ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পতন ঘটে তার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের। এরপর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যাত্রা শুরু হয় অন্তর্বর্তী সরকারের, যাত্রা শুরু হয় নতুন এক বাংলাদেশের। বিশ্লেষকরা বলছেন, এমন প্রেক্ষাপটে এ দেশের সরকারের সঙ্গে নয়, বরং একটি বিশেষ দল ও ব্যক্তির সঙ্গে পার্শ্ববর্তী দেশটির ‘বিশেষ বন্ধুতা’ এবং তাদের গণমাধ্যমে বাংলাদেশবিরোধী অপপ্রচারের কারণেই দুই দেশের সম্পর্কে একধরনের শীতলতা সৃষ্টি হয়েছে। তারা বলছেন, জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে বিদায় নেওয়া শেখ হাসিনা সরকারের পতনকে বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের দাবি ধরে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ও ছাত্র আন্দোলনের অর্জনকে ভারতের স্বীকৃতি দেওয়া উচিত ছিল। শুধু কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা একটি বিশেষ দলের স্বার্থরক্ষায় বন্ধুত্ব স্থাপন করলে বাংলাদেশের মানুষ সেটা ভালোভাবে নেবে না, এ বিষয়টি তাদের ভাবনায় থাকা আবশ্যক। বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও আত্মমর্যাদার প্রশ্নে এক বিন্দুও ছাড় দেওয়া যাবে না। ভারতের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব হতে হবে সমমর্যাদার ভিত্তিতে এবং একপেশে নয়, পারস্পরিক স্বার্থরক্ষায়। এ ছাড়া তাদের অপপ্রচারের জবাব দিতে হবে বিশ্বব্যাপী সঠিক তথ্য তুলে ধরার মাধ্যমে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ বলেন, ওরা (ভারত) যে প্রচার চালাচ্ছে, সেগুলো কোনো রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যম নয়। সেখানে তথ্যগত অপপ্রচার থাকলে আমাদের সরকারের উচিত হবে সঠিক তথ্য প্রচার করা। এ ছাড়া দেশটির সঙ্গে কোনো সমস্যা সৃষ্টি হলে আলোচনা করে সমাধান করা যেতে পারে। ভারত আমাদের সবচেয়ে কাছের বন্ধুরাষ্ট্র। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করার কোনো সুযোগ নেই। তবে একেবারে ‘জি হুজুর, জি হুজুর’ টাইপের বন্ধুত্বও গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্নে কথা উঠলে অবশ্যই প্রতিবাদ জানানো দরকার। তিনি বলেন, এটাও ঠিক যে, সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের কিছু ঘটনা তো ঘটেছেই। কিন্তু কেন, কী কারণে এসব ঘটল, এসবের প্রকৃত তথ্য তুলে ধরতে হবে সরকারের। গত ৫ আগস্টের পর কিছু মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটেছে। এগুলো নিয়েও সরকারের শক্ত অবস্থান থাকা দরকার, যোগ করেন ড. সাব্বির।
বাংলাদেশ-ভারত চলমান সম্পর্ক নিয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক এম হুমায়ুন কবির বলেন, ভারতের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে আমরা প্রতিবাদ জানাচ্ছি, সংগঠিত হচ্ছি। সামনে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে বৈঠক হবে, সেখানেও বিষয়টি তুলে ধরা হবে। তিনি বলেন, ভারতের মিডিয়া ও কিছু রাজনৈতিক নেতা যেভাবে অপতথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রচার চালাচ্ছে, তাতে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত। ভারতের মানুষ আমাদের দেশ সম্পর্কে ভুল ধারণা নিচ্ছে। বিশ্বেও খারাপ বার্তা যাচ্ছে। এটা বন্ধ করতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকা দরকার।
নাট্যকার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ বলেন, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারটা
বেশি হচ্ছে। এটা ঠিক না। সংখ্যালঘু নির্যাতনের যেসব তথ্য দেওয়া হচ্ছে, সেগুলোও সঠিক তথ্যভিত্তিক নয়। আমার দৃষ্টিতে, ভারতের উচিত সংযত হওয়া। যেভাবে প্রচার হচ্ছে, তা বন্ধ করা দরকার।
জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ‘ভারতের অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ে আমরা তো হস্তক্ষেপ করিনি। এরপরও তারা
আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। ভারতকে স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই, আমরা তাদের কোনো আগ্রাসন সহ্য করব না। তিনি বলেন, যারা এ দেশে জন্মগ্রহণ করেছেন, সবাই এ দেশের নাগরিক। এ দেশের সংখ্যালঘু বলতে কিছু নেই। বিগত সময়ে এ দেশের অন্য ধর্মের মানুষকে সংখ্যালঘু বলে বৈশ্বিক দরবারে ফায়দা লুটে নেওয়া হয়েছে। আমরা বলতে চাই, সবাই এ দেশের নাগরিক, কেউই সংখ্যালঘু নয়।
এ বিষয়ে ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র নায়েবে আমির সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম বলেন, ভারত পায়ে পাড়া দিয়ে যুদ্ধ করতে চায়। ইসকন সন্ত্রাসবাদ প্রতিষ্ঠা করে দেশকে ধ্বংস করতে চায়। ভারত কোনোদিন আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারেনি। সে দেশের সংখ্যালঘুদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেনি। তিনি বলেন, ভারত সমগ্র বাংলাদেশকে অপমান ও আঘাত করেছে। আমরা লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত আছি। এ দেশের মানুষ অভুক্ত থাকলেও কারও কাছে মাথা নত করবে না।
নৌপরিবহন এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, আমাদের দেশ থেকে ভারতে লোক কম যাচ্ছে, আসছেও কম। যতদিন ভারত আমাদের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা করবে, ততদিন এ দেশ থেকে লোক কম যাবে। না গেলে আমাদের কোনো ক্ষতি নেই।