পুলিশ চাইলে সব পারে

বাংলাদেশে পুলিশ এবং গোয়েন্দাদের দক্ষতার ওপর আমার পূর্ণ আস্থা আছে। তারা অনেকবারই এ দক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন। সর্বশেষ রাজধানীতে জোড়া খুনের ঘটনায় এমপিপুত্রসহ দুজনকে গ্রেফতারের পর এই আস্থায় যুক্ত হয়েছে শ্রদ্ধাও। সাধারণত মিডিয়ায় কোনো বিষয় নিয়ে হইচই হলে পুলিশ তৎপর হয়, মিডিয়া চুপ হয়ে গেলে পুলিশও চুপ মেরে যায়। এভাবে প্রতিদিন কত ঘটনা চাপা পড়ে যায়, কত বিচারের বাণী কোনো পাথুরে দেয়ালের আড়ালে চাপা পড়ে নিভৃতে কেঁদে মরে তার খবর কে রাখে? আর এত মানুষের দেশে প্রতিদিনই কোনো না কোনো ঘটনা ঘটে। সব ঘটনার প্রতি যথাযথ নজর দেওয়া পুলিশের পক্ষে সম্ভব হয় না। ১৩ এপ্রিল রাত পৌনে ২টায় মগবাজার থেকে বাংলামোটরগামী একটি দামি গাড়ি থেকে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়া হয়। তাতে গুলিবিদ্ধ হন দুজন- একজন রিকশাচালক আবদুল হাকিম, অপরজন দৈনিক জনকণ্ঠের সিএনজিচালক ইয়াকুব আলী। ঘটনাটি এতই অনুল্লেখযোগ্য যে মিডিয়ার নজর কাড়েনি তা। আসলে ১৬ কোটি মানুষের দেশে একজন রিকশাচালক আর একজন সিএনজিচালকের গুলিবিদ্ধ হওয়া কারোই নজর কাড়ে না, অন্তত মরেনি তো। যে দেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায়, লঞ্চডুবিতে, মারামারিতে লোক মারা যায়; যে দেশে প্রায় প্রতিদিনই ধর্ষণ বা গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে; সে দেশে দুজন অতি দরিদ্র মানুষের গুলিবিদ্ধ হওয়া আসলে কোনো নিউজই নয়। আমি স্বীকার করছি, আমার রিপোর্টারও যদি এই দুজনের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর নিয়ে আসতেন, আমি বিরক্ত হতাম। রিকশাচালকের মা মনোয়ারা বেগম বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে মামলাও করেন। তারপর সবার অজান্তে গুলিবিদ্ধ দুজন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। মধ্যরাতে অজ্ঞাত কারও গুলিতে দুজন দরিদ্র মানুষের গুলিবিদ্ধ হওয়া, পরে হাসপাতালে মারা যাওয়া এবং যে মামলার বাদী একজন অতি দরিদ্র নারী; সে মামলা বুদবুদের মতোই মিলিয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তা যায়নি। ঘটনার ২৭ দিন পর প্রথমে গাড়িচালক ইমরান ফকির এবং পরে তার স্বীকারোক্তির সূত্র ধরে গ্রেফতার করা হয় বখতিয়ার আলম রনিকে। এই বীরপুরুষই তার লাইসেন্স করা পিস্তল দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়েছিলেন, যা কেড়ে নেয় দুই দরিদ্র মানুষের প্রাণ। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে বেরিয়ে আসে অজগরের সন্ধান। এই বীরপুরুষ বাংলাদেশের একজন আইনপ্রণেতার সন্তান। তার মা সরকারি দলের সংসদ সদস্য এবং বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পিনু খান। যে গাড়ি থেকে গুলি করা হয়েছে সেটিও সংসদ সদস্যের ট্যাক্স ফ্রি কোটায় কেনা কোটি টাকা দামের প্রাডো। আর পিস্তলটিও ছিল লাইসেন্স করা। একজন সংসদ সদস্যের গাড়িতে চড়ে তার ছেলে নিজের লাইসেন্স করা পিস্তল দিয়ে দুজন ‘অপ্রয়োজনীয়’ মানুষকে মেরেছে, তা নিয়ে এত হইচই করার কি আছে, আমার মাথায় ঢোকে না। দেশটা তো রনিদের মায়েদের তালুক। পুলিশের কাছে গাড়ির চালক আর রনির স্বীকারোক্তি শুনে আমাদের মতো আমজনতার পিলে চমকে যায়। এমপিপুত্র রনি তার বন্ধুদের নিয়ে বাংলামোটরের ‘শ্যালে’ বারে মদ খায়, সেখান থেকে যায় পাঁচ তারকা হোটেল সোনারগাঁওয়ে। সেখানে আরেক দফা মদ খেয়ে এক বন্ধুকে নামাতে তারা যায় মগবাজার। সেখান থেকে ফেরার পথে জনকণ্ঠ ভবনের সামনে এসে তাদের গাড়ি যানজটে আটকা পড়ে। অত রাতে যানজট দেখে মেজাজ বিগড়ে যায় মাননীয় এমপিপুত্রের। ক্ষিপ্ত হয়ে সে তার লাইসেন্স করা পিস্তল ঠিক আছে কিনা তা একটু পরীক্ষা করেছে। ঘটনা শুনে আমার একটা গল্প মনে পড়ে গেল। একটি জলাশয়ের ধারে দাঁড়িয়ে কয়েকটি ছেলে খেলার ছলে ঢিল ছুড়ছিল। এক পর্যায়ে একটি প্রবীণ ব্যাঙ বলে উঠল, বাছারা তোমাদের কাছে যা খেলা, আমাদের কাছে তা মৃত্যু। গল্পের ব্যাঙের তবু ভয়েস আছে, আমাদের দেশে বাস্তবের রিকশাওয়ালাদের তাও নেই। এমপিপুত্রের খেয়ালি গুলি দুটি মানুষের প্রাণ নিয়েছে, ধ্বংস করে দিয়েছে দুটি পরিবারকে। রিকশাচালক হাকিমের আয়ে তার বাবা-মা একটি বস্তিতে থেকে জীবনধারণ করতেন। রোজগেরে ছেলেকে হারিয়ে অকুল পাথারে পড়েছে পরিবারটি। বুড়ো বাপ রিকশা নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন। হাকিমের মা মনোয়ারা এখন অন্যের বাসায় কাজ করেন। ইয়াকুবের বিধবা পত্নীর চোখের জল ভেজাতে পারে না আমাদের পাথুরে বিবেক।

শুরুতেই পুলিশের দক্ষতার ওপর আস্থা আর শ্রদ্ধার কথা বলেছিলাম। আমি বিশ্বাস করি বাংলাদেশে পুলিশ চাইলেই সব পারে। নইলে অমন একটি ক্লু-লেস, সাক্ষী-লেস ঘটনারও রহস্য উদঘাটন করে ফেলা সহজ কথা নয়। দৈনিক জনকণ্ঠের সিসিটিভির ফুটেজ থেকে প্রথমে একটি কালো প্রাডো গাড়ির হদিস পায় পুলিশ। সেই সূত্র ধরে প্রথমে আটক করা হয় গাড়ির চালককে, তারপর এমপিপুত্রকে। আপনারা বলতে পারেন, পুলিশ যদি সব পারে, তবে সব ধরে না কেন? সব ধরে না, কারণ সব ধরার অনুমতি নেই পুলিশের। তাদের নিয়ন্ত্রণ করা হয় দল থেকে। অতি রাজনীতিকরণ, অতি দলীয়করণ করে পুলিশের দক্ষতার ধার কেড়ে নেওয়া হয়। যে দেশে জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় চিফ হুইপকে প্রকাশ্য রাজপথে গরুপেটা করলে পদক, পদোন্নতি মেলে; সে দেশে পুলিশকে দক্ষ না হলেও চলে। পুলিশ কেন খুঁজে খুঁজে এমপিপুত্রকে ধরলো, আমার কোনো হিসাবেই মেলে না। আমার ধারণা পুলিশ না জেনেই এটা করেছে। আগে জানলে আর এগুতোই না। আসামি ধরে এখন পুলিশ বিপদে পড়েছে। এখন নিশ্চয়ই সেই দক্ষ পুলিশেরা মাথার চুল ছিঁড়ছে, কেন এই আসামি ধরতে গেলাম। আসামি ধরলেও বাদীকে তা জানায়নি পুলিশ। রিমান্ডে আনলেও জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেনি। অসুস্থতার ভান ধরে তিন হাসপাতাল ঘুরে এসেছে এমপিপুত্র, কিন্তু ডাক্তাররা রোগ ধরতেই পারেননি। ডাক্তাররা রোগ ধরবে কোত্থেকে? রোগের নাম তো ধরাকে সরা মনে হওয়া। তুচ্ছ রিকশা কিভাবে এমপিপুত্রের গাড়ি আটকায়? পত্রিকায় পড়লাম, রনির অসুস্থ সন্তানকে সেদিন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অসুস্থ সন্তানকে হাসপাতালে রেখে কোনো বাবা বারবার ঘুরে ঘুরে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে মদ খেতে পারে, এমন কথা আমার মাথায় ঢোকে না। অবশ্য কিছু লোক আছে সন্তান অসুস্থ হলে দুঃখে মদ খায়, সন্তান সুস্থ থাকলে আনন্দে মদ খায়, সন্তান না থাকলে এমনি এমনি খায়। এমন সন্তানকে বাঁচানোর জন্যও এমপিরা তদ্বির করেন জেনে সেই এমপির জন্য করুণার চেয়ে বেশি করতে মন চাইছে না। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি না দিলেও রনির জন্য নতুন করে রিমান্ড চায়নি পুলিশ। তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। পত্রিকায় ছবি ছাপা হলেও মামলার সবচেয়ে বড় আলামত গাড়িটি জব্দ করা হয়নি। রনি আদালতে গিয়ে সব অস্বীকার করলেই তাকে আটকানো কঠিন হবে। টিভিতে দেখলাম ক্যামেরার সামনে নিজেকে আড়াল করতে রনি তোয়ালে দিয়ে মুখ ঢাকার চেষ্টা করছে। এত বড় লজ্জা, এত বড় অপরাধ কি অতটুকু তোয়ালে দিয়ে ঢাকা যাবে মি. বখতিয়ার আলম রনি? পুলিশের কাজ পুলিশ করেছে। এখন সঠিক তদন্ত করে কাজটি শেষ করতে হবে। সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে, কারণ দেশটা এমপিপুত্রদের শুটিং প্র্যাকটিসের মাঠ নয়। মাননীয় সংসদ সদস্য পিনু খানের প্রতি অনুরোধ, আপনি আইনপ্রণেতা। এখন আপনার দায়িত্ব সেই আইন রক্ষা করা, সেই আইনকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা। অমন কুলাঙ্গার পুত্রকে বাঁচানোর চেষ্টা করবেন না। আইনকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দিন।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর