ঢাকা ০৯:২৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

তেঁতুলিয়ায় ক্ষোভ বাড়ছে চা-চাষিদের

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:৪৯:০২ অপরাহ্ন, বুধবার, ১২ অক্টোবর ২০১৬
  • ৩১৭ বার

সবুজ চা আবাদে পার্বত্য অঞ্চল ও সিলেটের পর তৃতীয় চা অঞ্চল হিসেবে পরিচিত দেশের সর্ব-উত্তরের জেলা পঞ্চগড়। এখানকার চা-বাগানের একটা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হলো, প্রান্তিক পর্যায়ে কৃষকদের ছোট ছোট চা-বাগানও আছে এখানে। কৃষকদের বড় একটা অংশ এখন চা আবাদে জড়িত।

গত কয়েক দশকে দ্রুত বিস্তার লাভ করা তেঁতুলিয়ার চা অর্গানিক তথা আন্তর্জাতিক মানের হওয়ায় ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করেছে ইতিমধ্যে তা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, তেঁতুলিয়ায় ১ হাজার ২৯০ হেক্টরের বেশি জমিতে এখন চাষ হচ্ছে সবুজ চা।

কিন্তু অভিযোগ উঠছে, চা-বাগানকে ঘিরে গড়ে ওঠা চা-কারখানাগুলো স্বেচ্ছাচারিতা করছে চা-চাষিদের সঙ্গে। ফলে বিপাকে পড়েছেন চা-চাষিরা, যার প্রভাব পঞ্চগড়ের চা-শিল্পকে হুমকির মুখে ফেলছে।

চাষিদের অভিযোগ, কারখানাগুলোর সিন্ডিকেটের কারণে ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না তাদের বাগান থেকে আহরিত চা-পাতার। শুধু তা-ই নয়, কারখানায় বিক্রির জন্য নিয়ে যাওয়া পাতা ওজনের সময় শতকরা ৩০-৪০ এমনকি কখনো ৭০ শতাংশ কেটে মাত্র ৩০ শতাংশের দাম দিচ্ছে কারখানাগুলো। ফলে বাধ্য হয়ে পানির দামে বিক্রি করতে হচ্ছে কৃষকদের এই সবুজ চা-পাতা। এতে ক্ষোভ সৃষ্টি হওয়ার পাশাপাশি চা আবাদে অনাগ্রহ সৃষ্টি হচ্ছে চাষিদের মধ্যে।

১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে প্রথম এ এলাকায় টিটিসিএল নামের একটি কোম্পানি ক্ষুদ্র পরিসরে শুরু করে সবুজ চা আবাদ। এরপর রওশনপুরে কাজী অ্যান্ড কাজী টি এসেস্ট লিমিটেড বৃহৎকারে অর্গানিক পদ্ধতিতে সবুজ চা আবাদের সুবাদে উপজেলায় বেশি কিছু চা-বাগান গড়ে তোলে। উত্তরের এই চা বিপ্লবে সিলেট ও চট্টগ্রামের চা-কারখানার মালিকরাও জমি কিনে চা চাষ শুরু করে।

এ বিপ্লবের দিকে ঝুঁকে পড়ে সাধারণ কৃষকরাও। ধান, পাট, আখ, ভুট্টা, গমসহ অন্যান্য অর্থকরী ফসলের পাশাপাশি চা চাষের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন তারা। গড়ে ওঠে ব্যক্তি উদ্যোগে ছোট-বড় চা-বাগান। তেঁতুলিয়ায় ক্ষুদ্র চা-বাগানের সংখ্যা হাজারের বেশি। রয়েছে বিভিন্ন কোম্পানির ১১টি বড় চা-বাগান। এসব বাগানের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে এখানে চা কারখানা। টিটিসিএল চা কারখানা, গ্রীণ এগ্রো কেয়ার চা কারখানা, করতোয়া চা কারখানা, নর্থ বেঙ্গল কারখানা ও ভজনপুর ফিলিং স্টেশনের মালিক আব্দুল জব্বারের চা কারখানা উল্লেখযোগ্য।

