গাজায় চলমান ইসরায়েলি হামলার বিভীষিকা প্রতিনিয়ত আমাদের সামনে একের পর এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র তুলে ধরছে। এবারে সেই হৃদয়বিদারক দৃশ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে সাত বছরের একটি শিশু মেয়ে—ওয়ার্দ শেখ খলিল। এক রাতের আগুনে স্কুল থেকে মাকে, ছয় ভাইবোনকে হারানো ছোট্ট মেয়েটির বেঁচে ফেরার গল্প এখন কাঁদাচ্ছে পুরো দুনিয়াকে।
রোববার মধ্যরাতে গাজা শহরের দক্ষিণে অবস্থিত ফাহমি আল-জারজাওয়ি স্কুলে আশ্রয় নিয়েছিলেন শত শত ফিলিস্তিনি। এই স্কুলটি যুদ্ধের নৃশংসতা থেকে পালিয়ে বেঁচে থাকা সাধারণ মানুষদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল ছিল। কিন্তু রাতের আঁধারে সেই আশ্রয়কেন্দ্রেই হামলা চালায় ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান। স্কুলে একের পর এক মিসাইল বর্ষণে মুহূর্তেই আগুন ধরে যায় ক্লাসরুমগুলোতে, যা রূপ নেয় একটি জ্বলন্ত মৃত্যুকূপে। আগুনের গ্রাসে পুড়ে যায় অসংখ্য মানুষ, প্রাণ হারান অন্তত ৩৬ জন, যাদের মধ্যে ১৮ জন শিশু ও ৬ জন নারী।
ওয়ার্দ শেখ খলিল সেই বিভীষিকাময় আগুনের মধ্য দিয়ে কোনোরকমে বেরিয়ে আসে নিজের ক্লাসরুম থেকে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, আগুন আর ধোঁয়ার মাঝে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে আসছে ওয়ার্দ, চোখে-মুখে আতঙ্ক আর পোড়া কষ্টের ছাপ। পরে হাসপাতালের বিছানায় বসে ওয়ার্দ তার চাচা ইয়াদ মুহাম্মদ আল শেখ খলিলকে জানায়, “মিসাইলটা আমাদের ওপরই পড়ল। স্কুলটা আগুনে জ্বলে উঠল। আর চোখের সামনে আমি আমার মা ও ভাইবোনকে পুড়তে দেখেছি।”
সিবিসি নিউজের খবরে বলা হয়, এই ভয়াল হামলায় ওয়ার্দের মা ও পাঁচ ভাইবোন মারা গেছেন, যাদের বয়স ২ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। আলজাজিরা বলছে, নিহত ভাইবোনের সংখ্যা ছয়। তারা সবাই ঘুমিয়ে ছিলেন বোমা পড়ার মুহূর্তে। একই সঙ্গে ওয়ার্দের বাবা ও আরেক ভাই গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, এবং তাদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। উদ্ধারকর্মীরা জানান, আগুনের মধ্যে দিয়ে হেঁটে বের হতে দেখা গিয়েছিল ছোট্ট ওয়ার্দকে, সেখান থেকে তাকে তুলে আনা হয় এবং তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
ওয়ার্দের চাচা ইয়াদ বলেন, “আমি রাতে খবর পেলাম আমার ভাইয়ের পরিবার যে স্কুলে ছিল সেটি বোমায় উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ছুটে যেতে চাইলেও পারিনি, চারপাশে তখনো গোলাবর্ষণ চলছিল, আর চারদিক অন্ধকার।” ভোরের দিকে তিনি যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছান, তখন যা দেখেন তা ছিল এক নির্মম, অকল্পনীয় দৃশ্য। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দেহের খণ্ডাংশ, ধোঁয়ায় ঘেরা বাতাস, পোড়া রক্তের গন্ধ, সব মিলিয়ে যেন এক নরক বাস্তবতায় রূপ নিয়েছিল স্কুল চত্বর। ইয়াদ বলেন, “আমরা প্রথমে লাশ খুঁজছিলাম। পরে শুধু হাত, পা, পোড়া কাপড় খুঁজে শনাক্ত করার চেষ্টা করছিলাম।
ইসরায়েলি বাহিনী ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকায় ধারাবাহিকভাবে হামলা চালিয়ে আসছে। মূল লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে বেসামরিক স্থাপনা—স্কুল, হাসপাতাল, ঘরবাড়ি। এর আগে ২০২৩ সালের আগস্টে গাজার আল-তাবিন স্কুলেও বড় হামলা চালিয়েছিল ইসরায়েল, যেখানে বহু শিশু নিহত হয়েছিল। এই হামলাগুলো আন্তর্জাতিক আইন এবং মানবিক নীতির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হলেও এখন পর্যন্ত কার্যকর প্রতিরোধ বা জবাবদিহিতা গড়ে ওঠেনি।