নরেন্দ্র মোদি এবং বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক! হায়দার আকবর খান রনো

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরকে কেন্দ্র করে ঢাকায় যে রকম সাজসাজ রব, উচ্ছ্বাস ও কৌতূহল দেখা গেছে, এর আগে অন্য কোনো বিদেশি অতিথি নিয়ে কখনো তা দেখা যায়নি। স্বাধীনতার পরপরই ইন্দিরা গান্ধীর সফরের কথাটি অবশ্য ভিন্ন। সদ্য স্বাধীনতা পেয়েছি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অসামান্য অবদান, ইন্দিরা গান্ধীর ব্যক্তিগত ভূমিকা- সব মিলিয়ে সেটি ছিল সত্যিকার অর্থেই এক ঐতিহাসিক সময়। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নরেন্দ্র মোদির ঢাকা আগমনকে ঐতিহাসিক মুহূর্ত বলেছেন। ঐতিহাসিক তো বটেই, তবে কতটা তাৎপর্যপূর্ণ ছিল এই সফর, সেটা এখন হিসাব-নিকাশ করার বিষয়। বিভিন্ন পত্রপত্রিকা এবং অনেক বিদগ্ধজনও বলতে শুরু করেছেন, নরেন্দ্র মোদির এই সফর দুই দেশের সম্পর্ককে অনেক উচ্চতায় নিয়ে যাবে। ঐতিহাসিক সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ হবে। সেটাও ভবিষ্যতে দেখার বিষয়।

এ কথা সত্য যে নরেন্দ্র মোদি ক্যারিসমেটিক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রাজনীতিবিদ। ভালো বক্তা, কৌশলী ও বুদ্ধিদীপ্ত রাজনীতিবিদ ও কূটনীতিবিদ। ভারতেই তিনি রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। কংগ্রেসের মতো পার্টিকে সম্পূর্ণ ধরাশায়ী করে বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। তিনি নতুন কিছু করবেন, নতুন কিছু দেখাবেন- এমনটা ভেবেছে ভারতবাসী। সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণও। কংগ্রেস, বিশেষ করে নেহরু-গান্ধী পরিবারের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে শেখ হাসিনার ও আওয়ামী লীগ নেতাদের ঘনিষ্ঠতা বেশ পুরনো। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের সময় ভারতে ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস। কংগ্রেস সরকার যে সরাসরি হাসিনাকে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় রাখার জন্য তৎপর ছিল, তা জানা গেল ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিংয়ের ঢাকার কর্মতৎপরতা পর্যবেক্ষণ করার পরই। তিনি ঢাকায় এসেছিলেন ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে এবং চার দিন অবস্থান করেছিলেন। তিনি এরশাদকে বোঝাতে চেয়েছিলেন, এরশাদ যাতে হাসিনার পক্ষে থাকেন। স্বয়ং এরশাদই তা ফাঁস করে দিয়েছিলেন। কৃতজ্ঞ আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবিতে একটু হতাশ হয়েছিল। বিজেপি সরকার ও নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য তারা বিশেষ আগ্রহী ও তৎপর ছিল। সে জন্য মোদির সফরকে কেন্দ্র করে মহা আয়োজন করা হয়েছিল।

অন্যদিকে বিএনপি এতকাল ভারতবিরোধী ও খানিকটা সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করে এলেও এবার বুঝতে পেরেছে যে ভারতের মতো প্রতিবেশীকে চটিয়ে ক্ষমতায় যাওয়া বা ক্ষমতায় থাকা খুব সহজ ব্যাপার নয়। কংগ্রেস সরকার কিন্তু খালেদা জিয়ার প্রতি যথেষ্ট সদয় ব্যবহার করেছিল। তাঁকে ভারতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল এবং লালগালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল, যা কি না বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীকে কখনো দেওয়া হয় না। কিন্তু ‘অতিবুদ্ধিমতী’ খালেদা জিয়া ভারতবিরোধী ট্রাম্প কার্ড খেলতে গিয়ে ধরা খেলেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় যখন ঢাকায় আসেন, তখন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের সময়সূচি আগে থেকে নির্ধারিত ছিল। খালেদা জিয়া সাক্ষাৎ করলেন না। কারণ সেদিন জামায়াতের ডাকা হরতাল ছিল। এতে শুধু ব্যক্তিগতভাবে প্রণব মুখোপাধ্যায় বা কংগ্রেস দলই নয়, সংগত কারণেই ভারতের প্রশাসন ও সাধারণভাবে ভারতবাসীও ক্ষুব্ধ হয়েছিল।

