ছিটমহল বিনিময়ের ৯ বছরে দেশের উন্নয়নের ধারায় মিলেছে দীর্ঘ ৬৮ বছর বন্দিজীবন কাটানো মানুষেরা। যোগাযোগ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, চাকরিসহ সব মৌলিক অধিকারে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন তারা। তাই প্রতি বছরের মতো ছিটমহল বিনিময়ের দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে পালন করে আসছেন নানা কর্মসূচিও।
এদিকে দেশের অভ্যন্তরে থাকা সবচেয়ে বড় অধুনালুপ্ত ছিটবাসীদের ভাগ্য পরিবর্তনে নানা উন্নয়নের পাশাপাশি বিশেষ নজর রাখার কথা জানায় প্রশাসন।
সরেজমিনে দেখা যায়, পাকা সড়ক, কমিউনিটি ক্লিনিক, ই-সেন্টার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ, মসজিদ-মন্দির সবই শোভা পাচ্ছে অধুনালুপ্ত ছিটমহলে। সব সুবিধায় ফসলি জমি চাষাবাদ করছেন কৃষকরা। বেড়েছে ব্যবসা বাণিজ্যের পরিধিও।
এখন এমনই চিত্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার বিলুপ্ত ছিটমহল দাসিয়ার ছড়ার। এখানে বসবাসকারী প্রায় ১৫ হাজার মানুষের সব মৌলিক চাহিদা মিটিয়ে জীবন-মান উন্নয়নে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ার পাশাপাশি নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে সরকার।
বিলুপ্ত ছিটবাসীরা জানান, বিনিময়ের আগে তাদের ভারতের নাগরিকত্ব থাকলেও যেতে পারতেন না নিজ দেশে। অন্যদিকে মিলতো না বাংলাদেশের কোনো সুবিধাও। এভাবে ৬৮ বছর বন্দিজীবন কাটানোর পর মুক্ত হয়েছেন তারা। আগে গোপনে লেখাপড়া ও কৃষিপণ্য আনা নেওয়া করলেও এখন মিলছে সরকারি চাকরিসহ সব সুবিধা। এতে খুশি বিলুপ্ত ছিটের বাসিন্দারা।
অধূনালুপ্ত ছিটমহল দাসিয়ার ছড়ার বাসিন্দা মিজানুর রহমান জানান, আগে মিথ্যা পরিচয়ে লেখাপড়া করেছি। ছিটমহল বিনিময়ের পর সেই পরিচয়ে দাসিয়ারছড়া কমিউনিটি ক্লিনিকে সিএইচসিপি পদে চাকরি পেয়েছি। আমরা এখন ভালো আছি।
দাসিয়ার ছড়ার কালিরহাট এলাকার মনির হোসেন জানান, ছিটমহল থাকা অবস্থায় আমরা ভারতের নাগরিক ছিলাম। কিন্তু ভারতে যেতে পারিনি। বাংলাদেশে গেলেও খুব গোপনে ভয়ে ভয়ে যেতে হতো। আমার স্ত্রী অসুস্থ ছিল। কিন্তু তাকে সময়মতো বাংলাদেশের হাসপাতালে নিতে না পাড়ায় মারা গেছেন। রাস্তা ছিল না। নদীর উপর ব্রিজ ছিল না। এখন রাস্তা হয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়েছে, বিদ্যুৎ পাচ্ছি। এককথায় সব সুবিধা ভোগ করছি। আমাদের একটিই দাবি, দাসিয়ার ছড়াকে একটি ইউনিয়ন করা হোক।
বিলুপ্ত ছিটমহল দাসিয়ার ছড়া টনকার পাড় এলাকার কৃষক আমির হোসেন জানান, ছিট বিনিময়ের আগে আমরা চোরের মত সার, তেল, ওষুধ এনে চাষাবাদ করতাম। এখন আমরা বাংলাদেশের নাগরিক। বিদ্যুতের সেচ দিচ্ছি ও মুক্ত অবস্থায় সার, কীটনাশক কিনে চাষাবাদ করছি।
বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা জানান, আন্দোলনের পর আমরা দীর্ঘ ৬৮টি বছরের বন্দিজীবন থেকে মুক্ত হয়েছি। আমরা বিনিময়ের পর থেকে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে যে সকল মৌলিক অধিকার পাওয়ার কথা সব পাচ্ছি। চিকিৎসা, শিক্ষাসহ সবকিছু। আমাদের আর কোন চাওয়ার নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। এখন আমাদের একটাই চাওয়া- দাসিয়ার ছড়া দেশের অভ্যন্তরে থাকা একটি বড় ছিটমহল ছিল। এটিকে একটি স্বতন্ত্র ইউনিয়ন করার দাবি জানাচ্ছি।
বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি দাসিয়ার ছড়ার সাবেক সভাপতি মো. আলতাব হোসেন জানান, দীর্ঘ ৬৮ বছর বন্দিজীবন কাটানোর পর আন্দোলনের মাধ্যমে মুক্তি পাওয়ার দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রতি বছরের ন্যায় এবারও নানা কর্মসূচী পালন করা হবে। ৩১ জুলাই মধ্যরাতে ৬৮টি মোমবাতি প্রজ্জলনের মধ্য দিয়ে কর্মসূচী শুরু হয়েছে। আজ ১ আগষ্ট দিনব্যাপী নানা গ্রামীণ খেলাধুলার আয়োজন করা হয়েছে।
কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেহেনুমা তারান্নুম জানান, বিগত ৯ বছরে অধুনালুপ্ত ছিটবাসীদের ভাগ্য বদলাতে সকল নাগরিক সুবিধা নিশ্চিতে নির্মাণ করা হয়েছে ব্যাপক অবকাঠামো। দেশের সবচেয়ে বড় বিলুপ্ত ছিটমহল ও জনসংখ্যা বেশি হওয়ায় এখানে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পাকা সড়ক, ব্রিজ কালভার্ট, তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা একটি, হাইস্কুল দুইটি এবং কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে একটি। আগামীতেও তাদের জীবন-মান উন্নয়নে সু-নজরের কথা জানান প্রশাসনের এই কর্মকর্তা।
১৯৭৪ সালে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির আলোকে ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে বিনিময় হয় বাংলাদেশ ও ভারতের অভ্যন্তরে থাকা ১শ ৬২টি ছিটমহল। বাংলাদেশ পায় ১১১টি আর ভারত পায় ৫১টি ছিটমহল। এরমধ্যে কুড়িগ্রাম জেলায় যুক্ত হয় ১২টি, লালমনিরহাটে-৫৯, পঞ্চগড়ে-৩৬ এবং নীলফামারী জেলায়- ৪টি ছিটমহল।