হতাশায় আচ্ছন্ন বিএনপির নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নেতারা। তৃণমূল নেতৃত্বেও একই অবস্থা। হামলা-মামলা ও গ্রেফতারে জর্জরিত হওয়ার পাশাপাশি সরকারের নানামুখী চাপে দল ছাড়ার চিন্তাভাবনা করছেন অনেক হেভিওয়েট নেতা। ইতিমধ্যে ইউটিউবে ফাঁস হওয়া কয়েক নেতার ফোনালাপে হতাশার ছাপ পাওয়া গেছে। তৃণমূল পর্যায়ের অনেক নেতা-কর্মীও আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছেন। কেন্দ্রীয় পর্যায়ে অবশ্য এখনো পর্যন্ত বড় কোনো নেতা আওয়ামী লীগে যোগদান করেননি। তবে হতাশা, ক্ষোভ আর বঞ্চনা থেকে দলের স্থায়ী কমিটি, ভাইস চেয়ারম্যান, উপদেষ্টা পরিষদ, যুগ্ম মহাসচিব পর্যায়ের নেতাদের কেউ কেউ নিষ্ক্রিয় অবস্থায় রয়েছেন। গুলশান কার্যালয়ে খালেদা জিয়া অবরুদ্ধ হওয়ার পর থেকেই যোগাযোগ তারা বন্ধ করে দেন। এখনো তারা বেগম জিয়ার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করছেন না। তবে সরকারসহ বিভিন্ন মহলের সঙ্গেও তারা নতুনভাবে যোগাযোগ রাখছেন। সময় সুযোগে দলও ছেড়ে দিতে পারেন এসব নেতা। তারা শুধু সময়ের অপেক্ষা করছেন। দলীয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সূত্রমতে, ঈদের পর বিএনপি পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হলে বাদ পড়ার আশঙ্কা থেকেই যে কোনো সময় হেভিওয়েট নেতারা দল ছাড়তে পারেন। এই নেতারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া তাদের দল থেকে বাদ দেবেন-এমনটা নিশ্চিত হওয়ার অপেক্ষায় তারা। আভাস-ইঙ্গিত পেলে আগেভাগেই দল ছেড়ে দেবেন। এদের কেউ কেউ অন্য দলে ঢুকতে পারেন। কেউ কেউ নিতে পারেন রাজনীতি থেকে অবসর।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গত মঙ্গলবার রাতে গুলশানে নোয়াখালী জেলা আইনজীবী সমিতির নেতাদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় বলেন, ‘বিএনপি শেষ হয়ে যায়নি। বিএনপি আছে, থাকবে। বিএনপি কখনো ভাঙবে না। শুধু সময়ের অপেক্ষায় আছি। বিএনপি একটি শক্তিশালী দল ছিল, আছে এবং থাকবে। এ দলে কোনো বিভেদ নেই। দল সচল রাখার জন্য যে কোনো সময় পুনর্গঠন করা যায়। অনেকের বয়স হয়ে গেছে, অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, এখন আমরা পুনর্গঠন করছি।’ সম্প্রতি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে প্রধান অতিথি করা হয় বিকল্পধারার প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে। তিনি সেখানে বিএনপির সমালোচনা করে যে বক্তব্য দেন, তা নিয়েও দলের ভিতরে-বাইরে নানা সন্দেহের সৃষ্টি হয়। এরপর ক্রমাগতভাবে বিএনপি-জামায়াতের জোট নিয়েও সমালোচনা করেন তিনি। তার এ বক্তব্য বিএনপির একটি অংশ সমর্থনও করছে। সরকারের পক্ষ থেকেও সাধুবাদ জানানো হচ্ছে। বি চৌধুরীর সঙ্গে এখন নিয়মিত যোগাযোগও রাখছেন বিএনপির বেশ কয়েকজন সিনিয়র ও মধ্যমসারির নেতা। বি চৌধুরীর বক্তব্য ও হঠাৎ করে বিএনপির একটি অংশের যোগাযোগ বৃদ্ধি করা-কোনো পরিকল্পনার অংশ কি না তাও পর্যবেক্ষণ করছেন বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। বিএনপির নীতিনির্ধারক পর্যায়ের এক নেতা বলেন, জিয়ার আদর্শের কথা বলে বি চৌধুরীর নেতৃত্বে বিএনপির একটি অংশ আলাদা হয়ে যেতে পারে। তার বক্তৃতা-বিবৃতিতে এমন আভাসই পাওয়া যাচ্ছে। খালেদা জিয়া এখন কী করেন-সেটাই দেখার বিষয়। শক্ত হাতে লাগাম টেনে না ধরতে পারলে বিএনপির ভাঙন কেউ ঠেকাতে পারবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এদিকে ‘সংস্কারপন্থি’ অভিযোগে বিএনপির অন্তত অর্ধশতাধিক সাবেক সংসদ সদস্য ও নেতা কোণঠাসা হয়ে রয়েছেন। তাদেরও রয়েছে ভিন্ন প্লাটফর্ম করার চিন্তাভাবনা। ইতিমধ্যে তারা কয়েকদফা বৈঠকও করেছেন। বিএনপির বর্তমান নেতৃত্বের একটি অংশের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছেন তারা। ওই ফোরামের এক নেতা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, বিএনপির বর্তমান কমিটির একটি অংশের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে তাদের। সময় সুযোগ এলে তাদের নিয়েই আমরা জিয়ার আদর্শে নতুন দল গঠন করব। এর বাইরেও বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার নাজমুল হুদাসহ বিএনপি ছেড়ে দেওয়া একাধিক নেতার সঙ্গেও দলের কোনো কোনো নেতা যোগাযোগ রাখছেন।
দলীয় সূত্র জানায়, বিএনপি প্রধানও চান দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ও বয়োবৃদ্ধ নেতারা স্বেচ্ছায় দল ছেড়ে দিন। তাছাড়া দুর্নীতিসহ নানা কারণে বিতর্কিত নেতাদের প্রতি অনীহাও রয়েছে বেগম জিয়ার। সরকারবিরোধী বিগত আন্দোলনে যারা রাজপথে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেননি-তাদেরও তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। ঈদের পর দল পুনর্গঠনে হাত দিলে ওইসব নেতাদের ভাগ্য বিপর্যস্ত হতে পারে। তাই অনেকে আগেভাগেই দল ছাড়তে পারেন। তারা নতুন কোনো দল করে বিএনপিকে বেকায়দায় ফেলবেন কি না-তারও খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইউটিউবে ফাঁস হওয়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির তিন সদস্যের আলাপচারিতায় দল নিয়ে তাদের হতাশা ফুটে উঠেছে। নতুন কোনো ঝামেলায় না গিয়ে কেন্দ্রীয় অনেক নেতাই দল ছেড়ে নিরিবিলি জীবনযাপন করতে আগ্রহী। সম্পদ রক্ষা আর সরকারের বিরাগভাজন না হওয়ার জন্যই এ ধরনের চিন্তাভাবনা। আবার কেউ কেউ বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের আদর্শে নতুন দলও করতে চান। অবশ্য এতে সরকারসহ বিভিন্ন সংস্থার মদদ রয়েছে বিএনপি অভিযোগ করেছে। সর্বশেষ স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান আড়াইহাজারের এক নেতার কথোপকথন ইউটিউবে ফাঁস হয়। এ সময় তিনি আলাপকালে দল ছেড়ে নিরিবিলিভাবে বসবাস করার কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে নিরিবিলি জীবনযাপন করার চিন্তা করছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিএনপি এখন যে অবস্থায় দাঁড়িয়েছে, তাতে ভবিষ্যতে উঠে দাঁড়াতে পারবে কি না সন্দেহ আছে। উনি (খালেদা জিয়া) যে অবস্থায় পতিত হয়েছেন, সেখান থেকে উঠতে পারবেন কি না-মানুষ সন্দেহ প্রকাশ করছে।’ জানা যায়, সিনিয়র নেতাদের ফাঁস হওয়া কথাবার্তায় বিব্রত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের মধ্যে প্রশ্ন জাগছে, দলের দুঃসময়ে শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা এ ধরনের মন্তব্য করলে দলের সামনে কী অপেক্ষা করছে? স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দল এখন জিয়ার আদর্শ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। শারীরিক সক্ষমতাসহ নানা কারণে বেগম জিয়াও হয়তো আর বেশিদিন রাজনীতি করতে পারবেন না। আমরা জিয়ার সঙ্গে রাজনীতি করেছি, এখন তার সহধর্মিণীর সঙ্গেও আছি। এরপর হয়তো আর রাজনীতি করা সম্ভব হবে না। তাই আগেভাগেই অবসর নেওয়ার কথা ভাবছি।’