ঢাকা ০৪:০১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৭ জুন ২০২৫, ৩ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আমার সোনার বাংলা’ যেভাবে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হলো

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৯:৫৪:৫৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫
  • ৪৩ বার
গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর যেসব বিষয় পরিবর্তনের দাবি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা তৈরি হয় তার মধ্যে একটি ছিল বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। সম্প্রতি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে শাহবাগে অবস্থানকালে আন্দোলনকারীদের এক পক্ষ জাতীয় সংগীত গাওয়ার সময় আরেক পক্ষকে বাধা দেওয়ায় ওই বিতর্ক আবার সামনে এসেছে।

জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের পক্ষের ব্যক্তিদের যুক্তি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি বাংলাদেশ সৃষ্টির অনেক আগে রচিত হয়েছিল। আর বিপরীত পক্ষের ভাষ্য, এই গান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে ওতোপ্রতভাবে জড়িত।

জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের পক্ষে-বিপক্ষের যুক্তি-পাল্টা যুক্তি যখন চলমান, তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি কীভাবে ও কেন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছিল, তার কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে।

‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে লিখেছিলেন বলে বিভিন্ন প্রবন্ধ ও লেখায় উঠে আসলেও এই গানটির মূল পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়নি বলে এই তথ্য সঠিকভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি – রবীন্দ্রনাথের জীবনীলেখক প্রশান্তকুমার পাল ১৯৯০ সালে প্রকাশিত বই ‘রবিজীবনী’তে এমনটাই লিখেছেন।

ওই বইয়ে প্রশান্তকুমার পাল উল্লেখ করেছেন যে, এই গানটি ১৯০৫ সালের ২৫ আগস্ট কলকাতা টাউন হলের একটি প্রবন্ধ পাঠের আসরে প্রথমবার গাওয়া হয়েছিল।

১৯৭১ পূর্ববর্তী বাংলাদেশে, অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্রসংগীত হিসেবে অনেক অনুষ্ঠানেই এই গানটি গাওয়া হতো বলে বলে জানান লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ।

তবে এটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করার ধারণা প্রথমবার তৈরি হয় ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে।মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ১৯৭১ সালের ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আচমকা স্থগিত করার ঘোষণা দেওয়ায় মানুষের মধ্যে গণবিক্ষোভ দেখা যায়। ঢাকার অনেক জায়গায় পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে মানুষ বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় পতাকা উত্তোলন করে সেটিকে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা বলে ঘোষণা করেন তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ, ডাকসুর ভিপি আ.স.ম. আবদুর রব।

ওই দিনই ২ মার্চ বিকেলে ইকবাল হলের ক্যান্টিনে তৎকালীন ছাত্রলীগের একাংশের গুরু সিরাজুল আলম খানের উপস্থিতিতে স্বাধীনতার ইশতেহার লেখার চিন্তা করা হয় ও সন্ধ্যায় ইকবাল হলে ওই ইশতেহারটি লেখা হয়।২ মার্চ সন্ধ্যায় ইকবাল হলে বসে লেখা ইশতেহারটিতে ‘আমার সোনার বাংলা’কে স্বাধীন বাংলার জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করার বিষয়টি প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে উল্লিখিত হয় বলে বলে জানান মহিউদ্দিন আহমেদ।

ওই ইশতেহারটি পরদিন, ৩ মার্চ, পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে হওয়া ছাত্র সংসদ পরিষদের এক জনসভায় পাঠ করেন তৎকালীন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ। পল্টন ময়দানের সেই জনসভায় উপস্থিত ছিলেন সেসময়কার ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকিও। তিনি ২০২৩ সালে মারা যান।

নূরে আলম সিদ্দিকি ২০১৬ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলন, জাতীয় সংগীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা’ ছাড়াও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’ গানটিও অনেকের পছন্দের তালিকায় ছিল।

তবে ওই গানটিকে দুটি কারণে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্বাচন করা হয়নি বলে জানান লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গানের একটি বিষয় ছিল যে এই গানে বাংলা বা বাংলাদেশ শব্দটি ছিল না। আরেকটি বিষয় ছিল যে এই গানের রেকর্ড সেসময় পাওয়া যায়নি।

কোন গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্ধারণ করা হবে, তার পেছনে গানের রেকর্ডের প্রাপ্যতা সেসময় একটি বড় কারণ ছিল বলে জানান মহিউদ্দিন আহমেদ।

কারণ গানের রেকর্ড না থাকলে ঠিক কোন সুরে এবং গানের কতটুকু জাতীয় সংগীত হিসেবে ব্যবহার করা হবে, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হওয়ার আশঙ্কা ছিল বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, সেসময় ধনধান্যে পুষ্পে ভরা গানের কোনো রেকর্ড আমাদের কাছে ছিল না। কিন্তু ১৯৭০ সালে জহির রায়হান ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে আমার সোনার বাংলা গানটি ব্যবহার করায় সেটির একটি রেকর্ড ছিল আমাদের কাছে।

আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃত হওয়ার আগে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বহু আন্দোলন ও প্রতিবাদ কর্মসূচিতে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি ব্যবহার হয়েছে বলে উঠে এসেছে বিভিন্ন প্রবন্ধ ও গবেষণাধর্মী লেখায়।

২০১৬ সালে অনলাইন পত্রিকা বাংলানিউজ টুয়েন্টিফোরে প্রকাশিত প্রাবন্ধিক মুহাম্মদ সবুর ‘আমার সোনার বাংলা যেভাবে জাতীয় সংগীত হলো’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, ১৯৫৩ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদ বায়ান্নর ভাষা শহীদদের স্মরণে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আবদুল লতিফের লেখা ও সুর করা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’র পাশাপাশি ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়া হয়।

সংগীতশিল্পী সনজীদা খাতুন, যিনি ২০২৫ সালের এপ্রিলে মারা গেছেন, তার প্রবন্ধ ‘রমনা বটমূল, ছায়ানট এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধ’তে লিখেছেন ১৯৫৬ সালে গণপরিষদের অধিবেশনে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়ার জন্য শেখ মুজিবুর তাকে অনুরোধ করেছিলেন।

কার্জন হলে আয়োজিত ওই অধিবেশনে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন এবং ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি “বাঙালিদের কতখানি আবেগতাড়িত করে, সেটি বোঝানোর জন্য শেখ মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানিদের গানটি শোনাতে চেয়েছিলেন” বলে তার লেখায় উল্লেখ করেন সনজীদা খাতুন।

প্রবন্ধে সনজীদা খাতুন আরো লিখেছেন যে, ষাটের দশকে রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি চলা সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির বড় ভূমিকা ছিল।

সনজীদা খাতুন তার লেখায় উল্লেখ করেন, ১৯৬৭ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী বেতার ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার নিষিদ্ধ করার পর সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু করে সব সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। সেসময় সব সভা-সমাবেশে রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করা হয়, যার মধ্যে ‘আমার সোনার বাংলা’ ছিল অন্যতম।

ওই আন্দোলনের একজন সংগঠক, সংগীতজ্ঞ ওয়াহিদুল হকের বরাত দিয়ে সনজীদা খাতুন তার লেখায় লিখেছেন যে ‘সাতষট্টির আন্দোলনের সবচেয়ে স্থায়ী ফসল ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির যথাযোগ্য প্রতিষ্ঠা।’

ষাটের দশকের সেই আন্দোলন চূড়ান্তভাবে পূর্ণতা পায় একাত্তরের এপ্রিলে, যখন ‘আমার সোনার বাংলা’কে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় সংগীতের স্বীকৃতি দেয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার।

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নীহার রঞ্জন চক্রবর্তী। ২০২০ সালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, সেদিন নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর থেকে একদল গায়ককে আনা হয়েছিল ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়ার জন্য। শপথ গ্রহণের আনুষ্ঠানিকতা শেষে অস্থায়ী সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। তখন সেখানে প্রথমবারের মত সরকারিভাবে জাতীয় সংগীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা’ পরিবেশন করে কৃষ্ণনগর থেকে আসা ওই গায়কদল।

পরে ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি বাংলাদেশের মন্ত্রিসভার প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠকে ‘আমার সোনার বাংলা’র প্রথম দশ চরণ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্বাচিত হয়।

