বিয়েতে দেনমোহরের পরিমাণ দিন দিন যত বাড়ছে, সরকারও এখান থেকে আয় বাড়াতে চাইছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাজেট পরিকল্পনায় চলতি অর্থবছরে বিয়ের নিবন্ধন ফি থেকে আয় গত অর্থবছরের চেয়ে দ্বিগুণ বাড়ানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা নিকাহ রেজিস্ট্রাররা বিয়ের নিবন্ধন ফি আদায় করেন। তাঁরা সাধারণের কাছে কাজি হিসেবে পরিচিত।
সরকার নির্ধারিত বিয়ের নিবন্ধন ফি
বিয়ে ও তালাক নিবন্ধনের ফি নির্ধারণের পর থেকে কয়েক দফা বাড়িয়েছে সরকার। সর্বশেষ ‘মুসলিম বিবাহ ও তালাক নিবন্ধন (বিধিমালা), ২০০৯’ সংশোধন করে ২০২২ সালের ২১ ডিসেম্বর ফি বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগ।
সংশোধিত বিধিমালা অনুযায়ী, এখন একজন নিকাহ রেজিস্ট্রার পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত দেনমোহরের ক্ষেত্রে প্রতি এক হাজার টাকা দেনমোহর বা এর অংশবিশেষের জন্য ১৪ টাকা হারে বিবাহ নিবন্ধন ফি আদায় করেন। এর আগে চার লাখ টাকা পর্যন্ত দেনমোহরের ক্ষেত্রে প্রতি এক হাজার টাকা দেনমোহর বা এর অংশবিশেষের জন্য ১২ টাকা ৫০ পয়সা হারে বিবাহ নিবন্ধন ফি আদায় করতে পারতেন কাজি।
বিধিমালা অনুযায়ী, দেনমোহরের পরিমাণ পাঁচ লাখ টাকার বেশি হলে এর পরের প্রতি এক লাখ টাকা দেনমোহর বা এর অংশবিশেষের জন্য ১০০ টাকা বিবাহ নিবন্ধন ফি আদায় করা হয়। তবে দেনমোহরের পরিমাণ যা-ই হোক না কেন, ফি ২০০ টাকার কম হবে না। তালাক নিবন্ধনের ফি এখন এক হাজার টাকা, যা আগে ৫০০ টাকা ছিল।
জানা যায়, মুসলিম বিয়েতে দেনমোহরের বিপরীতে নিবন্ধনে বিয়ে নিবন্ধক বা কাজি যে টাকা আদায় করেন, তার বড় অংশ সরকারি কোষাগারে এখন জমা করতে জোর দিয়েছে সরকার। নিবন্ধন ফি বাড়ানোর আগে এই আয় বাড়াতে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করেছিল সংসদীয় কমিটি।
বিয়ের দেনমোহরের ফি থেকে আয়
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এই তিন বছরে তিন পার্বত্য এলাকা ছাড়া দেশে ২০ লাখ ২০ হাজার ৭৪৯টি বিয়ে হয়েছে। এসব বিয়ের দেনমোহরের পরিমাণ ৯০ হাজার ৯৪০ কোটি ৬৯ লাখ ছয় হাজার ৩৫১ টাকা। এই দেনমোহরের বিপরীতে কাজিরা আদায় করেছেন এক হাজার ৫৬২ কোটি আট লাখ ৩৩ হাজার ৯৮৭ টাকা। এর মধ্যে সরকারি কোষাগারে জমা পড়েছে সাত কোটি ৮৫ হাজার ৪৫৮ টাকা। বছরে গড়ে সরকারের আয় হয়েছে দুই কোটি ৬২ লাখ টাকা। আর এখন বিয়েতে বছরে গড়ে দেনমোহর হয়ে থাকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা।
সরকারের এই আয়ের তিন বছরে মাথায় প্রায় চার গুণ আয় বাড়ানোর প্রাক্কলন করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে বাজেটে বিয়ের নিবন্ধন ফি থেকে সরকার ৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকা আয়ের পরিকল্পনা করেছে। যদিও গত অর্থবছরে বিয়ের নিবন্ধন ফি থেকে সরকার আয়ের প্রস্তাব করেছিল চার কোটি ৬১ লাখ টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে চার কোটি ২২ লাখ টাকা করেছিল।
দেনমোহর কত
২০০৮ সালের বাংলাদেশি রোমান্টিক-নাট্য চলচ্চিত্র ‘১ টাকার বউ।’ এই চলচ্চিত্রে এক টাকার কাবিন হয়েছে। শুধু চলচ্চিত্র নয়, বাস্তব বিয়েতেও এমন হচ্ছে। ২০২১ সালের ৮ জানুয়ারি ফরিদপুরে এক টাকা দেনমোহরে বিয়ে করেছেন বিপাশা নামের এক তরুণী। সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দম্পতি মাহমুদুল ইসলাম আশিক ও তানিয়া আহমেদ তন্বী গল্পের বাস্তব চরিত্র। ২০২১ সালে মাত্র এক টাকা কাবিনে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন তাঁরা।
