রক্তাক্ত খাদিজাকে কোলে নিয়ে ইমরান ছুটলেন হাসপাতালের দিকে

ধারালো চাপাতির একের পর এক আঘাত। রক্তাক্ত খাদিজা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন নিথর। কেউ এগিয়ে যাচ্ছে না। কেউ সাহায্যের হাত বাড়াচ্ছে না। দূর থেকে হৈচৈ শুনে এগিয়ে এলেন একজন। তারপর ভূলুণ্ঠিত মানবতাকে তুলে নিলেন কোলে। রক্তাক্ত খাদিজাকে কোলে নিয়ে ছুটলেন হাসপাতালের দিকে। ওই একজন হচ্ছেন ইমরান। পুরো নাম ইমরান কবির।

ইমরান ঘটনার দিন এমসি কলেজে গিয়েছিল ঘুরতে। বিকাল ৫টার পর হঠাৎ চিৎকার শুনে দৌড়ে যান। গিয়ে দেখেন বদরুল খাদিজাকে কোপাচ্ছে আর দূর থেকে অনেকেই দাঁড়িয়ে দেখছে। খাদিজার সঙ্গে ছাত্রীরা দৌড়াচ্ছে আর চিৎকার করছে। প্রথমে একটু থমকে দাঁড়িয়েছিলেন ইমরান। পরক্ষণেই দৌড় দেন খাদিজার দিকে। ছুটে গেলো খাদিজার রক্তমাখা দেহের পাশে। গিয়েই বীভৎসতা দেখে চিৎকার শুরু করলো। চিৎকার করে বললো-‘আপনারা আসুন। মেয়েটি মারা যাচ্ছে। হাসপাতালে নিতে হবে।’ প্রথমে কেউ সাড়া দেয়নি। যখন হামলাকারীকে আটক করা হলো তখন এগিয়ে এলেন আরো দুই যুবক। তারাই খাদিজার রক্তমাখা দেহ নিয়ে হাসপাতালে আসেন। সাহসী ওই তরুণের নাম মোহাম্মদ ইমরান কবির। খাদিজাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েই দায়িত্ব শেষ হয়নি। রক্তমাখা জামা-কাপড় নিয়ে এক ব্যাগ রক্ত দেন খাদিজাকে। আর হাসপাতালে চিৎকার করেই বলছিলেন- ‘আপুকে বাঁচান। উনি মারা যাচ্ছেন।’

টগবগে তারুণ্যের মূর্ত প্রতীক ইমরান কবির (২০)। সিলেট সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিয়ে ব্যস্ত সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের ঢালারপাড় গ্রামের এই যুবক। সোমবার বিকেলে প্রকৃতির সুনিবিড় ছায়াঘেরা এমসি কলেজে হাঁটতে গিয়েছিলেন তিনি। তার পর তো অসীম সাহসিকতায় মানবতার ডাকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ইমরান বলেন, ‘আমি যখন ঘটনাস্থলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন দেখলাম সবাই দৌড়ে পালাচ্ছে। আমার একটু খটকা লাগল, সবাই কেন পালাচ্ছে!

আরেকটু এগিয়ে গিয়ে দেখি, পুকুরপাড়ে একটা মেয়ে পড়ে আছে। রক্তাক্ত, নিথর। কেউ নেই পাশে। দৌড়ে তার কাছে ছুটে যাই আমি। চিৎকার করে সাহায্য করার জন্য ডাকাডাকি করি। দুজন অপরিচিত ব্যক্তি এগিয়ে আসেন।’

বলে চলেন ইমরান, ‘তাঁদের সঙ্গে নিয়ে ওই মেয়েটাকে (তখনো খাদিজার নাম-পরিচয় কিছুই জানেন না ইমরান) কোলে করে একটু এগিয়ে একটা সিএনজি অটোরিকশায় দিয়ে ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে যাই।’

হাসপাতালে যাওয়ার পথে খাদিজার মাথা ছিল ইমরানের কোলেই। ইমরান জানান, ‘খাদিজা আপুর মাথা ছিল ক্ষত-বিক্ষত। মাথার দিকে চাওয়ার ধৈর্য ছিল না। মাথা সহ শরীর থেকে অঝোরে রক্ত ঝরছিল। উনার রক্তে আমার টি-শার্ট-প্যান্ট ভিজে একাকার। কোনো ভাবেই রক্ত বন্ধ হচ্ছিল না।’ ইমরান জানান, ‘সিএনজিতে ওঠানোর পর খাদিজা আপুর চোখ উল্টে গিয়েছিল। আমরা মনে মনে আল্লাহর কাছে আপুর প্রাণ রক্ষার জন্য প্রার্থনা করছিলাম। উনার হাত মোচরাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল শরীরের সকল ‘রগ’ এক হয়ে যাচ্ছে। আমরা হাত-পা শক্ত করে ধরে রাখছিলাম। মনে হচ্ছিল উনি মারা যাচ্ছেন।’ ইমরান শুধু খাদিজাকে হাসপাতালে নিয়েই দায়িত্ব শেষ করেননি। ওষুধের জন্য দোকানে গেছেন। ডাক্তারদের কাছে কাছে থেকেছেন। এরপর পড়লো রক্তের প্রয়োজন। খাদিজার রক্তের গ্রুপ এ পজেটিভ। ইমরানেরও রক্তের গ্রুপ একই। ইমরান এক ব্যাগ রক্ত দিলেন খাদিজাকে। এ সময় ইমরানের চোখ দিয়ে জল ঝরছিল। ওই দিন রাত ১২টা পর্যন্ত ইমরান হাসপাতালে ছিলেন। এরপর খাদিজাকে ঢাকায় বিদায় দিয়ে বাসায় চলে যান।

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জের ঢালারপাড় গ্রামের এই তরুণ নগরীর মেসে বসবাস করে পড়ালেখা করছেন। রাজনীতির সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা নেই তার। দেশের রাজনীতি তার পছন্দ না। দুই ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট ইমরান। বড় ভাই ব্যবসা করছেন। আর বোনটিও ভর্তি হবেন ভার্সিটিতে। কোম্পানীগঞ্জের ঢালারপাড় গ্রামের ঢালারপাড় উচ্চ বিদ্যালয়ের স্কুলশিক্ষক মো. নজরুল ইসলাম ও গৃহিণী তাসলিমা আক্তারের ছোট ছেলে ইমরান কবির। তার এই সাহসিকতা ও মহানুভবতা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বর্তমান সমাজে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর