সময়টা ছিল ২০২০ সালের আগস্ট কি সেপ্টেম্বর। স্থান চাকরিপ্রার্থীদের স্বপ্নের পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যানের রুম। অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করলেন কমিশনের একজন সিনিয়র সদস্য। আড়চোখে তাকালেন চেয়ারম্যানের টেবিলের উল্টোদিকে আগন্তুকের দিকে। পরিচয় ঠাহর করতে না পেরে কথা বলবেন কি না ইতস্তত করছেন। চেয়ারম্যানের অভয় পেয়ে মোলায়েম সুরে বললেন, বাজেটের বিষয়ে কি একটু কড়া অবস্থান নিতে পারি আমরা? জবাবে চেয়ারম্যান জানালেন, সরকার আবার মাইন্ড করে কি না!
কিছুক্ষণ চিন্তা করে চেয়ারম্যান বললেন, থাক বাদ দেন। সরকারের মাইন্ড করার বিষয়টি তৎকালীন চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিকের প্রায়রিটি লিস্টে টপেই ছিল। তার দুচোখে ছিল স্বপ্ন এমপি হওয়ার। এর জন্য নমিনেশন লাগবে। এটা পেতে হলে মাইন্ড করলে চলবে না। তা তিনি মন্ত্রণালয়ের সচিব হন আর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক হন। বলা তো যায় না কার কানকথায় মনোনয়নের নীতিনির্ধারক বেঁকে বসেন।
শেষ পর্যন্ত হয়তো ড. সাদিক আনুগত্যের পুরস্কার পেয়েছিলেন। কমিশনের চেয়ারম্যান থেকে বিদায় নিয়ে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। অপেক্ষায় ছিলেন মন্ত্রী হওয়ার ডাকের। ড. সাদিকের মতো মাইন্ড করার বিষয়টি অন্য চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইনেরও ছিল। তিনিও পিএসসিকে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মতো করে চালাননি। সব সময়ই সরকার কী মনে করে সে বিষয়েই বেশি সচেষ্ট ছিলেন। এতে অনেক ক্ষেত্রেই পিএসসির সাংবিধানিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় পিএসসিকে চালিয়েছে অধীনস্থ অধিদপ্তরের মতো। মর্যাদার প্রশ্নে পিএসসি ধারাবাহিকভাবে যে সংকটে ছিল, তা আরও তীব্র হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে দৃশ্যত প্রশ্নপত্র ফাঁসের কোনো অভিযোগ ছিল না। কিন্তু সেই অভিযোগ ফিরে এসেছে সোহরাব হোসাইনের সময়েই। পরীক্ষা নিয়ে প্রার্থী বাছাই করা ছাড়াও সরকারি চাকরির শৃঙ্খলা রক্ষার কাজটিও পিএসসি করতে পারেনি। যথাযথ ভূমিকা নিতে পারেনি বলেই মন্ত্রণালয়গুলো যেভাবে বিধিমালা পাঠিয়েছিল প্রায় ক্ষেত্রেই, তাই অনুমোদন করে দিতে হয়েছে। সোহরাব হোসাইনের এক বছরে একটি বিসিএস শেষ করার ঘোষণাও মাঠে মারা গেছে।
পিএসসি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হলেও কতটুকুই বা তৎকালীন সরকারের রাহুমুক্ত ছিল। ফলে প্রতিষ্ঠানের প্রধান হয়েও নিজের মতো করার বিপত্তি তো ছিলই। ফলে বাংলা ভাষার অন্যতম কবি বিদগ্ধ গবেষক ড. মোহাম্মদ সাদিক কিংবা কবি ও আবৃত্তিকার সোহরাব হোসাইনকে সরকারের চলনে চলতে হয়েছে। কর্মজীবনে দুজনই কীর্তিমান। উচ্চতর আমলার পর সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান চালাতে গিয়ে তাদের সরকার-কাঠামোর অংশ হতে হয়েছে। ইচ্ছা থাকলেও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে আর আলাদা করতে পারেননি।
জনপ্রশাসনের জন্য কিছু ভালো চর্চা করে সেগুলো সরকারকে গ্রহণ করার পরামর্শ দেওয়ার সুযোগ থাকলেও, কমিশন কেরানির দায়িত্বের চেয়ে বেশি কিছু করেনি। সম্প্রতি কমিশন সচিবালয়ের সহকারী পরিচালক পদোন্নতি দিতে গিয়ে জটিলতায় পড়ে। এই জটিলতা নিরসনে বিস্ময়করভাবে কমিশন মতামত চেয়ে বসে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের! যে এখতিয়ার কমিশনের, উল্টো সে বিষয়েই সরকারের কাছে পরামর্শ চায়। এর আগে ঠিক একই বিষয়ে দ্বন্দ্ব হলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কমিশনের পরামর্শ নিয়ে সমাধান করেছিল! অর্থাৎ নিজের কর্মচারীর ক্ষেত্রেও সাংবিধানিক চর্চা করতে পারেনি কমিশন।
সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের নির্দিষ্ট কোনো মর্যাদা নেই। চেয়ারম্যান মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সমান বেতন-ভাতা পেলেও মর্যাদা ভিন্ন। তিনি যে পদ থেকে এসেছেন, সেই পদের মর্যাদা ভোগ করেন। ড. ফখরুদ্দীন আহমদের সরকারের সময় সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. সাদ’ত হোসাইন কমিশনের চেয়ারম্যান হন। তিনি নিজস্ব মর্যাদা দিয়েই কমিশনের চেয়ারম্যান পদকে আলোকিত করেছিলেন। সরকার তখন কমিশনের চেয়ারম্যানের বেতন-ভাতা ও সুবিধা মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সমান করে। পরে অনেক চেষ্টা করে সদস্যদের বেতন, ভাতা ও সুবিধা (মর্যাদা ছাড়া) সরকারের সচিবের সমান করা হয়। মূলত সর্বশেষ যে পদে ছিলেন, সেটাই মর্যাদা হয়ে যায়। গত সপ্তাহে নিয়োগ পাওয়া চেয়ারম্যান ড. মোবাশ্বের মোনেম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। তাই তিনি অধ্যাপকের মর্যাদা ভোগ করবেন।
সোহরাব হোসাইন চেয়ারম্যান ও সদস্যদের মর্যাদা এবং বেতন-ভাতা সম্পর্কিত প্রস্তাব আইন করার জন্য সরকারকে একটা খসড়া দিয়েছিলেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সাড়া দেয়নি। তাদের নিস্পৃহতায় বিষয়টি আলোর মুখ দেখেনি! চেয়ারম্যানকে অ্যাপিলিট ডিভিশনের বিচারপতির মর্যাদায় এবং হাইকোর্টের বিচারপতির মর্যাদায় সদস্যদের নিয়োগের কথা ছিল খসড়া আইনে। কমিশনের মর্যাদা বাড়ানোর এই আইনটি করার জন্য চাপ দেওয়া হয়নি পাছে সরকার রুষ্ট হয় এই আশঙ্কায়।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের হিসাব মতে, ২০২৩ সালে বিভাগীয় মামলা ছিল ১২ হাজার ৩৯১টি। এসব বিভাগীয় মামলায় শাস্তি দিতে হলে একপর্যায়ে গিয়ে কমিশনের মতামত প্রয়োজন হয়। (প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ক্ষেত্রে) এসব মতামত খুব কমই তদন্ত কর্মকর্তার সুপারিশের বাইরে যায়। অর্থাৎ বিভাগীয় মামলা শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার যা পাঠিয়েছে, তাই সই। নিজস্ব বিচার-বিশ্লেষণ নেই বললেই চলে। অথচ পিএসসি যদি সঠিক দায়িত্ব পালন করত, তাহলে এত মামলা হতো না। বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আবদুর রশীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছিল। তদন্তে তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। কিন্তু পিএসসির কড়া অবস্থানের কারণে তাকে চাকরিচ্যুত করা যায়নি।
