চশমা পরা থাকলে নেত্রীকে ঘটনাস্থল থেকে নেয়া যেত না

‘চশমা পরা থাকলে সেদিন ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে সুধাসদন পর্যন্ত হয়তো নেয়া যেত না নেত্রী শেখ হাসিনাকে। কারণ, তিনি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় হতাহতদের ছেড়ে কিছুতেই এলাকা ত্যাগ করতেন না।

ব্যবহৃত চশমা খুঁজে না পাওয়ায় মঞ্চ থেকে নামিয়ে গাড়িতে তোলা পর্যন্ত সেদিনের ঘটে যাওয়া ঘটনা ভালোমতো দেখতে পারেননি তিনি।

ঘটনার বীভৎস দৃশ্য আঁচ করতে না পারায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে সুধাসদনে নিয়ে যেতে পেরেছি নেত্রীকে।

যদি এই চিত্র তিনি পুরোপুরি দেখতে পেতেন, তাহলে কোনোভাবেই শেখ হাসিনাকে ঘটনাস্থল থেকে ফিরিয়ে নেওয়া যেত না। কারণ, দলের নেতাকর্মীদের তিনি যে কত বেশি ভালোবাসেন, তা সেদিন নতুন করে দেখেছি।’

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি, তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা কর্মকর্তা স্কোয়াড্রন লিডার মামুন এ মন্তব্য করেন।

সেদিন শেখ হাসিনাকে রক্ষা করতে গিয়ে যারা মানবপ্রাচীর গড়ে তুলেছিলেন, তাদেরই একজন স্কোয়াড্রন লিডার মামুন।

এছাড়া সেদিন অন্য যারা মানবপ্রাচীর গড়ে তুলেছিলেন, তাদের মধ্যে অবিভক্ত ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মেয়র প্রয়াত মোহাম্মদ হানিফ, সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও নজিব আহম্মেদ অন্যতম। সেদিনের সেই গ্রেনেড হামলায় আহত মোহাম্মদ হানিফ শেষপর্যন্ত মৃত্যুবরণ করেন।

সেদিন তাৎক্ষণিক মানবপ্রাচীর তৈরি করাদের মধ্যে আরেকজন নিরাপত্তা কর্মী নজিব আহম্মেদ বলেন, প্রথম গ্রেনেড ছোড়ার পরপরই শেখ হাসিনার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা মামুন নেত্রীকে ঠেলে টেবিলের নিচে ঢুকিয়ে নিজের শরীর দিয়ে আড়াল করেন। এসময় মোহাম্মদ হানিফও নিজের শরীর দিয়ে নেত্রীকে

আড়াল করে তাকে নিরাপদ রাখার চেষ্টা করেন।

প্রত্যক্ষদর্শী মামুন ও নজিব আরও জানান, সেদিন যে বীভৎস চিত্র দেখেছি, তা হয়ত কোনোদিনও পুরোপুরি ভুলতে পারবো না। সেদিন দেখেছি, নিজের জীবনের চেয়ে নেতাকর্মীদের প্রতি ভালোবাসা, মমত্ববোধ কত বেশি শেখ হাসিনার!

নজিব আহম্মেদ বলেন, সমাবেশ শেষ হলে প্রথম যে গ্রেনেডটি ছোড়া হয়, তা ট্রাকের পেছনের অংশে যে পাটাতন থাকে তাতে লেগে পাশে ফুটপাতে পড়ে বিস্ফোরিত হয়। আর এতেই পা উড়ে যায় সেখানে থাকা আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানের। আহত হন আরও অসংখ্য। এরপর আরও কয়েকটি গ্রেনেড সমাবেশস্থলে বিস্ফোরিত হয়।তাতে আরও অসংখ্য জন হতাহত হন।

নজিব বলেন, আমি ছিলাম ট্রাকমঞ্চের পেছনের দিকে। প্রথম গ্রেনেডের শব্দ পেয়ে মঞ্চে উঠে এসে নেত্রীকে রক্ষা করতে মানবপ্রাচীরে অংশ নিই। তখন আমাদের স্ব স্ব সিদ্ধান্তে তাৎক্ষণিকভাবে নেত্রীকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাই, তাকে রক্ষা করি। এদিকে মামুন যখন শেখ হাসিনাকে তার গাড়ির দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন, তখন আরও একটি গ্রেনেড ছোড়া হয়। এটি ট্রাকমঞ্চের সামনের অংশে আঘাত করে ট্রাকের নিচে বিস্ফোরিত হয়। এবার মামুন নেত্রীকে টেবিলের নিচে ঢুকিয়ে দেন।

তখন মেজর শোয়েব দেখতে পান,গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত হওয়ার পর ট্রাকের জ্বালানি তেলের ট্যাঙ্ক ছিদ্র হয়ে তেল পড়তে শুরু করেছে। এতে করে যে কোনও সময় ট্রাকে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে এ আশঙ্কা থেকে নেত্রীকে দ্রুত গাড়িতে তুলে নেন তিনি। এ সময় শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার চশমা কই?’

মামুন বলেন, গ্রেনেড হামলা চলাকালে নেত্রীকে যখন জোর করে ট্রাকমঞ্চে রাখা টেবিলের ভেতরের (যেটা ডায়াস হিসেবে ব্যবহার করা হয়)দিকে ঠেলে দিই, তখন তার চোখ থেকে চশমা খুলে পড়ে যায়। সেই চশমা আর পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, আমার মনে আছে, গ্রেনেড হামলার মধ্যে যখন শেখা হাসিনাকে গাড়িতে তুলছিলাম, তখনও তিনি চশমা খুঁজছিলেন। চশমা পরে যদি তিনি ঘটে যাওয়া বীভৎস দৃশ্য দেখতে পেতেন, তবে তাকে ঘটনাস্থল থেকে কোনোভাবেই সরিয়ে নিয়ে যেতে পারতাম না।

স্কোয়াড্রন লিডার মামুন বলেন, সেদিন ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে কী ঘটে গেছে, তা তাৎক্ষণিকভাবে আমরা কেউই কিছু বুঝে উঠতে পারিনি।

তবে ৩৫ থেকে ৪০ সেকেন্ডের মধ্যে শেখ হাসিনাকে গাড়িতে তুলে বায়তুল মোকাররম মজসিদের সামনে দিয়ে জিপিওর মোড় হয়ে সচিবালয়ের সামনের গেট পেরিয়ে সুধাসদনের দিকে রওয়ানা হই।

মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে আমরা ধানমণ্ডির সুধাসদনে গিয়ে পৌঁছাই। ওই সময় গাড়িতে সামনের সিটে নেত্রী ও গাড়ির চালক ছিলেন। আর পেছনের সিটে মেজর জেনারেল তারেক, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, নজিব আহম্মেদ, মেজর শোয়েব ও আমি বসা ছিলাম।

পরবর্তীতে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার চিত্র দেখে শিউরে ওঠেন শেখ হাসিনামামুন বলেন, এসময় গাড়িতে বসা শেখ হাসিনাকে শরীরের কোথাও আঘাত লেগেছে কিনা জানতে চাই।

তেমন কিছু যদি ঘটে, তাহলে সুধাসদন নয়, তাকে আগে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাবো ভেবেছিলাম আমরা। জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, আমার কোথাও লাগেনি। আমার গায়ে, কাপড়ে যে রক্ত লেগেছে, তা আমার নয়; এ রক্ত তোমাদের গায়ের।

ওই দিনের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে নজিব বলেন, মানবপ্রাচীর তৈরি করতে যখন নেত্রীর সামনে দাঁড়াই, তখন নেত্রী আমাদের উদ্দেশ্যে বলেন, দোয়া, দরুদ পাঠ করো। আল্লাহকে স্মরণ করো।

নজিব বলেন, ধানমণ্ডির সুধাসদনে গিয়ে নেত্রী প্রথমে যে কাজটি করেন,তাহলো প্রথমে তিনি দোতলায় উঠে নিজের ঘরে প্রবেশ করেন।

এরপর আবার নিচে নেমে আসেন। তারপর বেশ কিছু টাকা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীর হাতে গুঁজে দিয়ে আহত নেতাকর্মীদের চিকিৎসা খরচ মেটাতে তাৎক্ষণিক দায়িত্ব দেন। সবাইকে তিনি হাসপাতালে হাসপাতালে গিয়ে নেতাকর্মীদের খোঁজ-খবর নিতে বলেন। -বাংলা ট্রিবিউন

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর