দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের লাগামহীন বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ঢাকায় সফররত আইএমএফ প্রতিনিধি দলের সর্বশেষ বৈঠকে এ উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। তবে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঘোষিত রোডম্যাপ বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে দাতা সংস্থাটি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশকে দেওয়া ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ কর্মসূচির চতুর্থ কিস্তি ছাড়ের আগে বিভিন্ন শর্ত পরিপালনের অগ্রগতি পর্যালোচনা করতে গত মঙ্গলবার আইএমএফ মিশনের প্রধান ক্রিস পাপাদাকিসের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফরে এসেছে। ইতোমধ্যে তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তার সঙ্গে পৃথক বৈঠকও করেছেন। এসব বৈঠকে মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিময় হার, বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্য, রিজার্ভ পরিস্থিতি, খেলাপি ঋণ কমাতে রোডম্যাপ বাস্তবায়ন, ব্যাংক খাতের তারল্য পরিস্থিতিসহ সার্বিক অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দাতা সংস্থাটি তাদের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছে। আজ রবিবারও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রতিনিধি দলটির একাধিক বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
জানা যায়, আইএমএফের ঋণের অন্যতম শর্ত ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে খেলাপি ঋণ ৮ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে। এ সময়কালের মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানার ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে এবং বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের নিচে নামাতে হবে। ওই শর্তের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনা ও ব্যাংক খাতে সুশাসন ফেরাতে একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। রোডম্যাপে প্রায় ১৭টি কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা বলা হয়। ইতোমধ্যে ১৫টি কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে সার্কুলার জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু খেলাপি ঋণ কমছে না, বরং লাগামহীনভাবে বেড়ে চলেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, সর্বশেষ জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর এই তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৭৩ হাজার কোটি টাকা। এটি অস্বাভাবিক। গত এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ১ লাখ ২ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা। সব মিলে গত সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশ। এ সময়ে সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২৩ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার ১১২ কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত ঋণের ৪০ দশমিক ৩৫ শতাংশ। আর বেসরকারি ব্যাংকে খেলাপি ৪৯ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৪৯ হাজার ৮০৬ কোটি টাকা বা ১১ দশমিক ৮৮ শতাংশ। বিশেষায়িত ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ৫ হাজার ৮১৪ কোটি টাকা বা ১৩ দশমিক ২১ শতাংশ।
সূত্র জানায়, গত বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সফররত আইএমএফ প্রতিনিধি দলের এবটি বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে খেলাপি ঋণের লাগামহীন বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। তবে খেলাপি ঋণ কমানো ও ব্যাংক খাতে সুশাসন ফেরানোর রোডম্যাপ বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছে দাতা সংস্থাটি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, রোডম্যাপে আমাদের ১৭টি ইস্যু ছিল। ইতোমধ্যে ১৫টি ইস্যুতে সার্কুলার করা হয়েছে। এ ছাড়া অপর দুটির বিষয়ে সর্বশেষ অগ্রগতি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এতে সন্তোষ প্রকাশ করেছে আইএমএফ। তবে খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়া নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। আমরা বলেছি, আগে ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ লুকিয়ে রাখত। তবে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সংস্কারমূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করায় ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র দেখাতে শুরু করেছে। এ ছাড়া খেলাপি ঋণের সংজ্ঞায় আন্তর্জাতিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। তদুপরি ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতার কারণেও ঋণ পরিশোধ কমে গেছে। এসব কারণে খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে। তবে এটাও ভালো দিক যে, এখন খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্রটা ফুটে উঠছে। এর প্রেক্ষিতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। এতে অদূর ভবিষ্যতে খেলাপি ঋণ কমবে। তবে ২০২৬ সালের মধ্যে যে টার্গেট দেওয়া আছে, সেই সীমার মধ্যে খেলাপি ঋণ নামিয়ে আনা কঠিন হবে বলেও মন্তব্য করেন ওই কর্মকর্তা।
এদিকে আগামীতেও খেলাপি ঋণ কমার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। বরং আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আইএমএফের অন্যতম একটি শর্ত ছিল আগামী মার্চের মধ্যে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা আন্তর্জাতিক মানের করতে হবে। গত ২৭ নভেম্বর সার্কুলার জারির মাধ্যমে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা আন্তর্জাতিক মানের করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নতুন এ সংজ্ঞা কার্যকর হবে আগামী বছরের এপ্রিল থেকে। এতে সব ধরনের ঋণ বা ঋণের কিস্তি পরিশোধের নির্ধারিত দিনের তিন মাস পর থেকেই খেলাপি হিসাবে গণ্য করার বিধান করা হয়েছে। বর্তমানে মেয়াদি ও কৃষি ঋণ ছয় মাস পর খেলাপি হচ্ছে। এসব ঋণের ক্ষেত্রে খেলাপি করার মেয়াদ তিন মাস কমানো হয়েছে। আবার ব্যাংক খাতের সব জালিয়াতির তথ্য এখনও প্রকাশ হয়নি। এস আলম গ্রুপের দখল করা ৯টি ব্যাংকের পর্ষদ বাতিল করে নতুন পর্ষদ পুনর্গঠন করে দেওয়া হয়েছে। ওই সব ব্যাংকে এখন অডিট হচ্ছে। এতে জালিয়াতির সব তথ্য বের হতে আরও সময় লাগবে। ওই সব তথ্য েেবর হলে এবং নতুন সার্কুলার কার্যকর হলে আগামীতে খেলাপি ঋণ আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আইএমএফের আরেকটি শর্ত ছিল, খেলাপি ঋণ আদায় বাড়াতে এবং ঋণখেলাপিদের সম্পদ জব্দ করে ঋণ আদায় করতে সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি গঠন করার। এ বিষয়ে নীতিমালা তৈরির কাজ চলমান রয়েছে।