নরেন্দ্র মোদি এবং বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক

সেই ক্ষতি মেরামত করার জন্য খালেদা জিয়া এবার তৎপর হয়েছিলেন। যিনি একসময় ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত সাক্ষাৎ করেননি, তিনিই এবার ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য লবিং করেছেন। আওয়ামী লীগ মহল বলতে শুরু করেছিল, খালেদার সঙ্গে দেখা হবে না। ভাবটা যেন এমন, দেখা হলে তাদের এক দফা পরাজয় হবে। এমন হীনম্মন্যতাবোধ যে কেন হয়, তা ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। অন্যদিকে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তাঁর হোটেল কক্ষে খালেদার দেখা হলো এবং কিছুক্ষণ একান্তে কথা বলারও সুযোগ ঘটল। তখন বিএনপি মহলে বেশ উৎফুল্ল ভাব দেখা গেল। এটা হলো হীনম্মন্যতার আরেক দিক।

খালেদা জিয়া ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি ভারতবিরোধী নন। তিনি ভারতবিরোধী রাজনীতি করবেন না। হয়তো এটি তাঁর সর্বশেষ উপলব্ধি। শক্তিশালী প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে ঝগড়া-ফ্যাসাদ করে অথবা ভারতবিরোধী প্রচারণা করে কিছু সস্তা জনপ্রিয়তা কিছু লোকের কাছ থেকে সাময়িককালের জন্য পাওয়া গেলেও এই রাজনীতি শেষ পর্যন্ত ভালো ফল দেয় না।

ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে ঐতিহাসিকভাবে দেখা যুক্তিসংগত। ব্রিটিশরাজের অধীনে আমরা এক দেশ ছিলাম। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ আমাদের ভাগ করে সমুদ্র পাড়ি দেয়। পাকিস্তান আন্দোলন ছিল সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীল। সেই সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে আমরা বিভক্ত হলাম। এটি ছিল সেদিনের প্রগতিশীল ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ঐতিহাসিক পরাজয়। জিন্নাহ ও মুসলিম লীগের চরম প্রতিক্রিয়াশীল প্রচার, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কূটকৌশল ও কংগ্রেস নেতাদের সংকীর্ণ স্বার্থবুদ্ধি (একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন মহাত্মা গান্ধী)- সব মিলে যে ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডি ঘটে গেল, তার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে আমরা আজও মুক্ত হতে পারিনি।

এরপর ১৯৭১ সালে আমরা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শৃঙ্খল থেকে নিজেদের মুক্ত করলাম এক মহান সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। এই যুদ্ধে ভারতের যে অসামান্য অবদান তা কে অস্বীকার করবে? ১৯৪৭ সালের দুর্ভাগ্যজনক ঐতিহাসিক পর্বকে পেছনে ফেলে আমরা নতুন পথে অগ্রসর হলাম। দুই দেশের মধ্যে ঐতিহাসিক মৈত্রীর বন্ধন রচিত হলো। দুই দেশে যে ধরনেরই সরকার থাকুক না কেন, সরকারি ও জনগণের পর্যায়ে বন্ধুত্ব দুই দেশের জনগণের ও সামগ্রিক স্বার্থে অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

১৯৭১-৭২ সালের সেই বন্ধুত্বের উষ্ণ পরিবেশ কিন্তু পরবর্তী সময়ে থাকেনি। কারণ দুই দেশের মধ্যে, বিশেষ করে একটি যদি বড় দেশ হয় এবং আরেকটি ছোট দেশ হয় (জনসংখ্যা, আয়তন ও অর্থনৈতিক হিসাবে), তাহলে সেই বন্ধুত্ব রক্ষা করতে হলে কিছু শর্ত মানতে হবে উভয় দেশকেই, পারস্পরিক সমমর্যাদা ও সম-অর্থনৈতিক স্বার্থকে খুবই যত্নসহকারে রক্ষা করে। আমাদের দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকভাবে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটি দিকই আছে। ইতিবাচক দিক হলো, আমাদের আছে একই ইতিহাস (১৯৪৭ পর্যন্ত), ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি (বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে)। অন্যদিকে হিন্দু-মুসলমানের বিভাজন ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দগদগে ক্ষতচিহ্ন আছে ইতিহাসের পাতায়। এমনকি সামাজিক মানসিকতার মধ্যেও সাম্প্রদায়িকতার বিষ ঢোকানো আছে। ইতিবাচক দিককে বাড়াতে হবে এবং নেতিবাচক দিককে মুছে ফেলতে দুই দেশের নেতৃত্বকেই কাজ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বড় দেশ হিসেবে ভারতের নেতৃত্বের ভূমিকাটাই বেশি।

প্রথমে আমাদের দিকটা দেখা যাক। এ কথা সত্য যে আমাদের দেশে একপর্যায়ে ভারতবিরোধী মনোভাব বেশ তীব্র হয়ে উঠেছিল। তাহলে কি বলতে হবে এই দেশের বেশির ভাগ মানুষ হিন্দুবিদ্বেষী, ভারতবিরোধী ও অকৃতজ্ঞ? না, এমন সিদ্ধান্তে আসা হবে বিরাট বড় ভুল। মওলানা ভাসানী, যিনি দেশ-জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে মেহনতিদের পক্ষে কথা বলতেন, যিনি প্রায় কমিউনিজমের কাছাকাছি, আন্তর্জাতিকতাবাদী। তিনি যখন গঙ্গার পানির ন্যায্য অংশ দাবি করে ফারাক্কা মিছিল করেন, তাঁর সেই ভারত সরকারবিরোধী প্রচারণাকে কিভাবে দেখব? সত্তরের দশকের প্রথমার্ধে জাসদ ভারতবিরোধী জ্বালাময়ী বক্তব্য দিত। তারা তো মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। তাদেরকে কি অদেশপ্রেমিক বলব? বাংলাদেশে ব্যবসা বিস্তার ও মুনাফা লুণ্ঠনের জন্য সক্রিয় ভারতের বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের যে সেন্টিমেন্ট তার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা নয়, বরং দেশপ্রেমের অভিব্যক্তি পাওয়া যায়। অন্যদিকে ভারত সরকার যখন দেখে যে পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয় দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার, তখন তাদের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, তা খুব সহজেই বোঝা যায়। এটা বিশ্বাস করার মতো কারণ আছে যে শুধু বিএনপি আমলেই নয়, এমনকি নব্বইয়ের দশকে আওয়ামী লীগ আমলেও পূর্ব ভারতের বিদ্রোহীরা বাংলাদেশে আশ্রয় পেয়েছিল। উভয় দিক থেকেই সত্যিকারের বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে হবে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদকে পরিত্যাগ করে। আরো ভালো হয় যদি দুই দেশ যৌথভাবে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নেয়। তবে দুই দেশের সরকারের যে শ্রেণিচরিত্র তাতে সেই আশা করাটা মূর্খতা মাত্র।

সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য একদিকে যেমন আমাদের অন্ধ ভারতবিরোধিতা, সাম্প্রদায়িকতাই যার আসল উৎস, তাকে পরিত্যাগ করতে হবে, অন্যদিকে ভারতকেও সজাগ থাকতে হবে, যেন অধিক শক্তিশালী দেশ হিসেবে তারা কোনো বাড়তি সুবিধা না নেয়, আমাদেরকে আমাদের ন্যায্য দাবি থেকে বঞ্চিত না করে।

নরেন্দ্র মোদির কৃতিত্ব যে তিনি ১৯৭৪ সালের স্থল সীমান্ত চুক্তি কার্যকর করেছেন এবং এ ব্যাপারে ভারতের সব দলকে ঐকমত্যে আনতে পেরেছেন। এই চুক্তির যে অংশটুকু বাংলাদেশের করার কথা ছিল, তা বাংলাদেশ কার্যকর করেছিল তখনই। ভারত কেন ৪১ বছর ঝুলিয়ে রেখেছিল? কংগ্রেস সরকার কেন উদ্যোগ নেয়নি? ভারতের পার্লামেন্টে এই আইন পাস হওয়ার পর আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। তোষামোদকারী বুদ্ধিজীবীর দলও তাতে যোগ দেয়। কিন্তু শেখ হাসিনা অথবা ভারতবিরোধী খালেদা জিয়া অথবা এরশাদ সরকার কেন আগে এ বিষয়টি ভারতের কাছে জোরের সঙ্গে উত্থাপন করেনি? এ প্রসঙ্গে একক কৃতিত্ব নরেন্দ্র মোদির, ভারত বা বাংলাদেশের অন্য কোনো নেতার নয়। কিন্তু সেই নরেন্দ্র মোদি কেন এমন আশ্বাস দিলেন না যে দুই দেশের বন্ধুত্বকে প্রগাঢ় করার জন্য কাঁটাতারের বেড়া তুলে ফেলা হবে এবং বিএসএফ আর একজন বাংলাদেশিকেও গুলি করে হত্যা করবে না?

সাধারণ নদীর পানি প্রসঙ্গে সুবক্তা নরেন্দ্র মোদি সুন্দর সুন্দর বাক্য উচ্চারণ করেছেন; কিন্তু তিস্তার পানি বণ্টন প্রসঙ্গে সুনির্দিষ্ট কিছু বলেননি। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ১৯৯৭ সালে গৃহীত জাতিসংঘের পানিপ্রবাহ কনভেনশন অনুযায়ী (বিশেষ করে ৭.১ ও ৭.২ ধারা) ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে পরামর্শ না করে, বাংলাদেশের সঙ্গে সমঝোতা না করে তিস্তার উজানে বাঁধ দিতে পারে না। কিন্তু ভারত একটার পর একটা ব্যারাজ তৈরি করে চলেছে। বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নদী তিস্তায় শুষ্ক মৌসুমে ধু ধুু বালি ওড়ে। এটাই কি বন্ধুত্বের নমুনা?