২০০৬ সালের ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র কোটি টাকার কাবিন। বাস্তব জীবনেও এখন কোটি টাকার কাবিন হচ্ছে। রাজধানীর অভিজাত এলাকার এক কমিশনারের ছেলের বিয়ের দেনমোহর ১০ কোটি টাকা ছিল বলে জানান ওই এলাকার কাজি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, যার টাকা আছে তিনি এখন কোটি টাকার নিচে সাধারণত দেনমোহর ধার্য করেন না। মধ্যবিত্ত পরিবারের ক্ষেত্রে দেনমোহর দুই লাখ থেকে ১০ লাখ টাকার মধ্যে বেশির ভাগ বিয়ে হচ্ছে।
রাজধানীর বনানী এলাকার কাজি মোহাম্মদ জাকারিয়া বলেন, মধ্যবিত্ত পরিবারে এখন মূল্যস্ফীতির চাপে বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজন কম হচ্ছে। প্রভাব পড়েছে দেনমোহরের ক্ষেত্রে। এখান থেকে সরকারের আয় বাড়ানোর নতুন পদক্ষেপের ওপর নির্ভর করবে।
রাজধানীর শাহবাগ এলাকার কাজি মোহাম্মদ আবদুল মোতালেব বলেন, অন্য বছরের চেয়ে এবার ঢাকা শহরে বিয়ের আয়োজন বাড়েনি। তবে সরকার সারা দেশে জরিপ করেছে। তার ওপর ভিত্তি করে হয়তো বিয়ের ফি থেকে আয় বাড়াতে জোর দিচ্ছে। তিনি বলেন, বিয়ের ফি কত হবে বর ও কনেপক্ষের দেনমোহর নির্ধারণের ওপর নির্ভর করে। আর ফি থেকে আয় তার ওপর নির্ভর করবে।
বিয়েতে মূল্যস্ফীতির চাপ
মূল্যস্ফীতির চাপ আছে বিয়েতে। একদিকে যেমন কেনাকাটার খরচ বেড়েছে, অন্যদিকে আপ্যায়নে ব্যয় বেড়েছে। এই ব্যয় বৃদ্ধির কারণে সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে সীমিত পরিসরে চলছে বিয়ে আয়োজন। মূল্যস্ফীতির চাপে অনেকে ঘরোয়া আয়োজনে সেরে ফেলছেন বিয়ে। এমন তথ্য দিলেন রাজধানীর বিভিন্ন কমিউনিটি সেন্টার, রেস্তোরাঁ ও পার্টি সেন্টারের মালিক ও ব্যবস্থাপকরা।
রাজধানীর খিলগাঁওয়ে একটি পার্টি সেন্টারের ব্যবস্থাপক আবুল বশার জানান, আগে ঈদের আগে-পরে বিয়ের পার্টির জন্য এক থেকে দেড় মাস আগে বুকিং হয়ে থাকত। এবার হাতে গোনা কয়েকটি পার্টি হয়েছে। এবার ঈদের পরে তেমন বুকিং হয়নি। মূল্যস্ফীতির কারণে এখন অনুষ্ঠান আয়োজন কম হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির বাজারে বিয়ের খরচ মেটাতে অনেকেই হিমশিম খাচ্ছেন। এমনও হয়েছে, দু-চারটি বুকিং বাতিল করে ব্যয় সামলাতে ঘরোয়া আয়োজন করছেন।
বাজেটে বাড়ছে বিয়ের ব্যয়
শহর অঞ্চলে বিয়ের আয়োজন মানেই কমিউনিটি সেন্টার। আর এখন থেকে বিয়ের জন্য কমিউনিটি সেন্টার বা পার্টি সেন্টার ভাড়া নিতে লাগবে আয়কর রিটার্ন জমার রসিদ। অর্থাৎ বিয়ের আয়োজনেও যোগ হচ্ছে নতুন খরচ। এখন থেকে বার্ষিক আয়কর রিটার্ন জমার রসিদ ছাড়া মিলনায়তন ভাড়া করা যাবে না। বর্তমানে ৪৩ ধরনের সেবা পেতে রিটার্ন জমার কপি লাগে। এই তালিকায় মিলনায়তন ভাড়া নিতে রিটার্ন জমার এই বাধ্যবাধকতা যুক্ত হয়েছে চলতি অর্থবছরের বাজেটে। যদিও চলতি অর্থবছরে করমুক্ত আয়সীমা বাড়েনি। এখন বার্ষিক করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে তিন লাখ টাকাই আছে।
গত অর্থবছরেও বেড়েছে বিয়ের খরচ। বিয়ের প্রসাধনীতে ১৭ শতাংশ শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। বিদেশি কসমেটিকস আমদানিতে ৩ শতাংশ শুল্ক থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করা হয়; চলতি অর্থবছরে তা-ই দিতে হচ্ছে।