সমতল ভূমিতে কৃষকদের এই চা চাষে বিপ্লবে অর্থনৈতিক নতুন মোড় নিলেও ভাগ্য বদল হয়নি কৃষকদের। তারা চা চাষে আগ্রহী হলেও চা বিক্রি করতে পারছে না ন্যায্য দামে। প্রতি কেজি চা-পাতা ধরনভেদে ১৮ থেকে ২৬ টাকা হলেও প্রতি ১০০ কেজিতে কারখানা কর্মকর্তাদের হাতে কাটা যাচ্ছে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ এমনকি ৭০ শতাংশ পাতা। ফলে হয় পানির দরে বিক্রি করতে হচ্ছে, নতুবা ফিরিয়ে আনতে হয় পাতা। একদিকে কর্তন, অবিক্রীত পাতা নষ্ট, অন্যদিকে ন্যায্যমূল্য না পেয়ে বিপাকে পড়েছেন উত্তরের এসব প্রান্তিক চা-চাষী।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, অনেক ক্ষুদ্র চা-চাষি নিজের সর্বস্ব বিনিয়োগ আর অনেক আশা নিয়ে গড়ে তুলেছেন একটি স্বপ্নের চায়ের বাগান। কিন্তু সঠিক সময়ে ন্যায্য মূল্যে পাতা বিক্রি করতে না পেরে স্বপ্নভঙ্গের হাহাকার করতে দেখা গেছে এসব ক্ষুদ্র চাষিকে।

চাষিরা বলছেন, এর পেছনে রয়েছে কারখানা মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম, দুর্নীতি। গত কয়েক মাস ধরেই চলছে কৃষকদের প্রতি কারখানা মালিকদের নানান হয়রানি।

গত ২৯ সেপ্টেম্বর গ্রীন কেয়ার এগ্রো লিমিটেড নামের এক চা কারখানায় ঘটেছে এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা। দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে সিরিয়াল না পেয়ে এবং ওজনে ৪০ শতাংশ কর্তনের প্রতিবাদ করায় এক চা-চাষিকে নানাভাবে হুমকি দেওয়া হয়। এতে চাষিরা উত্তেজিত হয়ে কারখানার ম্যানেজার শামসুদ্দোহাকে লাঞ্ছিত করেন। পরে ঘটনাস্থলে পুলিশ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মধ্যস্থতায় বিষয়টির নিরসন হয়।

চাষিরা বলছেন, এ রকম অভিযোগ প্রায় সব কয়টি কারখানার বিরুদ্ধে। নিরুপায় চাষিরা ফ্যাক্টরির কাছে জিম্মি। কখনো বা সিন্ডিকেট করে মালিকরা কারখানা বন্ধ করে দেন কোনো নোটিশ ছাড়াই। গত বৃহস্পতিবার উপজেলার কিছু চা-চাষিকে কারখানার প্রতি বিক্ষুব্ধ হতে দেখা যায়।

এ বিষয়ে টি কোম্পানি টিটিসিএলের ম্যানেজার মনজু বলেন, ‘আমরা প্রধানত নিজের বাগান থেকে পাতা সংগ্রহ করি। আর বাইরে থেকে পাতা কিনলে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ কর্তন করি। তবে ধারণক্ষমতার বাইরে পাতা নিতে না পারলে সৃষ্ট সমস্যার জন্য আমরা দায়ী নই।’

সমস্যা নিরসনে সরকারি-বেসরকারি কর্তৃপক্ষকে এগিয়ে আসার দাবি জানিয়েছেন চাষিরা। নাহলে সিন্ডিকেট আর কারখানা মালিকদের কাছে জিম্মি দশার কারণে অনাগ্রহী হয়ে পড়বেন চা চাষীরা।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

তেঁতুলিয়ায় ক্ষোভ বাড়ছে চা-চাষিদের

আপডেট টাইম : ১১:৪৯:০২ অপরাহ্ন, বুধবার, ১২ অক্টোবর ২০১৬

সবুজ চা আবাদে পার্বত্য অঞ্চল ও সিলেটের পর তৃতীয় চা অঞ্চল হিসেবে পরিচিত দেশের সর্ব-উত্তরের জেলা পঞ্চগড়। এখানকার চা-বাগানের একটা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হলো, প্রান্তিক পর্যায়ে কৃষকদের ছোট ছোট চা-বাগানও আছে এখানে। কৃষকদের বড় একটা অংশ এখন চা আবাদে জড়িত।

গত কয়েক দশকে দ্রুত বিস্তার লাভ করা তেঁতুলিয়ার চা অর্গানিক তথা আন্তর্জাতিক মানের হওয়ায় ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করেছে ইতিমধ্যে তা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, তেঁতুলিয়ায় ১ হাজার ২৯০ হেক্টরের বেশি জমিতে এখন চাষ হচ্ছে সবুজ চা।

কিন্তু অভিযোগ উঠছে, চা-বাগানকে ঘিরে গড়ে ওঠা চা-কারখানাগুলো স্বেচ্ছাচারিতা করছে চা-চাষিদের সঙ্গে। ফলে বিপাকে পড়েছেন চা-চাষিরা, যার প্রভাব পঞ্চগড়ের চা-শিল্পকে হুমকির মুখে ফেলছে।

চাষিদের অভিযোগ, কারখানাগুলোর সিন্ডিকেটের কারণে ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না তাদের বাগান থেকে আহরিত চা-পাতার। শুধু তা-ই নয়, কারখানায় বিক্রির জন্য নিয়ে যাওয়া পাতা ওজনের সময় শতকরা ৩০-৪০ এমনকি কখনো ৭০ শতাংশ কেটে মাত্র ৩০ শতাংশের দাম দিচ্ছে কারখানাগুলো। ফলে বাধ্য হয়ে পানির দামে বিক্রি করতে হচ্ছে কৃষকদের এই সবুজ চা-পাতা। এতে ক্ষোভ সৃষ্টি হওয়ার পাশাপাশি চা আবাদে অনাগ্রহ সৃষ্টি হচ্ছে চাষিদের মধ্যে।

১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে প্রথম এ এলাকায় টিটিসিএল নামের একটি কোম্পানি ক্ষুদ্র পরিসরে শুরু করে সবুজ চা আবাদ। এরপর রওশনপুরে কাজী অ্যান্ড কাজী টি এসেস্ট লিমিটেড বৃহৎকারে অর্গানিক পদ্ধতিতে সবুজ চা আবাদের সুবাদে উপজেলায় বেশি কিছু চা-বাগান গড়ে তোলে। উত্তরের এই চা বিপ্লবে সিলেট ও চট্টগ্রামের চা-কারখানার মালিকরাও জমি কিনে চা চাষ শুরু করে।

এ বিপ্লবের দিকে ঝুঁকে পড়ে সাধারণ কৃষকরাও। ধান, পাট, আখ, ভুট্টা, গমসহ অন্যান্য অর্থকরী ফসলের পাশাপাশি চা চাষের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন তারা। গড়ে ওঠে ব্যক্তি উদ্যোগে ছোট-বড় চা-বাগান। তেঁতুলিয়ায় ক্ষুদ্র চা-বাগানের সংখ্যা হাজারের বেশি। রয়েছে বিভিন্ন কোম্পানির ১১টি বড় চা-বাগান। এসব বাগানের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে এখানে চা কারখানা। টিটিসিএল চা কারখানা, গ্রীণ এগ্রো কেয়ার চা কারখানা, করতোয়া চা কারখানা, নর্থ বেঙ্গল কারখানা ও ভজনপুর ফিলিং স্টেশনের মালিক আব্দুল জব্বারের চা কারখানা উল্লেখযোগ্য।

