জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে ভাষণ দিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ভাষণে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের জনগণ বিশেষ করে যুবসমাজ অন্তর্ভুক্তিমূলক ও কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছে এবং নতুন প্রজন্ম এজন্য জীবন উৎসর্গ করেছে। উদারনীতি, বহুত্ববাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর মানুষের গভীর বিশ্বাস থেকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয়। ১৯৭১ সালে যে মূল্যবোধ বুকে ধারণ করে গণমানুষ যুদ্ধ করেছিল, সেই মূল্যবোধ বহু বছর পর এ দেশের জেনারেশন জেড (জেন-জি) নতুনভাবে দেখতে শিখিয়েছে। সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে ‘মনসুন অভ্যুত্থান’ আখ্যায়িত করে তিনি আরও বলেন, এই অভ্যুত্থান বিশে^ ন্যায়বিচারের অনুপ্রেরণা জোগাবে।

শুক্রবার সকালে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বক্তব্য দেওয়ার জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম ঘোষণা করা হলে হলভর্তি অতিথিরা করতালি দিয়ে অভিবাদন জানান। বিশ্বমঞ্চে দাঁড়িয়ে ড. ইউনূস জুলাই-আগস্টে দেশে সংঘটিত ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপট এবং ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের বীরত্বগাথা তুলে ধরেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রাষ্ট্র মেরামতের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার গৃহীত সংস্কার কার্যক্রম সম্পর্কে জানান। গণ-অভ্যুত্থানকে ‘মনসুন অভ্যুত্থান’ আখ্যা দিয়ে ড. ইউনূস দীপ্ত ঘোষণা দেন, এই অভ্যুত্থান বিশ্বে ন্যায়বিচারের পক্ষে অনুপ্রেরণা জোগাবে। বাংলাদেশের ছাত্ররা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে কীভাবে সফল অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে এবং মানুষের মধ্যে নতুন স্বপ্নের বীজ বপন করেছে, তিনি তা তুলে ধরেন ভাষণে।

ছাত্রদের নেতৃত্বে জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে যুগান্তকারী পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, এই ঘটনার প্রেক্ষিতে আজ আমি বিশ্ব সম্প্রদায়ের এ মহান সংসদে উপস্থিত হতে পেরেছি। আমাদের গণমানুষের, বিশেষ করে তরুণ সমাজের অফুরান শক্তি আমাদের বিদ্যমান রাষ্ট্র কাঠামো ও প্রতিষ্ঠানগুলোর আমূল রূপান্তরের এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তিনি বলেন, ছাত্র ও যুবসমাজের আন্দোলন প্রথমদিকে মূলত ছিল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। পর্যায়ক্রমে তা গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়। এরপর সারা পৃথিবী অবাক বিস্ময়ে দেখেছে কীভাবে সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ একনায়কতন্ত্র, নিপীড়ন, বৈষম্য, অবিচার ও

দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাজপথ এবং সামাজিক-যোগাযোগ মাধ্যমে দৃঢ়ভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিল।

বাংলাদেশের তরুণরা যে প্রজ্ঞা, সাহস ও প্রত্যয় দেখিয়েছে তা আমাদের অভিভূত করেছে- উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, বন্দুকের গুলি উপেক্ষা করেও বুক পেতে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল আমাদের এই তরুণরা। অবৈধ রাষ্ট্র ক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রবলভাবে সোচ্চার হয়েছিল তারা। স্কুলপড়–য়া কিশোর-কিশোরীরা নিঃশঙ্কচিত্তে উৎসর্গ করেছিল তাদের জীবন। শত শত মানুষ চিরতরে হারিয়েছে তাদের দৃষ্টিশক্তি।

তিনি বলেন, আমাদের মায়েরা, দিনমজুরেরা ও শহরের অগণিত মানুষ তাদের সন্তানদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নেমেছিল রাজপথে। তপ্ত রোদ, বৃষ্টি, মৃত্যুভয়কে তোয়াক্কা না করে তারা সত্য ও ন্যায়সঙ্গত আকাক্সক্ষার বিরুদ্ধে দীর্ঘকালব্যাপী রাষ্ট্রযন্ত্রকে পরিচালনা করার অশুভ ষড়যন্ত্রকে পরাভূত করেছিল। জনগণের এই আন্দোলনে আমাদের জানা মতে ৮ শতাধিক জীবন আমরা হারিয়েছি স্বৈরাচারী শক্তির হাতে।

প্রধান উপদেষ্টা ভাষণে আরও বলেন, ছাত্র-জনতা অদম্য সংকল্প ও প্রত্যয়ের মাধ্যমে একটি স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা থেকে আমাদের মুক্তি এনে দিয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, ছাত্র-জনতার এই সম্মিলিত সংকল্পের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্ব সম্প্রদায়ের মাঝে একটি দায়িত্বশীল জাতির মর্যাদায় উন্নীত হবে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণ বিশেষ করে যুবসমাজ ন্যায্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছে এবং নতুন প্রজন্ম এজন্য জীবন উৎসর্গ করেছে। উদারনীতি, বহুত্ববাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর মানুষের গভীর বিশ্বাস থেকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয়। ১৯৭১ সালে যে মূল্যবোধকে বুকে ধারণ করে আমাদের গণমানুষ যুদ্ধ করেছিল, সেই মূল্যবোধকে বহু বছর পরে আমাদের জেনারেশন জেড (জেন-জি) নতুনভাবে দেখতে শিখিয়েছে। এ রকমটি আমরা দেখেছিলাম ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে বাংলাকে মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার সময়েও।