সূত্র : বিবিসি বাংলা।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

আমার সোনার বাংলা’ যেভাবে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হলো

আপডেট টাইম : ০৯:৫৪:৫৩ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫
গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যূত হওয়ার পর যেসব বিষয় পরিবর্তনের দাবি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা তৈরি হয় তার মধ্যে একটি ছিল বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। সম্প্রতি আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে শাহবাগে অবস্থানকালে আন্দোলনকারীদের এক পক্ষ জাতীয় সংগীত গাওয়ার সময় আরেক পক্ষকে বাধা দেওয়ায় ওই বিতর্ক আবার সামনে এসেছে।

জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের পক্ষের ব্যক্তিদের যুক্তি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি বাংলাদেশ সৃষ্টির অনেক আগে রচিত হয়েছিল। আর বিপরীত পক্ষের ভাষ্য, এই গান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে ওতোপ্রতভাবে জড়িত।

জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের পক্ষে-বিপক্ষের যুক্তি-পাল্টা যুক্তি যখন চলমান, তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি কীভাবে ও কেন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছিল, তার কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়েছে এই প্রতিবেদনে।

‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে লিখেছিলেন বলে বিভিন্ন প্রবন্ধ ও লেখায় উঠে আসলেও এই গানটির মূল পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়নি বলে এই তথ্য সঠিকভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি – রবীন্দ্রনাথের জীবনীলেখক প্রশান্তকুমার পাল ১৯৯০ সালে প্রকাশিত বই ‘রবিজীবনী’তে এমনটাই লিখেছেন।

ওই বইয়ে প্রশান্তকুমার পাল উল্লেখ করেছেন যে, এই গানটি ১৯০৫ সালের ২৫ আগস্ট কলকাতা টাউন হলের একটি প্রবন্ধ পাঠের আসরে প্রথমবার গাওয়া হয়েছিল।

১৯৭১ পূর্ববর্তী বাংলাদেশে, অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্রসংগীত হিসেবে অনেক অনুষ্ঠানেই এই গানটি গাওয়া হতো বলে বলে জানান লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ।

তবে এটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করার ধারণা প্রথমবার তৈরি হয় ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে।মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ১৯৭১ সালের ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আচমকা স্থগিত করার ঘোষণা দেওয়ায় মানুষের মধ্যে গণবিক্ষোভ দেখা যায়। ঢাকার অনেক জায়গায় পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে মানুষ বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় পতাকা উত্তোলন করে সেটিকে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা বলে ঘোষণা করেন তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ, ডাকসুর ভিপি আ.স.ম. আবদুর রব।

ওই দিনই ২ মার্চ বিকেলে ইকবাল হলের ক্যান্টিনে তৎকালীন ছাত্রলীগের একাংশের গুরু সিরাজুল আলম খানের উপস্থিতিতে স্বাধীনতার ইশতেহার লেখার চিন্তা করা হয় ও সন্ধ্যায় ইকবাল হলে ওই ইশতেহারটি লেখা হয়।২ মার্চ সন্ধ্যায় ইকবাল হলে বসে লেখা ইশতেহারটিতে ‘আমার সোনার বাংলা’কে স্বাধীন বাংলার জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করার বিষয়টি প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে উল্লিখিত হয় বলে বলে জানান মহিউদ্দিন আহমেদ।

ওই ইশতেহারটি পরদিন, ৩ মার্চ, পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের নেতৃত্বে হওয়া ছাত্র সংসদ পরিষদের এক জনসভায় পাঠ করেন তৎকালীন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ। পল্টন ময়দানের সেই জনসভায় উপস্থিত ছিলেন সেসময়কার ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকিও। তিনি ২০২৩ সালে মারা যান।

নূরে আলম সিদ্দিকি ২০১৬ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলন, জাতীয় সংগীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা’ ছাড়াও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’ গানটিও অনেকের পছন্দের তালিকায় ছিল।

তবে ওই গানটিকে দুটি কারণে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্বাচন করা হয়নি বলে জানান লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গানের একটি বিষয় ছিল যে এই গানে বাংলা বা বাংলাদেশ শব্দটি ছিল না। আরেকটি বিষয় ছিল যে এই গানের রেকর্ড সেসময় পাওয়া যায়নি।

