যশোর সদর উপজেলার একটি গ্রাম পতেঙ্গালী। গ্রামের চারদিকে শুধু সবুজের সমারোহ। গ্রামের মানুষগুলির মূল পেশা কৃষি। সব ধরনের ফসল এখানে উৎপন্ন হয়। আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও মানুষগুলি মাটির সোঁদা গন্ধ শুঁকে নিঃশ্বাসে নিতে বেশি অভ্যস্ত।
এ গ্রামেরই জরিনা তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখেই দিন যাপন করছে। স্বামী ব্যবসার কাজে অধিকাংশ সময় ঘরের বাইরে থাকেন। তাই সংসারে যাবতীয় কাজ তারই নিজ হাতে সম্পন্ন করতে হয়। একদিন দুপুরে হঠাৎ করে তার মনে আসে আজই বিদুৎ বিল দেওয়ার শেষ তারিখ। বিলটি পরিশোধ করতে কাকে স্থানীয় ব্যাংকে পাঠাবেন তা নিয়ে বেশ ভাবনায় পড়ে গেলেন। তখনই প্রতিবেশীর পরামর্শে জরিনা ছুটে যায় তার পাশের গ্রামে আরবপুর ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্রে। অল্প সময়ের মধ্যে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করে ঘরে ফিরে এসে আবার রান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অথচ কিছুদিন আগেও উপজেলা সদরে গিয়ে ব্যাংকে দীর্ঘ লাইন দিয়ে বিদ্যুৎ বিল দিতে হতো। একবার তো সদরের ব্যাংকে বিদ্যুৎ বিল জমা দিতে গিয়ে তার স্বামীর নতুন কেনা বাই-বাইকেলটি চুরি হয়ে যায়। তাছাড়া ১১০ টাকার বিল দিতে গিয়ে ৪৫ টাকা যাতায়াত ভাড়া ব্যয় হয়। কিন্তু এখন গ্রামের মানুষদের কাছে বিশেষ করে নারীদের কাছে এসব কাজ কতো সহজ হয়ে উঠেছে – এসব ভেবে জরিনা বেগম অপরিসীম স্বস্তি বোধ করেন।
যশোর সদর উপজেলার ভেকুটিয়া গ্রামের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ছাত্র শরিফ নেওয়াজ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনা প্রথম পর্বে ভর্তির জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে রাজশাহী গিয়ে বিপাকে পড়ে। তার ভর্তির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ কমতি পড়ে যায়। উপায়ন্তর না দেখে বাড়িতে তার একমাত্র অভিভাবক মাকে বিষয়টি জানায়। শরিফ নেওয়াজের মা রেবেকা হোসেন সন্তানের এমন বিপদে গ্রামের স্কুলের মাস্টার রফিকউদ্দিনের সাহায্য চাইলে রফিকউদ্দিন পাশের গ্রাম আরবপুর ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্রে গিয়ে মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে বাড়তি টাকা পাঠিয়ে দিলে শরিফ নিশ্চিন্তে নির্ধারিত তারিখ ও সময়ের মধ্যে ভর্তি হতে সক্ষম হয়।
মোবাইল ব্যাংকিং এর পাশাপাশি গ্রামে বসে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নিয়ে নারীদের বিভিন্ন স্থানে কর্মসংস্থান হচ্ছে। ছয়-সাত কিলোমিটার দূরের স্থানীয় ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্র থেকে সাহায্যপ্রার্থী নারীরা জেলা প্রশাসকের কাছে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আবেদন করতে পারছেন। সেবাকেন্দ্রের নারী উদ্যোক্তারা এখন প্রতিমাসে হাজার হাজার টাকা উপার্জন করছেন। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রবাসে কর্মরত বাবা-ভাইয়ের সাথে আপনজনরা সানন্দে কথা বলতে পারছে। আবার সেবাকেন্দ্রে এসে বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা বখাটেদের সম্পর্কে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের অবহিত করছে। সরেজমিনে সমীক্ষা চালিয়ে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়নের এমন ইতিবাচক তথ্য পাওয়া যায়। প্রথম ডিজিটাল জেলা যশোরে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে এভাবেই নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে।