সমতল ভূমিতে কৃষকদের এই চা চাষে বিপ্লবে অর্থনৈতিক নতুন মোড় নিলেও ভাগ্য বদল হয়নি কৃষকদের। তারা চা চাষে আগ্রহী হলেও চা বিক্রি করতে পারছে না ন্যায্য দামে। প্রতি কেজি চা-পাতা ধরনভেদে ১৮ থেকে ২৬ টাকা হলেও প্রতি ১০০ কেজিতে কারখানা কর্মকর্তাদের হাতে কাটা যাচ্ছে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ এমনকি ৭০ শতাংশ পাতা। ফলে হয় পানির দরে বিক্রি করতে হচ্ছে, নতুবা ফিরিয়ে আনতে হয় পাতা। একদিকে কর্তন, অবিক্রীত পাতা নষ্ট, অন্যদিকে ন্যায্যমূল্য না পেয়ে বিপাকে পড়েছেন উত্তরের এসব প্রান্তিক চা-চাষী।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, অনেক ক্ষুদ্র চা-চাষি নিজের সর্বস্ব বিনিয়োগ আর অনেক আশা নিয়ে গড়ে তুলেছেন একটি স্বপ্নের চায়ের বাগান। কিন্তু সঠিক সময়ে ন্যায্য মূল্যে পাতা বিক্রি করতে না পেরে স্বপ্নভঙ্গের হাহাকার করতে দেখা গেছে এসব ক্ষুদ্র চাষিকে।

চাষিরা বলছেন, এর পেছনে রয়েছে কারখানা মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়ম, দুর্নীতি। গত কয়েক মাস ধরেই চলছে কৃষকদের প্রতি কারখানা মালিকদের নানান হয়রানি।

গত ২৯ সেপ্টেম্বর গ্রীন কেয়ার এগ্রো লিমিটেড নামের এক চা কারখানায় ঘটেছে এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা। দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে সিরিয়াল না পেয়ে এবং ওজনে ৪০ শতাংশ কর্তনের প্রতিবাদ করায় এক চা-চাষিকে নানাভাবে হুমকি দেওয়া হয়। এতে চাষিরা উত্তেজিত হয়ে কারখানার ম্যানেজার শামসুদ্দোহাকে লাঞ্ছিত করেন। পরে ঘটনাস্থলে পুলিশ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মধ্যস্থতায় বিষয়টির নিরসন হয়।

চাষিরা বলছেন, এ রকম অভিযোগ প্রায় সব কয়টি কারখানার বিরুদ্ধে। নিরুপায় চাষিরা ফ্যাক্টরির কাছে জিম্মি। কখনো বা সিন্ডিকেট করে মালিকরা কারখানা বন্ধ করে দেন কোনো নোটিশ ছাড়াই। গত বৃহস্পতিবার উপজেলার কিছু চা-চাষিকে কারখানার প্রতি বিক্ষুব্ধ হতে দেখা যায়।

এ বিষয়ে টি কোম্পানি টিটিসিএলের ম্যানেজার মনজু বলেন, ‘আমরা প্রধানত নিজের বাগান থেকে পাতা সংগ্রহ করি। আর বাইরে থেকে পাতা কিনলে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ কর্তন করি। তবে ধারণক্ষমতার বাইরে পাতা নিতে না পারলে সৃষ্ট সমস্যার জন্য আমরা দায়ী নই।’

সমস্যা নিরসনে সরকারি-বেসরকারি কর্তৃপক্ষকে এগিয়ে আসার দাবি জানিয়েছেন চাষিরা। নাহলে সিন্ডিকেট আর কারখানা মালিকদের কাছে জিম্মি দশার কারণে অনাগ্রহী হয়ে পড়বেন চা চাষীরা।