কোন গানটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্ধারণ করা হবে, তার পেছনে গানের রেকর্ডের প্রাপ্যতা সেসময় একটি বড় কারণ ছিল বলে জানান মহিউদ্দিন আহমেদ।

কারণ গানের রেকর্ড না থাকলে ঠিক কোন সুরে এবং গানের কতটুকু জাতীয় সংগীত হিসেবে ব্যবহার করা হবে, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হওয়ার আশঙ্কা ছিল বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, সেসময় ধনধান্যে পুষ্পে ভরা গানের কোনো রেকর্ড আমাদের কাছে ছিল না। কিন্তু ১৯৭০ সালে জহির রায়হান ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রে আমার সোনার বাংলা গানটি ব্যবহার করায় সেটির একটি রেকর্ড ছিল আমাদের কাছে।

আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃত হওয়ার আগে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বহু আন্দোলন ও প্রতিবাদ কর্মসূচিতে ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি ব্যবহার হয়েছে বলে উঠে এসেছে বিভিন্ন প্রবন্ধ ও গবেষণাধর্মী লেখায়।

২০১৬ সালে অনলাইন পত্রিকা বাংলানিউজ টুয়েন্টিফোরে প্রকাশিত প্রাবন্ধিক মুহাম্মদ সবুর ‘আমার সোনার বাংলা যেভাবে জাতীয় সংগীত হলো’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, ১৯৫৩ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদ বায়ান্নর ভাষা শহীদদের স্মরণে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আবদুল লতিফের লেখা ও সুর করা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’র পাশাপাশি ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়া হয়।

সংগীতশিল্পী সনজীদা খাতুন, যিনি ২০২৫ সালের এপ্রিলে মারা গেছেন, তার প্রবন্ধ ‘রমনা বটমূল, ছায়ানট এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধ’তে লিখেছেন ১৯৫৬ সালে গণপরিষদের অধিবেশনে ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়ার জন্য শেখ মুজিবুর তাকে অনুরোধ করেছিলেন।

কার্জন হলে আয়োজিত ওই অধিবেশনে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন এবং ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি “বাঙালিদের কতখানি আবেগতাড়িত করে, সেটি বোঝানোর জন্য শেখ মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানিদের গানটি শোনাতে চেয়েছিলেন” বলে তার লেখায় উল্লেখ করেন সনজীদা খাতুন।

প্রবন্ধে সনজীদা খাতুন আরো লিখেছেন যে, ষাটের দশকে রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি চলা সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির বড় ভূমিকা ছিল।

সনজীদা খাতুন তার লেখায় উল্লেখ করেন, ১৯৬৭ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী বেতার ও টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার নিষিদ্ধ করার পর সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু করে সব সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। সেসময় সব সভা-সমাবেশে রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশন করা হয়, যার মধ্যে ‘আমার সোনার বাংলা’ ছিল অন্যতম।

ওই আন্দোলনের একজন সংগঠক, সংগীতজ্ঞ ওয়াহিদুল হকের বরাত দিয়ে সনজীদা খাতুন তার লেখায় লিখেছেন যে ‘সাতষট্টির আন্দোলনের সবচেয়ে স্থায়ী ফসল ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটির যথাযোগ্য প্রতিষ্ঠা।’

ষাটের দশকের সেই আন্দোলন চূড়ান্তভাবে পূর্ণতা পায় একাত্তরের এপ্রিলে, যখন ‘আমার সোনার বাংলা’কে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় সংগীতের স্বীকৃতি দেয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার।

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নীহার রঞ্জন চক্রবর্তী। ২০২০ সালে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, সেদিন নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর থেকে একদল গায়ককে আনা হয়েছিল ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়ার জন্য। শপথ গ্রহণের আনুষ্ঠানিকতা শেষে অস্থায়ী সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। তখন সেখানে প্রথমবারের মত সরকারিভাবে জাতীয় সংগীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলা’ পরিবেশন করে কৃষ্ণনগর থেকে আসা ওই গায়কদল।

পরে ১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি বাংলাদেশের মন্ত্রিসভার প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠকে ‘আমার সোনার বাংলা’র প্রথম দশ চরণ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্বাচিত হয়।

সূত্র : বিবিসি বাংলা।