বিভাগীয় মামলায় সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো নিজেই অভিযোগকারী, আবার নিজেই বিচারক। এ কারণে নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচার প্রায় হয় না, যা নিয়ে প্রশাসন জুড়ে ক্ষোভ রয়েছে। এই বিভাগীয় মামলা নিষ্পত্তি করার জন্য নিরপেক্ষ তদন্ত সংস্থা গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা। তিনি এক সচিব সভায় এ বিষয়ে তাদের মতামত চেয়েছিলেন। কোনো কোনো সচিব এ বিষয়ে ইতিবাচক মানসিকতা দেখাননি।
কর্মকর্তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে কমিশনের কোনো ভূমিকা নেই। এসএসবিতে পিএসসির কোনো প্রতিনিধি নেই। অথচ কর্মকর্তা বাছাইয়ের কাজ পিএসসি করে।
সাধারণত সংস্থাগুলো এমনভাবে কর্মচারীদের নিয়োগবিধি খসড়া করে, যাতে কোনো না কোনো গ্রুপের পক্ষপাতিত্ব থাকে। সাধারণত সেটাই প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় বহাল রাখে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিধিবিষয়ক কমিটি, প্রশাসনিক উন্নয়ন-সংক্রান্ত সচিব কমিটি এই বিধিগুলো প্রায় একই রকম রাখে! এতগুলো পর্যায়ে কেউই খতিয়ে দেখেন না, যা প্রস্তাব করা হয়েছে, সেটা বৈষম্য তৈরি করবে কি না। কোনো পদকে বঞ্চিত করা হয়েছে কি না। ন্যায্যতা রক্ষা হচ্ছে কি না। এরপর খসড়া নিয়োগ বিধিটি পিএসসিতে পাঠিয়ে দেয়। সরকার যা পাঠায়, তাতে বানান ভুল ছাড়া আর কোনো কিছুই দেখে না অভিযোগ করেছেন পিএসসির কর্মকর্তারাই।
চাকরির পরীক্ষা নেওয়া কমিশনের একমাত্র কাজ বলে অনেকেই মনে করেন। অথচ পরীক্ষার বেশিরভাগ কাজই সোর্সিং করা হয়। প্রশ্ন করা, প্রশ্ন ছাপানো, পরীক্ষা নেওয়া, খাতা দেখা এসব কাজ বাইরে থেকে করানো হয়। এসব কমিশনের কোনো সদস্যের করার সুযোগ নেই, শুধু প্রশাসনিক তদারকি ছাড়া।
কিন্তু রাষ্ট্রের গণকর্মচারীদের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, শৃঙ্খলা, অবসর-ভাতা বিষয়ে আইন, বিধি, প্রজ্ঞাপন, আদেশের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হলো কমিশন। এসব ক্ষেত্রে কমিশনের মতামত নিতে হয়। তথ্য-উপাত্ত বিচার-বিশ্লেষণ করে সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে হয়। এর ব্যত্যয়ে কর্ম বিভাগে বিশৃঙ্খলা হয়। এতে উৎপাদনশীলতা কমে যায়, নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত হন আর কর্মচারী হন অথরিটির দাস। পরীক্ষা নিয়েই বেশি ব্যস্ততা দেখায় পিএসসি, উপেক্ষা করে এসব বিভাগীয় কাজ।
কমিশনের কাজ পরিচালনার জন্য দুটি বিধি আছে, যা পরস্পরবিরোধী। অর্ডার অব প্রসিডিংস অনুযায়ী যেকোনো একজন সদস্য চেয়ারম্যানের সঙ্গে পরামর্শ করে বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। সচিবালয় নির্দেশমালা অনুযায়ী যার কোনো সুযোগই নেই। কারণ প্রতিষ্ঠানটিতে একজন পূর্ণ মর্যাদার সচিব রয়েছেন। কমিশনের অবাক করা এই প্র্যাকটিসের জেরে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে।
পিএসসির বাজেট হলো সরকারের দায়যুক্ত ব্যয় অর্থাৎ কমিশনের, যা দরকার সরকার বরাদ্দ দেবে। আর্থিক বিধি অনুযায়ী খরচ করবে পিএসসি। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের ব্যয় সরকার বরাদ্দ দেয় না, তারা নিজেরা নির্ধারণ করে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পিএসসিরও এ ক্ষমতা পাওয়ার কথা। ক্ষমতা চাইতে গেলে সরকার যদি নাখোশ হয় এ কারণে এটা নিয়ে কখনো প্রশ্ন তোলে না পিএসসি।