রাম চন্দ্র রায়
অধ্যক্ষ, গুরুদয়াল সরকারি কলেজ
শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ কলেজের সবার আন্তরিক প্রয়াসে কলেজটি উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলেছে। প্রতিবছর এই কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ছাত্রছাত্রী মেডিকেল, প্রকৌশল ও অন্যান্য স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে জায়গা করে নিচ্ছে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর অনেক ছাত্রছাত্রী বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসে, কেউ কেউ উচ্চতর গবেষণা কিংবা অন্যান্য চাকরিতে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে কলেজের সুনাম ছড়িয়ে দিচ্ছে।ছোটবেলা থেকে স্বপ্ন দেখেছেন, বড় হয়ে কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজে পড়বেন। কেন? ‘স্কুলে পড়ার সময় থেকেই কলেজে আসা-যাওয়া ছিল। গুরুদয়াল কলেজে পড়ালেখা ভালো হয়, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডও হয়। তাই আমার মাথায় আসলে দ্বিতীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল না।’ এখন রিফাত এই কলেজের স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। পড়ছেন বাংলা বিভাগে।
গুরুদয়াল কলেজের কী আপনার সবচেয়ে ভালো লাগে? এমন প্রশ্নে রিফাত কোনো ‘সহজ’ উত্তর খুঁজে পান না। ভাবেন আর ভাবেন। একসময় হাল ছেড়ে দিয়ে বলেন, ‘একটা কথা আছে না, যাকে আপনি ভালোবাসেন…কেন ভালোবাসেন সেটা বলতে পারেন না, আমার কাছে ক্যাম্পাসটাও এমন। প্রায় প্রতিদিন আসি, ক্লাস করি। ক্যাম্পাসের সঙ্গে অনেক মায়া জড়িয়ে গেছে।’
মায়াময় প্রাঙ্গণ
নরসুন্দা নদীর তীরঘেঁষে কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজ। সকালে ভিড় করে উচ্চমাধ্যমিকে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। দুপুর থেকে শুরু হয় স্নাতকে পড়ুয়াদের আনাগোনা। আর বিকেলে তো কলেজ প্রাঙ্গণ পুরো এলাকার মানুষের কাছেই ‘বেড়ানোর জায়গা’ হয়ে ওঠে। বিশাল মাঠ, নির্মাণাধীন সেতু, ওয়াচ টাওয়ার, মুক্তমঞ্চ—সব মিলিয়ে পরিবেশটা খুব সুন্দর।
হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র মশিউর রহমানের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বোঝা গেল, সুন্দর পরিবেশের আরেকটা কারণ। কলেজেরই ছাত্রাবাসে থাকেন তিনি। বলছিলেন, ‘আমাদের এখানকার সবচেয়ে ভালো দিক হলো, রাজনৈতিক অস্থিরতা নেই।’ মশিউর জানালেন, কদিন পর ফাইনাল পরীক্ষা। স্নাতক শেষ করে তিনি বিসিএস পরীক্ষা দিতে চান। ব্যাংকে চাকরির জন্যও চেষ্টা করবেন। বললেন, ‘শিক্ষকেরা আমাদের যেভাবে পড়িয়েছেন, আত্মবিশ্বাস আছে, নিজেকে একটা ভালো অবস্থানে নিয়ে যেতে পারব।’
কলেজের পাশেই বাঁধানো পুকুর, মুক্তমঞ্চ দর্শণার্থীদের নজর কাড়ে
হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী জান্নাতুন নাঈম, ডাকনাম পিংকী। তিনি কলেজের পরিচিত মুখ। কলেজের সব অনুষ্ঠানেই গান গাওয়ার জন্য তাঁর ডাক পড়ে। শিক্ষার্থীরাও ‘পিংকী আপুর’ গান শোনার অপেক্ষায় থাকেন। জান্নাতুন নাঈম বলছিলেন, ‘আশপাশের এলাকার ক্ষেত্রে শুনি, কলেজে যেতে-আসতে মেয়েদের নানা রকম সমস্যা হয়। আমাদের এখানে এমনটা কখনো হয়নি। অন্তত আমি দেখিনি। ২০১৫ সালে কলেজে শিক্ষা সপ্তাহ প্রতিযোগিতা হয়েছিল। রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, দেশাত্মবোধক গান—তিনটি শাখায়ই আমি চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। সেটা ছিল আমার জীবনের সেরা দিন।’ ক্যাম্পাসের দিনগুলো এভাবে সব শিক্ষার্থীকেই কোনো না কোনো ‘সেরা দিন’ উপহার দিয়েছে।
যদিও প্রাপ্তির ভিড়ে কিছু অপ্রাপ্তিও আছে শিক্ষার্থীদের। প্রায় ২২ হাজার ছাত্রছাত্রীর কলেজে শিক্ষকের সংখ্যা মাত্র ৮৫ জন। শ্রেণিকক্ষ, গবেষণাগার আর শিক্ষার্থীদের আবাসন নিয়েও নানা সমস্যা রয়েছে। অধ্যক্ষ রামচন্দ্র রায় জানালেন, সমস্যাগুলোর ব্যাপারে তাঁরা অবগত আছেন। সরকারি সহায়তায় এসব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে।
রাষ্ট্রপতির কলেজ
ইটনা উপজেলার ধনপুর ইউনিয়নের কাটৈর গ্রামের জমিদার ছিলেন গুরুদয়াল সরকার। ১৯৪৫ সালে তাঁর দেওয়া ৫০ হাজার টাকা অনুদানেই গড়ে উঠেছিল কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক এই শিক্ষাঙ্গন। দেখতে দেখতে ৭১ বছর পেরিয়েছে। গত দিনগুলোতে বহু কৃতী শিক্ষার্থী পাস করে বেরিয়ে গেছেন এই প্রতিষ্ঠান থেকে।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এই কলেজেরই ছাত্র ছিলেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদও গুরুদয়াল কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পড়েছেন। এ ছাড়া সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ. মান্নান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আলাউদ্দিন আহমেদ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য দুর্গাদাস ভট্টাচার্য, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মো. সিরাজুল ইসলাম বীর বিক্রম—এই কলেজেরই ছাত্র ছিলেন।
সম্প্রতি গুরুদয়াল কলেজে একটি তিন তলা একাডেমিক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। সাবেক কৃতী ছাত্র, রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের নামেই এই ভবনের নামকরণ করা হয়েছে। কলেজের দুই সাবেক ছাত্র দেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। বর্তমান শিক্ষার্থীরা কি ভবিষ্যতে দেশের হাল ধরার স্বপ্ন দেখেন? প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল কলেজের প্রচিত সাংস্কৃতিক পরিবারের সভাপতি আব্দুল্লাহ আল–বাকীর কাছে। তিনি বলছিলেন, ‘রাষ্ট্রপতি হওয়া অনেক বড় ব্যাপার। সেভাবে হয়তো ভাবি না। কিন্তু রাষ্ট্রপতি তো দেশের জন্যই কাজ করেন। দেশের জন্য কিছু করার স্বপ্ন আমরা সবাই দেখি। আমাদের সংগঠনের কথাই ধরুন, আমরা বাংলাদেশের আঞ্চলিক গান-কবিতা দেশের মানুষের সামনে তুলে ধরতে চেষ্টা করি। ভবিষ্যতেও এ নিয়ে কাজ করে যাব।’