নিজ নিজ মন্ত্রণালয় নিয়ে এক পৃষ্ঠার একটি ভবিষ্যত পরিকল্পনা তৈরী করতে সচিবদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহম্মদ ইউনূস। সচিবদের উদ্দেশ্য তিনি বলেছেন, মন্ত্রণালয় নিয়ে আপনাদের পরিকল্পনা কী, ভবিষ্যত স্বপ্ন কী (ফিউচার ড্রিম) সে সব সংক্ষেপে এক পৃষ্ঠার মধ্যে লিখে নিয়ে আমার কাছে আসুন।’
তিনি প্রশাসন পরিচালনায় সচিবদের অতীতের গৎবাঁধা ভাবনা ও চিন্তা থেকে বেরিয়ে সৃজনশীল হওয়া এবং সরকারের সব পর্যায়ে সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ (মার্চিং অর্ডার) বাস্তবায়ন ও সরকারি অর্থের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে নির্দেশনা দেন। সরকারি অর্থে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বা স্থাপনার নামকরণের ক্ষেত্রে একটি আইনি কাঠামো প্রণয়ন করে সরকারের বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করতে বলা হয়েছে। কমিটি প্রয়োজনে সদস্য কো-অপ্ট করতে পারবে। কমিটি প্রয়োজন অনুসারে সভা করতে পারবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কমিটিকে সাচিবিক সহায়তা দেবে সভায় এমন নিদেশনা প্রদান করা হয়। পরে নামকরণে আইনি কাঠামো করতে উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি গঠন করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। গতকাল বুধবার তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে (সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়) প্রথমবারের মত বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের সচিবদের সভায় ড. মুহাম্মদ ইউনূস এসব নির্দেশনা দেন। বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এটিই ছিল প্রথম সচিব সভা।
সভায় অংশ নেওয়া সরকারের একাধিক সচিবের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খাদ্য নিরাপত্তা, বাজারে পণ্যের সাপ্লাই চেইন, প্রশাসনে দুর্নীতি রোধ ইত্যদি বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা কথা বলেন। তিনি সচিবদের আস্থার সঙ্গে কাজ করার পরামর্শ দিয়ে এক পর্যায়ে বলেন, এখানে যারা আমরা উপস্থিত আছি, আমরাই সরকার। জনগণকে সর্বোচ্চ সেবা দিতে হবে। সভায় সচিবদের অনেকে নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের কর্মকান্ড তুলে ধরেন। বিশেষ করে আর্থিক খাত, বাণিজ্য ও শিল্প ও জননিরাপত্তা বিষয়ে ইতিমধ্যে সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ প্রধান উপদেষ্টার কাছে তুলে ধরেন। সভায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে উপদেষ্টা ড. আলী ইমাম মজুমদার অংশ নেন। সভা পরিচালনা করেন মন্ত্রীপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন। বেলা ১১টায় শুরু হয়ে এ সভা সাড়ে ১২টায় শেষ হয়। সভায় সর্বমোট ১০জন সচিব বক্তব্য রাখেন। তারা হলেন, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব ড. মুহম্মদ আব্দুর রশীদ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোখলেস উর রহমান, জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব ড. আব্দুল মোমেন, অর্থ বিভাগের সচিব ড. খায়েরুজ্জামান মজুমদার,শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব জাকিয়া সুলতানা, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাং সেলিম উদ্দিন, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মো. ইসমাইল হোসেন এনডিসি, বিদ্যুত বিভাগের সচিব মো. হাবিবুর রহমান এবং জ্বালানী ও খনিজসম্পদ বিভাগের সচিব মো. নুরুল আলম।
সভা শেষে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে জানানো হয়, সচিব সভায় সচিবদের উদ্দেশ্য বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়ে ড. মুহম্মদ ইউনূস বলেন, নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য গৎবাঁধা চিন্তাভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে, চিন্তার সংস্কার করে, সৃজনশীল উপায়ে জনস্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সরকারি কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সৃষ্ট নতুন বাংলাদেশ নিয়ে বিশ্বব্যাপী যে আগ্রহ, ইতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে, দেশের স্বার্থে তা সর্বোত্তম উপায়ে কাজে লাগাতে হবে। সরকারের সব পর্যায়ে সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে এ সময়ে মার্চিং অর্ডার বাস্তবায়ন করতে হবে। সংস্কার কর্মসূচি প্রণয়নে প্রয়োজন অনুযায়ী সংশ্লিষ্টদের সাথে আলোচনা ও মতামত নেওয়ারও তাগিদ দেন। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জুলাই-অগাস্টের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার বৈষম্যহীন মানবিক দেশ গড়ার যে প্রত্যয়, যে ভয়হীন চিত্ত আমাদের উপহার দিয়েছে, তার উপর দাঁড়িয়ে বিবেক ও ন্যায়বোধে উজ্জীবিত হয়ে আমাদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে সততা, নিষ্ঠা, জবাবদিহিতা নিয়ে নতুন বাংলাদেশ গড়তে হবে। দুর্নীতির মূলোৎপাটন করে, সেবা সহজিকরণের মাধ্যমে জনগণের সর্বোচ্চ সন্তুষ্টি অর্জন করতে হবে। ড. ইউনূস বলেন, সরকারি অর্থের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি ক্রয়ে যথার্থ প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে এবং স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিতে বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতা গুলো দূর করতে হবে। এবং সৃষ্টিশীল, নাগরিক-বান্ধব মানসিকতা নিয়ে প্রতিটি মন্ত্রণালয়-বিভাগ স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার কর্মসূচির সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা দাখিল করবে, যা নিয়মিত মূল্যায়ন-পরিবীক্ষণ করা হবে।এছাড়া নাগরিকবান্ধব মানসিকতা নিয়ে সংস্কার ও পরিকল্পনা দাখিল করা এবং তা নিয়মিত মূল্যায়ন করা, নতুন বাংলাদেশ নিয়ে বিশ্বব্যাপী যে আগ্রহ তৈরি হয়েছে সেই ইতিবাচক ধারণা সর্বোত্তম উপায়ে কাজে লাগাতে সচিবদের বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা। ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনে ৫ অগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে চলে গেলে আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। এরপর ছাত্রদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদইউনূস দেশে এসে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার গঠন করেন। এই যাত্রায় ইউনূসের সঙ্গী হয়েছেন ২০জন উপদেষ্টা। প্রধান উপদেষ্টা মোট ছয়টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ নিজের হাতে রেখেছেন।