ড. ইউনূস বাংলাদেশের গণ-অভ্যুত্থানের নায়ক যুবসমাজের ভূয়সী প্রশংসা করে তার ভাষণ শেষ করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের তরুণরা প্রমাণ করেছে মানুষের স্বাধীনতা, মর্যাদা ও অধিকার সমুন্নত রাখার অভিপ্রায় কোনো উচ্চাভিলাষ নয়। বরং এটা সকলের নিশ্চিত প্রাপ্য।

বাংলাদেশের নতুন যাত্রায় বিশ্ববাসীকে স¤পৃক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের ছাত্র-জনতা তাদের অদম্য সংকল্প ও প্রত্যয়ের মাধ্যমে একটি স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা থেকে মুক্তি এনে দিয়েছে। আমাদের মুক্তি ও গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিতে আমি বিশ্ব সম্প্রদায়কে নতুন বাংলাদেশের সঙ্গে নতুনভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার আহ্বান জানাই।

গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সমতা ও সমৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে একটি ন্যায়ভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক সমাজ হিসেবে আত্মপ্রকাশের অভিপ্রায় বাস্তবায়নে বাংলাদেশের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন ও সহযোগিতা বাড়ানোর আহ্বান জানান অধ্যাপক ইউনূস।

অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, যে রাষ্ট্র কাঠামো দুঃসহ হয়ে গেছে, তার পুনর্গঠনের জন্য আমাদের তরুণেরা এবং দেশের আপামর জনসাধারণ একমত হয়ে আমার এবং আমার উপদেষ্টা পরিষদের ওপর আস্থা রেখে সরকার পরিচালনার এক মহান দায়িত্ব অর্পণ করেছে। এ দায়িত্ব গ্রহণের পর আমরা গভীর বিস্ময় ও হতাশার সঙ্গে দেখতে পাচ্ছি, কীভাবে সর্বগ্রাসী দুর্নীতি একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে, কীভাবে রাষ্ট্রের মূল প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্মম দলীয়করণের আবর্তে বন্দি করে রাখা হয়েছিল, কীভাবে জনগণের অর্থসম্পদকে নিদারুণভাবে লুটপাট করা হয়েছিল, কীভাবে একটি বিশেষ স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী সব ব্যবসা-বাণিজ্যকে অন্যায়ভাবে কুক্ষিগত করে দেশের সম্পদ অবাধে বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। এক কথায়, প্রত্যেকটি পর্যায়ে ন্যায় ও নৈতিকতা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল।

ড. ইউনূস বলেন, এ রকমই এক অবস্থায় দেশ পুনর্গঠন এবং জনগণের কাক্সিক্ষত রাষ্ট্রব্যবস্থা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আমাদের ওপর দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। অতীতের ভুলগুলোকে সংশোধন করে প্রতিযোগিতামূলক ও শক্তিশালী অর্থনীতি এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলাই এ মুহূর্তে আমাদের মূল লক্ষ্য।

ড. ইউনূস তার ভাষণে উল্লেখ করেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সব রাজনৈতিক দল এখন স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ করতে পারছে। তিনি বলেন, আমরা মানুষের মৌলিক অধিকার সমুন্নত ও সুরক্ষিত রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আমাদের দেশের মানুষ মুক্তভাবে কথা বলবে, ভয়-ভীতি ছাড়া সমাবেশ করবে, পছন্দের ব্যক্তিকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে- এটাই আমাদের লক্ষ্য। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংরক্ষণ এবং সাইবার ডোমেইনসহ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সুসংহত করতেও আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

ড. ইউনূস-গুতেরেস বৈঠক

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। বৈঠকে ড. ইউনূসের নেওয়া নানা সংস্কার উদ্যোগকে স্বাগত জানানোর পাশাপাশি এ? সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে জাতিসংঘ প্রস্তুত রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় দুপুর ২টায় জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে তারা সাক্ষাৎ করেন এবং সংক্ষিপ্ত বৈঠকে বসেন।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্বগ্রহণ করায় তাকে অভিনন্দন জানান আন্তোনিও গুতেরেস। শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশের অবদানসহ জাতিসংঘ ও বাংলাদেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার প্রশংসা করেন তিনি। এ ছাড়া বাংলাদেশে চলমান সংস্কার প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘের পরিপূর্ণ সমর্থন থাকবে বলে জানান। মহাসচিব ও প্রধান উপদেষ্টা রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়েও আলোচনা করেন।