২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যশোর জেলার প্রথম ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্র চালু হয়। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একসেস টু ইনফরমেশন প্রকল্পের অধীন যশোরের জেলা প্রশাসন ডিজিটাল সেবার বিষয়টি বাস্তবায়ন করে। পরবর্তীতে জেলার ৫১টি ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্র চালু করা হয়। এ কেন্দ্রগুলির সঙ্গে ৫১ জন পুরুষ ও ৫১ জন নারী উদ্যোক্তা জড়িত। গ্রামের দরিদ্র, শিক্ষিত নারী উদ্যোক্তারা এখন তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতিমাসে ৩ হাজার টাকা থেকে ১৫ হাজার টাকা উপার্জন করছেন। আরবপুর সেবাকেন্দ্রেরই রাবেয়া খাতুন জানান, তিনি মাদ্রাসায় লেখাপড়া শেষ করে কর্মহীন ছিলেন। সেবাকেন্দ্রে কম্পিউটার প্রশিক্ষণের পর বর্তমানে প্রতিমাসে ১৫ হাজার টাকা উপার্জন করে তার সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য এসেছে।
দুই.
আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে জনগণের কাছে স্বল্প সময়ে কম খরচে দ্রুত তথ্য সেবা পৌঁছে দেওয়ার এবং অনলাইন সুবিধা প্রদান করে সারা দুনিয়ার অবারিত জ্ঞান ভা-ারের সাথে সমাজের সর্বস্তরের জনগণের সংযোগ ঘটানোই ডিজিটার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য। তৃণমূল পর্যায়ের জনগণকে জাতীয় উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় সংযুক্ত করার অভিপ্রায়ে তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার অনস্বীকার্য। এ লক্ষ্যেই দেশের ৪৫০১টি ইউনিয়ন পরিষদে ‘ইউনিয়ন তথ্য সেবাকেন্দ্র’ (ইউআইএসসি) সফলভাবে প্রতিষ্ঠিত করে ধনী-দরিদ্র, নারী পুরুষ নির্বিশেষে সমাজের সর্বস্তরের জনগণকে তথ্য সেবা প্রদানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় পর্যায়ে সাধারণ মানুষের কাছে ইউআইএসসি’র গ্রহণযোগ্যতা ও এর কার্যকারিতার কথা ভেবে সরকার জনগণ ও উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে একটি ব্যবসায়িক প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ইউআইএসসি’র ‘সরকার-উদ্যোক্তা-জনগণ’ প্রক্রিয়া অনুযায়ী ইউনিয়ন পর্যায়ের কমপক্ষে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ও কম্পিউটার কাজে অভিজ্ঞ নারী ও পুরুষকে তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে নির্বাচন করা হয়। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সহায়তায় উদ্যোক্তা নির্বাচন করে থাকেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকতা। সকল ইউআইএসসি’র বাস্তবায়নের ফলে দেশে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ভেতর থেকে ৯ হাজারের বেশি মানুষের প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান হয়েছে। আশার কথা এই বিশাল জনশক্তির অর্ধেকই নারী।
দেশের প্রথম ডিজিটাল জেলা যশোরে তথ্য প্রযুক্তির বিভিন্ন মাধ্যম চালু করে তা বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন ধরনের ৫৭ প্রকার সেবা প্রদান করা হচ্ছে। জেলা ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্র ছাড়াও উপজেলা ও ইউনিয়ন তথ্য কেন্দ্রের মাধ্যমে একেবারে গ্রাম প্রর্যায়ে তথ্য প্রযুক্তির আধুনিক সেবা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে মানুষের জীবনযাত্রা হয়েছে সহজ, আনন্দময় ও গতিশীল।
-পিআইডি ফিচার