাঠামো এবং প্রশাসনেÑ বিশেষ করে গ্রামীণ অর্থনীতিতে এর ভূমিকা সম্প্রসারণের সাথে সাথে সামরিক বাহিনীকে পেশাদারিত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর শাসনকালে বাক-স্বাধীনতা, বিরোধীদের অধিকার সংরক্ষণ, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা ছিল অসাধারণ মাইফলক। তিনি নানা মতের সহাবস্থানের পক্ষপাতী ছিলেন।
প্রখ্যাত প্রুশীয় কূটনৈতিক ও রাষ্ট্রনায়ক বিসমার্ক যেমন পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে নিজের দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতেন, তেমনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জিয়াউর রহমান একটি জোটনিরপেক্ষ, বাস্তববাদী পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছিলেন। মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের সাথে স¤পর্ক জোরদার করেন। তিনি আঞ্চলিক সহযোগিতার একজন প্রধান প্রবক্তা ছিলেন, যা দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক)’র ভিত্তি স্থাপন করেছিল। তার পররাষ্ট্রনীতির পদক্ষেপগুলি আদর্শিক স্তর থেকে কৌশলগত বহুত্ববাদে স্থানান্তরের ইঙ্গিত দেয়, দক্ষিণ এশিয়ার একটি ভূরাজনৈতিকভাবে দুর্বল রাষ্ট্রের সীমাবদ্ধতা এবং সুযোগগুলিকে কাজে লাগিয়েছিলেন তিনি।
৫. জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার একটি প্যারাডক্স অধ্যয়ন হিসেবে চিহ্নিত। একজন সামরিক নেতা যিনি নির্বাচনী রাজনীতি পুনরুদ্ধার করেছিলেন; একজন জাতীয়তাবাদী, যিনি রাষ্ট্রের আদর্শিক সীমানা পুনর্নির্মাণ করেছিলেন; একজন সুশাসক, যিনি দলীয় রাজনীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিলেন। রাজনীতিতে সামরিক স¤পৃক্ততাকে গুরুত্ব দিলেও গণতন্ত্রকে বৈধতা দেওয়ার এবং ভিন্নমত বিকাশের ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য; দল গঠন, পরিচয় নির্মাণ এবং উন্নয়নমূলক শাসনব্যবস্থায় তাঁর অবদানের স্থায়ী প্রভাব রয়েছে।
দক্ষিণ এশীয় রাজনীতির প-িতদের জন্য, জিয়াউর রহমানের শাসন ও রাজনীতি একটি অসাধারণ উদাহরণ, যেখানে বৈধতা ক্রমাগত শক্তি, আদর্শ এবং জনসাধারণের অংশগ্রহণের মধ্যে স্থিত। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে আজও যে কাঠামোগত ভিত্তির মধ্য দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা হচ্ছে, তার ব্যাখ্যা করার জন্য তাঁর যুগকে বোঝা অপরিহার্য।
১৯৮১ সালে নির্মম হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে তাঁর উন্নয়ন আদর্শের চর্চা সাময়িকভাবে স্তব্ধ হলেও তাঁর রাজনৈতিক মডেল রয়ে গেছে জনগণের মণিকোঠায়। একজন সেনাপতি, রাষ্ট্রনায়ক, আইনপ্রণেতা, বক্তা এবং ইতিহাসবিদ হিসেবে প্রাচীন রোমে জুলিয়াস সিজার যেমন তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনে ইতিহাসে স্থায়ী ছাপ রেখে গেছেন, তেমনি শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তাঁর লাইফ আফটার ডেথ-এ বাংলাদেশের ভূগোল জনপদে চিরঞ্জীব হয়ে আছেন।
লেখক: সাবেক চেয়ারম্যান, থিয়েটার এন্ড পারফরমেন্স স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।