রমজানকে পুঁজি করে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী সব কিছুর দাম বাড়িয়ে দিয়ে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করেন। তবে এবার একটু ব্যতিক্রম। অন্তর্বর্তী সরকারের নানামুখী চেষ্টায় এবার রমজানে বিদ্যুৎ ও নিত্যপণ্যের বাজারে স্বস্তি এসেছে। অন্য বছর রমজানে চরম লোডশেডিং হলেও এবার এখন পর্যন্ত বিদ্যুতে স্বস্তি আছে। ঢাকার পাশাপাশি গ্রামেও তুলনামূলক কম হচ্ছে লোডশেডিং। অন্য বছরের তুলনায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর দামও সহনীয়। রমজানে ইফতারসামগ্রীর বাজারেও তেমন বাড়াবাড়ি নেই। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সমন্বিত তদারকি জোরদার করায় সবজির বাজার সিন্ডিকেট কাঁচা মরিচ ও বেগুনের দাম বাড়াতে পারেনি। বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেছেন, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ায় এবার রমজানে বাজারে পণ্যের দাম সহনীয়। অপরদিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা বলেছেন, রমজান শুরুর আগে সঠিক চাহিদা নির্ধারণ করে সে অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জ্বালানি সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে। এর সুফল পাচ্ছে দেশের মানুষ।
রমজানের প্রথম ২০ দিনের হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা যায়-সেহরি, তারাবি ও ইফতারের সময় এখন পর্যন্ত ঢাকায় লোডশেডিং করা হয়নি। তবে কোনো কোনো এলাকায় বৈদ্যুতিক ত্রুটিজনিত কারণে সাময়িক বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটে। ঢাকার বাইরে লোডশেডিং থাকলেও রমজানে আগের মতো ১০-১২ ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন অবস্থা কোথাও ছিল না। বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, গত কয়েক বছর রমজানে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়নি। এ কারণে রোজার মাসে সেহরি, তারাবি ও ইফতারের সময় লোডশেডিংয়ে ভুগতে হয়েছিল মানুষকে। ঈদের কেনাকাটার সময়ও মার্কেটগুলোতে বিদ্যুৎবিহীন তীব্র গরমের মধ্যে কেনাকাটা করতে হয়েছিল। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) হিসাব অনুযায়ী, রমজানে বিদ্যুতের ব্যবহার ২ থেকে ৩ হাজার মেগাওয়াটের মতো বেড়েছে। এর ফলে পিক আওয়ারে বর্তমান চাহিদা ১১ হাজার ৮০৮ মেগাওয়াট থেকে বেড়ে প্রায় ১৪ থেকে ১৫ হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছেছে। এ চাহিদা সামাল দিতে সরকারকে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন স্তরের কাছাকাছি যেতে হয়েছে। ২০২৪ সালের ৩০ এপ্রিল বাংলাদেশ রেকর্ড-সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছিল। এ লক্ষ্য অর্জনে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় প্রাথমিক জ্বালানি আমদানির জন্য অর্থ বিভাগের কাছে ৮ হাজার কোটি টাকা চায়।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা ড. ফাওজুল কবির খান যুগান্তরকে বলেন, রমজান শুরু হওয়ার আগে চাহিদা নিরূপণ করে সে অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জ্বালানি সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে। রজমান উপলক্ষ্যে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে। ৯শ এমএমসিএফডি গ্যাসের পরিবর্তে ১২শ এমএমসিএফডি গ্যাস আমদানি বাড়ানোর জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে ভর্তুকি চাওয়া হয়েছিল। সে অনুযায়ী দ্রুত অর্থ বরাদ্দ পাওয়া গেছে।
তিনি বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি গ্যাস, কয়লা ক্রয়ে ডলার সংস্থান ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর বাৎসরিক মেইনটেন্যান্স সম্পন্ন করা হয়েছে। এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানি বাড়ানো এবং এয়ারকন্ডিশনার ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে।
এদিকে পণ্যের বাজারে সাধারণ মানুষের স্বস্তির বিষয়টি এ সরকারের ভালো উদ্যোগের ফল বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। নভেম্বরে প্রতি কেজি ছোলা ১১০ টাকায় বিক্রি হয়। গত বছর রোজার আগে একই সময়ে প্রতি কেজি ছোলা বিক্রি হয় ১৩০ টাকা কেজি দরে। এবার প্রতি কেজি মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ১১০-১৪০ টাকায়। মসুর ডাল গত বছর একই সময় একই দামে বিক্রি হয়। প্রতি কেজি চিনি এবার বিক্রি হচ্ছে ১২০-১২৫ টাকায়। যা গত বছর রোজার আগে বিক্রি হয়েছিল কেজিপ্রতি ১৩০ টাকা। এবার রমজানজুড়ে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৪০-৪৫ টাকা। প্রতি কেজি আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৬০-৬৫ টাকা।
গত বছর রোজার আগে বিক্রি হয়েছিল ১১০-১২০ টাকা। প্রতি কেজি দেশি রসুন বিক্রি হচ্ছে ১৪০-২৪০ টাকা। যা আগে কেজিপ্রতি বিক্রি হয়েছে ২৫০ টাকা। দেশি হলুদ বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৩৫০ টাকা। যা গত বছর একই সময় ৩৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। দেশি আদা প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকা। গত বছর রোজার আগে কেজিপ্রতি ২৮০ টাকা ছিল। জিরা প্রতি কেজি ৭৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত রোজায় বিক্রি হয়েছে ৯৫০ টাকা। দারুচিনি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি সর্বোচ্চ ৬৮০ টাকা। যা আগে ৬৫০ টাকা ছিল। ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি ১৮০-১৯০ টাকা, সোনালি ৩০০-৩১০ টাকা ও দেশি মুরগি ৫৫০-৫৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে-যা গত বছরের তুলনায় ১০-৩০ টাকা কম।
রোববার রাজধানীর সর্ববৃহৎ পাইকারি আড়ত বাদামতলী ঘুরে ও আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৫ কেজি প্যাকেটজাত আজওয়া খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৪৫০০ টাকা। গত বছর রোজার আগে বিক্রি হয়েছে ৭৫০০ টাকা। কালমি খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৩৫০০ টাকা। যা আগে ৪০০০ টাকা ছিল। পাশাপাশি দাবাস খেজুর বিক্রি হচ্ছে ২০০০ টাকা। গত বছর রোজার আগে ৪৫০০ টাকা ছিল। মরিয়ম খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৫০০০ টাকা। যা গত বছর রোজার আগে ৫০০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন জানান, রমজানে পণ্যের দাম নিম্নমুখী আছে। পাশাপাশি রমজানে খাদ্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল থেকেও নিম্নগামী থাকবে। খেজুর, ছোলা, ডালসহ এ সময় প্রয়োজনীয় সব পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক আছে। কারসাজি করে পণ্যের দাম বাড়ানোর কৌশল নেওয়া হলে অপরাধী ব্যবসায়ীকে শাস্তির আওতায় আনা হবে।
বিদ্যুৎ খরচ ব্যবস্থাপনা : সরকার অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ খরচ কমাতে চাহিদা-নির্ভর ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দিচ্ছে। দেশের এয়ারকন্ডিশনারগুলো (এসি) প্রায় চার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবহার করে।
কর্মকর্তাদের ধারণা, এসির তাপমাত্রা ২৫-২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নির্ধারণ করলে কমপক্ষে দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় সম্ভব। এসি ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আরোপের বিষয়ে উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেন, বিদ্যুৎ বিভাগ বিভিন্ন খাতকে আনুষ্ঠানিকভাবে এ নির্দেশনা জানিয়েছে। বাণিজ্য উপদেষ্টা বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ধর্মবিষয়ক উপদেষ্টা মসজিদের ইমামদের অনুরোধ, আর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব সচিবালয়সহ অন্য সরকারি দপ্তরগুলোতে এ নীতি কার্যকর করেন।
নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় রাখতে উদ্যোগ : রোজায় অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের স্থানীয় বাজার মূল্য ও সরবরাহ স্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। এসব বাস্তবায়ন হওয়ায় বাজারে ভোজ্যতেল বাদে অন্যান্য পণ্যের দাম স্থিতিশীল আছে। এর মধ্যে স্থানীয় বাজারে পরিশোধিত চিনির সরবরাহ বৃদ্ধিতে পরিশোধিত চিনি আমদানিতে শুল্ক কমাতে কমিশনের পক্ষ থেকে সুপারিশ করা হয়।
বাজারে তদারকি জোরদার : এদিকে এবার রোজায় পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে সরকারের একাধিক সংস্থা মাঠে আছে। সংস্থাগুলো হলো-বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেল, র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি), কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মনিটরিং টিম। এছাড়া নিত্যপণ্যের বাজারে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারিও করা হচ্ছে।