মোদি বাংলাদেশ থেকে যে উষ্ণ সংবর্ধনা পেয়ে গেলেন এবং যা আশাবাদ জাগ্রত করে গেলেন, তাকে ধরে রাখতে হলে তিস্তা অববাহিকার মানুষকে সন্তুষ্ট করতে হবে। বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা করতে হবে সীমান্তে কিশোরী ফেলানীর ভাগ্যে যা হয়েছে তার জন্য আমরা দুঃখিত- এ রকম বেদনাদায়ক ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না।

মোদির চমক ছিল ২০০ কোটি ডলার ঋণ। আমাদের শাসকদের একটা বিকৃত মানসিকতা এই যে ঋণ শুনলেই আমরা পুলকিত হয়ে উঠি। কী শর্তে ঋণ তার পুরোপুরি না জেনে উল্লসিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। সব ঋণ বা সব বিনিয়োগ যে দেশের জন্য উপকারী এমন কথা কে বলেছে? একবার টাটা গ্রুপ এসেছিল বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগের কথা বলে। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল ওতে আমাদের লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ বেশি ছিল। শেষ পর্যন্ত সেই বিনিয়োগ আর হয়নি।

নরেন্দ্র মোদি ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে যে বহুমুখী কানেকটিভিটির প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন এবং যা কার্যকর হতে চলেছে, তা নিশ্চয়ই ভালো। কিন্তু বাস্তবে এতে সত্যিকারের লাভ হবে ভারতেরই। আমাদের বন্দর ব্যবহার করবে ভারত। অসুবিধা কী? এতে আমরা কিছু উপার্জন করলেও মূল লাভ হবে পূর্ব ভারতের। হোক না লাভ। ভারতের জনগণ তো আমাদেরই ভ্রাতা-ভগ্নি। কিন্তু ভারতের ভূমি ব্যবহার করে নেপাল-ভুটানের সঙ্গে আমাদের যাতায়াত এখনো মৌখিক কথা পর্যায়ে রয়েছে। তার বেশি নয়।

নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরের সঙ্গে সঙ্গে এলো রিলায়েন্স ও আদানির বিনিয়োগ। ভারতের দুই বিশাল করপোরেট হাউস। তারা কয়লাকেন্দ্রিক বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। কয়লা আসবে ভারত থেকে। তারা বিশেষ আইনের আওতায় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের সুযোগ পাবে। ২০১০ সালে যে বিশেষ আইনটি তিন বছরের জন্য প্রণীত হয়েছিল (যা পরে আরো তিন বছর বাড়ানো হয়েছিল), সেই আইনের সুযোগ প্রথম পাচ্ছে এই দুই বিদেশি কম্পানি। এই বিশেষ আইনে সরকার দরপত্র ছাড়াই কাউকে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে অনুমতি দিতে পারবে এবং তা নিয়ে আদালতে যাওয়া চলবে না। আমাদের মনে থাকতে পারে কুইক রেন্টালের ইতিহাস। সেটা কিন্তু সুখকর ছিল না।

ভারতের কম্পানি রামপালে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করবে- এটা অনেক আগেই সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে সুন্দরবন ধ্বংস হবে। সে জন্য আন্দোলনও হয়েছে। কিন্তু সরকার কর্ণপাত করেনি। এবার ভারতের আরো দুটি কম্পানি ভারত থেকে আমদানি করা কয়লাভিত্তিক প্রকল্পের কাজ পেল। তারা অবশ্যই ব্যবসা করতে, মুনাফা করতে আসবে। আমাদের কি এখনই জনগণের স্বার্থের দিকটা দেখতে হবে না? কিন্তু কোথায় সেই স্বচ্ছতা? অনেক চুক্তি হয়েছে। জনগণকে কি জানানো হয়েছে?

চূড়ান্ত বিশ্লেষণে, শুধু কথায় চিঁড়া ভেজে না। নরেন্দ্র মোদির ঢাকা আগমনকে আমরা স্বাগত জানিয়েছি। আমরা বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত করতে চাই। কিন্তু বন্ধুত্বের যুক্তিসংগত শর্তগুলো পূরণ না হলে কোনো বন্ধুত্বই স্থায়ী হয় না। আশা করি উভয় দেশের নেতৃত্ব এ ব্যাপারে মনোযোগী হবেন।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর